মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
খোকা বললে, ‘আমি ভাবতেই পারি না আসাদ নেই। খুব কষ্ট হয় আমার। এই যে ও নেই, তার জন্যে কার কি এমন ক্ষতি হয়েছে, কি এমন যাচ্ছে আসছে? নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই-এসব একেবারেই বানোয়াট কথা, কানে খুব ভালো শোনায়, এইটুকুই! অন্যকে মরতে উৎসাহিত করাটা পৃথিবীতে বোধহয় সবচেয়ে সহজ একটা কাজ। মরণ রে, তুই মম শ্যাম সমান, শ্যাম সমানই যদি হবে তবে নাভিশ্বাস ওঠার পর কবরেজ-বদ্যি করার কি দরকারটা এমন? নিছক একটা ধাপ্পা, একটা জঘন্য প্রচারণা, বাবু বিলাসিতা-‘
মুরাদ বললে, ‘অনেক সময় আসাদের জন্যে আমার নিজেরও নানান কথা মনে হয়; কষ্ট দেয় ওর স্মৃতি। অন্যদের চেয়ে আমাদের কষ্টটা বোধহয় একটু বেশিই। কিন্তু কেন জানিস? ও আমাদের খুব কাছের একজন ছিলো ব’লে, চিনতাম ব’লে, জানতাম ব’লে। আসাদ ছিলো ‘আমাদের কাছে বাতাসের ঝাপটার মতো হঠাৎ দেখা পাওয়া বন্ধু; এই জন্যেই কষ্টটা। অত্যন্ত ব্যক্তিগত এ কষ্ট। যারা তাকে চিনতো না বা যাদের সঙ্গে তার কখনো পরিচয় ছিলো না, তাদের কাছ থেকেও কি তুই এটা আশা করিস? যদি করিস, তাহলে সেটা নিছক পাগলের পাগলামি।
চোখটা নিজের দিক থেকে ফিরিয়ে দেশ ও দশের স্বার্থের মাপকাঠিতে ফেলার চেষ্টা কর, দেখবি আজ আর এটা নিছক একটা নাম নয়, ঝকঝকে সোনার তরোয়ালের একটা প্রতীক, বিশাল দেশের ওপর স্থির বিদ্যুতের মতো যা স্কুলে রয়েছে। এভাবে দেখতে পারলেই বুঝবি তোর ওই বন্ধুর জন্যে শোক হা-হুতাশ তরতর ক’রে একেবারে পানসে হ’য়ে গিয়েছে। দেশের কষ্টিপাথরে যদি এভাবে সবকিছু ঘ’ষে নেবার চেষ্টা করিস তাহলে দেখবি আমাদের এইসব ব্যক্তিগত শোক আর কিছু নয়, এক ধরনের গোপন সুখ, আর সুখ ব’লেই দিনের পর দিন এমনভাবে তা বুকের ভিতর লালন ক’রে চলি। কিংবা ধর ঠিক তাও নয়; ওটা একটা শোকই। শোক হলেও ফু কিংবা চোখ ওঠার চেয়ে, কিংবা টনসিলের ব্যামোর চেয়ে তেমন কোনো মারাত্মক কিছু নয়।’
‘ডাকাতের মতো কথা বলছিস। অনেক বদলে গেছিস ক’দিনে, জঘন্য!’
‘আমি ব’লে দিলাম, তুই দেখে নিস, তোর কপালে ঢের বিপদ আছে খোকা। তুই সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে শিখিসনি। দেশ হয়তো ক্ষমা করে, কিন্তু সময়, ভ্যাট্!’
Leave a Reply