অনুবাদ : ফওজুল করিম
সেনেগালে নীলচাষের ক্ষেত্রে ফ্রান্স যে সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে পৌছেছিল ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে তা বিলুপ্ত হয়। গভর্ণর রজার ওই বছর সেনেগাল থেকে চলে যান। তখন থেকে সেনেগালে নীল উৎপাদনের সরকারী সহায়তা ও উদ্যোগ কমতে থাকে। ১ ১৮৩১ সালে এ চেষ্টা পরিত্যক্ত হয়। এসব সত্ত্বেও কিছু উদ্যোগী লোক হাল ছাড়েনি তারা চেষ্টা চালিয়ে যায়। সে সব চেষ্টাও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বঙ্গদেশের যে নীলগাছ সেনেগালের আবহাওয়া মানিয়ে নিয়ে বেড়ে উঠেছিল মন্ত্রণালয় গভর্ণরকে তা পাঠাবার নির্দেশ দিলে সারা দেশে তেমন গাছ একটিও মেলেনি। শত শত বছর ধরে সেনেগালে নীলের চাষ যেমন হয়েছে তেমনি হচ্ছিল পঞ্চাশ বছর পরেও। তবে গভর্ণর রজারের আশাবাদ অনুযায়ী সে নীল বিদেশে রফতানী করা যায়নি। এ সম্পর্কে ১৮৮৬ সালে একজন পর্যবেক্ষকের মন্তব্য:
“সেনেগালের আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে নীলের ঘনীভূত খন্ড পণ্য দ্রব্য হিসাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু ইউরোপীয় বাণিজ্যে সেনেগাল নীল রফতানী করতে পারেনি, যদিও নীল মূল্যবান পণ্য দ্রব্য হিসাবে পরিগণিত হত। নীলচাষ সম্পর্কিত পরীক্ষা- নিরীক্ষায় সরকার ঝুঁকি নিয়ে বিনিয়োগ বিশেষ করতে চাইত না বলে গবেষণা ব্যর্থ হয়ে যায়। সেনেগালের বন্যা প্লাবিত ও উর্বর মাটি নীলচাষের জন্য ছিল বিশেষভাবে উপযোগী। ভারতের চাইতে সেনেগালে শ্রমিকদের মজুরি বাবদ ব্যয় বেশি ছিল বলে অন্যান্য ফসল উৎপাদন করত।” সেনেগালে নীল উৎপাদনের ফরাসী চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর বৃটেন নীল ব্যবসার ক্ষেত্রে বড় রকমের আর কোনো প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হয়নি। বিশ্ব বাণিজ্যে ভারতীয় নীলের আধিপত্য বজায় থাকে ১৮৯০ সাল পর্যন্ত। ওই সময় কৃত্রিম নীল- এ্যানিলাইন বাজারে আসে। এই কৃত্রিম নীলের প্রতিযোগিতায় প্রাকৃতিক নীল বাজার থেকে হটে যায়।
দারাক রিপোর্টের একটি বিষয় হল, বিশ্ববাজারে নীলের বাজারে বৃটেনের একচেটিয়া ব্যবসায় প্রতিহত করার ফরাসী চেষ্টার বিবরণ। সেকালে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর মধ্যে কৃষি ও শিল্পের ক্ষেত্রে যে কেমন গোয়েন্দাগিরি চলত দারাক রিপোর্ট তার এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বহুদিন থেকেই বাংলাদেশে ফরাসীদের বাণিজ্য কুঠি ছিল। তাই বঙ্গদেশে ইংরাজদের নীলচাষে উন্নতি তারা লক্ষ্য করছিল হতাশার সঙ্গে।
নীল ও নীলচাষের সম্পর্কে একটি রিপোর্ট প্রণয়নের জন্য ফরাসী সরকার ১৮২২- ২৩ সালে ঢাকাস্থ সাবেক ফরাসী কুঠির প্রধান পিয়ের পল দারাককে ক্ষমতাপ্রদান করেন। দারাক ১৮২৩ সালের জুলাই মাসে রিপোর্ট লেখা শেষ করে সেটি নৌ-বাহিনী ও উপনিবেশ মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করেন। সেনেগালের গভর্ণরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন ওই মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় রিপোর্টটি ও এইসঙ্গে সম্বলিত চিত্রসমূহ ১৮২৩ সালের আগষ্ট মাসে প্যারিস থেকে সেনেগালে পাঠিয়ে দেন। বঙ্গদেশে কি করে নীলচাষ করা হয় এবং তারপর কিভাবে প্রক্রিয়াজাত করে নীল রঞ্জক উৎপাদন করা হয় তার বিবরণ ছিল ওই রিপোর্টে। কর্তৃপক্ষ বঙ্গদেশের ফরাসী কুঠিকে এমন একজন নীলকর খুঁজে বের করতে বললেন যিনি সেনেগালে গিয়ে নীল উৎপাদনে আগ্রহী হবেন। পিয়ের-চার্লস দারাকের পাঠানো নীল বীজই গভর্ণর রজার সেনেগালের সরকারী বাগানে রোপণ করেন। ৭৭ ফরাসী সরকার কেনইবা দারাককে সাম্রাজ্যের কৃষি-শিল্প গোয়েন্দা অফিসার হিসাবে নিয়োগ দিলেন। পরবর্তী পরিচ্ছেদে আমরা এ বিষয়ে জানার চেষ্টা করব।
Leave a Reply