শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৩ অপরাহ্ন

‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’- আইনে কী আছে?

  • Update Time : শনিবার, ১৫ জুন, ২০২৪, ১২.০১ পিএম

তানহা তাসনিম

নানা কারণে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছেন ‘টিকটকার’ প্রিন্স মামুন। সবশেষ গত সোমবার ধর্ষণ মামলায় গ্রেফতার হয়ে আরও একবার আলোচনায় মি. মামুন।

ভুক্তভোগী নারীর অভিযোগ বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করলেও এখন আর তাকে বিয়ে করছেন না মামুন। আর তাই এর প্রতিকার চাইতে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন ওই নারী।

এ ধরনের ধর্ষণের মামলা বাংলাদেশে নতুন না। প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে এই সংক্রান্ত খবর উঠে আসে। কিন্তু বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের বিষয়ে আইনে কী আছে?

ধর্ষণের সংজ্ঞায় যা বলা আছে

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কারো বিরুদ্ধে যদি ধর্ষণ মামলা করা হয় তবে তার বিচার হয় ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধি অনুযায়ী।

দণ্ডবিধির ৩৭৫ নম্বর ধারাতেই ধর্ষণের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, একজন পুরুষ যদি আইনে বর্ণিত পাঁচ অবস্থায় কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে তবে তা ধর্ষণ হিসেবে বিবেচিত হবে।

এরমধ্যে প্রথমেই রয়েছে নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে শারীরিক সম্পর্ক করা।

এরপরই রয়েছে, নারীর সম্মতির বিরুদ্ধে কিংবা মৃত্যু বা আঘাতের ভয় দেখিয়ে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের সম্মতি আদায় করা।

তবে কোনো নারীর বয়স যদি ১৬ বছরের নিচে হয় তবে তার সম্মতি নেয়া হোক বা না নেয়া হোক, তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।

কোনো নারী যদি ভুল করে একজন পুরুষকে নিজের আইনসঙ্গত স্বামী ভেবে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি দেন, এবং পুরুষটি জানেন যে তিনি তার স্বামী নন, আইনের দৃষ্টিতে এমন শারীরিক সম্পর্কও ধর্ষণ হিসেবে পরিগণিত হবে।

                (‘প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়’ করলেও তা ধর্ষণ হিসেবে গণ্য হবে।)

নতুন আইন

পরবর্তী সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমনের লক্ষ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ বা ২০০০ সনের ৮ নং আইন নামে নতুন একটি আইন প্রণয়ন করা হয়।

এই আইনের ৯-এর (১) নং ধারায় ধর্ষণের অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান করা হয়।

একইসঙ্গে এর ব্যাখ্যায় নতুন একটি শব্দ সংযোজন করা হয়। আর তা হলো ‘প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি আদায়।’

ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, “যদি কোনো পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত [ষোলো বৎসরের] অধিক বয়সের কোনো নারীর সহিত তাহার সম্মতি ব্যতিরেকে বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তাহার সম্মতি আদায় করেন, তাহা হইলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন।”

“ধর্ষণ কখনো সম্মতিতে করা সম্ভব না। যদি সম্মতি আদায় করা হয় তখন আবার প্রশ্ন চলে আসে এই সম্মতিটা কীভাবে আদায় করা হয়েছে? যেহেতু নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে এর ব্যাখ্যা দেয়া নেই, তখন আবার আমাদের দণ্ডবিধিকে সাথে নিয়েই চলতে হচ্ছে,” বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ইশরাত হাসান।

অর্থাৎ দণ্ডবিধি ১৮৬০ এর ৩৭৫ ধারায় উল্লিখিত পাঁচটি বিষয়ের মধ্যে যেখানে ধর্ষণের সংজ্ঞা সীমাবদ্ধ ছিল, তা এখন আরও বিস্তৃত রূপ নেয় এবং কোনো নারীর সঙ্গে প্রতারণা করে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়টিও এতে সংযুক্ত হয়।

আইন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভবিষ্যতের কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার বিষয়টিকেই বর্তমানে ‘বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ’ মামলায় ব্যবহার করা হচ্ছে।

“নারী যে সম্মতিটা দিলো, সেটা কি স্বেচ্ছায় দিলো না কোনো না কোনো প্রলোভন দেখিয়ে বা প্রতারণা করে সম্মতিটা আদায় করা হচ্ছে? সম্মতিটা প্রতারণামূলকভাবে হয়েছে কি না সে বিষয়টাই আইনে বলা হচ্ছে,” বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তারিক রিজভী।

অর্থাৎ কোনো পুরুষ যদি ভবিষ্যতের আশ্বাস দিয়ে কোনো নারীর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে এবং পরে সেই প্রতিশ্রুতি না রাখে তবে সেটাই প্রতারণা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আর এই ধারাতেই টিকটকার মামুনের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়।

মামুনের বিরুদ্ধে করা এজাহারে যা বলা হয়েছে

গত ৯ই জুন করা ধর্ষণ মামলায় অভিযোগকারী নারী বলেন, তিন বছর আগে সামাজিক মাধ্যমে ফেসবুকে টিকটকার আবদুল্লাহ আল মামুন ওরফে প্রিন্স মামুনের (২৫) সাথে তার পরিচয় হয় এবং বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে তার সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়।

ঢাকায় মামুনের নিজের কোনো বাসা না থাকায় মাসহ প্রায় দুই বছর তিনি ওই নারীর বাড়িতেই থাকেন।

এসময় ইচ্ছার বিরুদ্ধে মামুন তার সঙ্গে একাধিকবার শারীরিক স্থাপন করেন বলেও এজাহারে উল্লেখ করেন তিনি।

তবে বিয়ের কথা বলার পর মামুন তাকে ভয়-ভীতি দেখিয়ে গত ১৫ই মার্চ বাসা থেকে বেরিয়ে যান। এরপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তা পারেননি বলে অভিযোগ করেন ওই নারী।

এ বিষয়ে স্বজনদের সঙ্গে আলাপ করে পদক্ষেপ নেবার কারণে মামলা করতে দেরি হয়েছে বলেও এজাহারে উল্লেখ করা হয়।

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ: অপব্যবহারের বিস্তর অভিযোগ

বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণের অভিযোগের বিষয়টি প্রায়ই সামনে এলেও এর অপব্যবহার নিয়ে আছে বিস্তর অভিযোগ।

মি. রিজভীর মতে, নারীদের ‘ঢাল’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য আইনটির প্রণয়ন হলেও বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই এটি ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে প্রচুর পরিমাণে অপব্যবহারের মুখে পড়ছে আইনটি।

এ ধরনের মামলা জয়ে আইন পরিপন্থী পন্থা অবলম্বনেরও অনেক উদাহরণ দেখা যায়।

অন্যদিকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনটিকে বৈষম্যমূলক বলে মনে করেন আইনজীবী ইসরাত হাসান।

তিনি বলেন, “একটা ছেলের সময় ধর্ষণ মামলা হচ্ছে। একই কাজ একটা মেয়ে করলে ছেলেটা কি ধর্ষণ মামলা করতে পারবে? পারবে না কিন্তু।”

“প্রতারণার বিষয় আসলে তখন এটাকে আরও ব্যাখ্যা করার জায়গা আছে যে কে কার সাথে করছে, কেন এটা হচ্ছে? ছেলেদেরও এই সুযোগ থাকা দরকার,” বলেন মিজ হাসান।

নারী ও শিশু নির্যাতনের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মামলাই ভুয়া বা মিথ্যা মামলা বলে মন্তব্য করেন মি. রিজভী। এই ধারায় দায়ের করা মামলায় বেশিরভাগ সময়ই অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় আসামিরা অব্যাহতি পান।

কিন্তু এর এর পেছনে আরও ব্যাখ্যা আছে বলেই মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী শাহানারা ইয়াসমিন।

“ধর্ষণ মামলা করার পর আদালতে যে ধরনের প্রশ্ন করা হয় তাতে অনেক সময় ভুক্তভোগী নারী নীরব হয়ে যান। আর নীরব থাকার কারণে মামলার রায় নারীর বিপক্ষে চলে যায়, ফলে মামলা প্রমাণিত হয় না এবং আসামি খালাস পেয়ে যান,” বলেন তিনি।

বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় নারীদের জন্য আইনটি প্রয়োজনীয় বলে মনে করেন মি. রিজভী।

তবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে প্রায়ই অপব্যবহারের মুখে পড়ছে এটি। যার ফলে এর কিছু ধারা নতুন করে পুনর্মূল্যায়নের দাবি রাখে বলে মনে করছেন এই আইনজীবী।

বিবিসি নিউজ বাংলা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024