সারাক্ষন প্রতিবেদন
১৭ তারিখ ঢাকা শহর ও এই শহরের মানুষ ব্যস্ত ছিলো ঈদ উল আযহার পশু কোরবানি, পশুর মাংস বিতরণ ও স্বজন আপ্যায়নে। এর বাইরে ঈদ নিয়ে ছিলো টেলিভিশনের প্রোগ্রাম, আর সারাদিন ঈদের ঘোরাঘুরি।
অবশ্য এর সঙ্গে যোগ হয়েছে ঈদে দেশ ছাড়ার ও পৃথিবীর নানান প্রান্তে যাবার হিড়িক। কোথায় যায়নি এ ঈদে মানুষ। উত্তর আমেরিকা, দক্ষিন, আমেরিকা, ইউরোপ, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো, চায়নার কুনমিং প্রদেশ আর প্রতিবেশী ভারতের নানা প্রদেশ ও বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ তো রয়েছেই।
আধুনিক সময়ের এই ঈদের আনন্দের মাঝে অতীতের ছোট খাটো কোন বিষয় খুঁজতে যাওয়া অনেকটা একটি হেয়ালির মতো। তবুও তার থেকে বেরিয়ে আসে অনেক গল্প যা রূপকথা নয় সত্য; তবে বর্তমানের কারো কাছে রূপকথার মতোই মনে হতে পারে।
ঈদের দিনে খুঁজতে খুঁজতে নারিন্দার মৈশুন্ডিতে পাওয়া গেলো ঝুমু মোড়লকে। এক সময়ে তার ব্যবসা ছিলো ভাড়া বাড়ি খুঁজে দেয়া। বাড়ি খুঁজে দিলে সে পেতো প্রথম মাসের ভাড়ার অর্ধেক। এখন ঝুমু মোড়লের বয়স নব্বই বছরের মতো। খুব একটা চলতশক্তি নেই। তবে তার কাছে গিয়ে বসলে তার ক্ষীন কন্ঠের কথা বুঝতে খুব কষ্ট হয় না।
ঝুমু মোড়লের কাছে জানতে চাওয়া হয়, আজ এই কোরবানির ঈদের দিনটি তার কেমন লাগছে?
ঝুমু মোড়ল একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে, এখন তো কোরবানির ঈদ আসে- একদিনের জন্যে, চলে যায়ও একদিনে। অনেকটা আশ্চর্য লাগে তার কথা শুনে। ঈদ তো চাঁদ অনুযায়ী একদিনের হবে। আগে কীভাবে ঈদ বেশি দিনের হতো।
ঝুমু মোড়ল তার ফোকলা দাঁত বের করে বলে, ঈদ হয়তো একদিন হয়। নমাজ একদিন পড়ে। সেমাই দুই তিন দিন খায়। মাংসও মাস খানেক ধরে খাওয়া যায়। কিন্তু আগে আমাদের ছোট বেলায় এই কোরবানির ঈদ এসে যেতো ঈদের প্রায় পনের দিন আগে আর শেষ হতো আরো পনের দিন পরে।কখনও আরো বেশি। প্রতিদিন সকাল বিকেল আমরা দল বেধে কত আনন্দ করেছি।
পনের দিন আগে কীভাবে কোথায় আসতো।
সে ধোলাই খালের পাড়ে ছিলো।আজিম পুরের খালের পাড়ে ছিলো। মেরাদিয়ার খালের পাড়ে। আর বালু নদীর পাড়ের সেই বড় বড় বটতলায়। আরেকটু দূরে গেলে সাভারে তো আরো অনেক ছিলো। তবে সাভারে যেতো একদিনের বেশি লেগে যেতো নৌকায়।
আপনি কোথায় বেশি আনন্দ করতেন?
আবার ফোকলা দাঁতে হেসে বলে, আমার তো আর বেশি দূর যেতে পারতাম না। হেটে যেতাম ধোলাই খালের পাশে। আর নৌকা নিয়ে যেতাম আজিমপুরে।
কী হতো সেখানে?
আরে এই কোরবানীর ঈদকে ঘিরে বসতো কত বড় মেলা। সেখানে বানর নাচ, সাকার্স থেকে শুরু করে কী না পাওয়া যেতো। পালঙ্ক থেকে মিঠাই সব।আর কত রকমের ভাজা পোড়া খাবার যে- তার ইয়ত্তা নেই। সেই স্বাদের খাবার এখন আর পাওয়া যায় না।
মাস জুড়ে দিনে অনন্ত তিনবার যেতাম সে মেলায়। বিদেশীরা থেকে শুরু করে হিন্দু, মুসলিম, খৃষ্টান সব বন্ধু বান্ধব ও তাদের বা ও মায়েরা আসতো ওই মেলায়।
আর দুপুরে মেলায় গেলে অনেক সময় বন্ধু বান্ধব মিলে জামা কাপড় খুলে নেমে পড়তাম ধোলাই খালে সাতার কাটতে, পানিতে খেলা করতে। বিকেলেও যে করতাম না তা নয়।
এই মেলা কবে থেকে শুরু হয়েছিলো আর কবে শেষ হয়ে গেছে ঝুমু মোড়ল তা জানে না।
তবে লক্ষ্মী বাজারের লক্ষ্মন দত্ত, বয়স ৬০ এর কাছাকাছি হবে। সে বলে ধোলাই খালের ওপর দিয়ে এই রাস্তা হয়ে গেলেও নব্বই দশকের রোকনপুরের এ মাথায় এই কোরবানি ঈদে অন্তত সাতদিন থেকে দশ দিন ছোট আকারের হলেও মেলাটা ছিলো। দেশী মিষ্টি আর দেশী খেলনা বিক্রি হতো। মাটির জিনিসপত্র নিয়ে বসতো অনেকে।
আর তখন আজিমপুরের মেলাটা হতো রাস্তায়। সেখানে কাঠের আসবাবপত্রও পাওয়া যেতো। সে নিজেও একটা আম কাঠের আলমারী কিনেছিলো আশির দশকের শেষে অথবা নব্বই এর দশকের শুরুতে আজিমপুর থেকে।
তার মতে এই মেলা আর ফিরে আসা সম্ভব নয়। কারণ এখন শপিং মলের যুগ। তারপরেও একদিনের একটি সম্প্রদায়ের বাইরে এই ঈদকে আবার কীভাবে একটা মাস জোড়া সকলের আনন্দের বিষয় করা যায় সে বিষয়টি ভাবা যেতে পারে।
Leave a Reply