অনুবাদ : ফওজুল করিম
এই মডেলগুলো আর খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেমন পাওয়া যায়নি বাংলাদেশ থেকে প্যারিসে আর প্যারিস থেকে সেনেগালে পাঠানো রিপোর্টটি। এই বইয়ের দ্বিতীয় পর্বে আমি যে রিপোর্টটি ব্যবহার করেছি সেটি দারাকের অন্য কাগজপত্রের সঙ্গে ছিল এখন যা আছে বৃটিশ মিউজিয়ামে। প্যারিস ও সেনেগালে যে কপিটি পাঠানো হয়েছিল সেটি ছিল চিত্র সম্বলিত, কিন্তু তার ব্যক্তিগত রিপোর্ট ছিল চিত্রহীন। এই সীমাবদ্ধতা ঘোচাবার জন্য কতগুলো প্রকাশিত ছবি জুড়ে দিয়েছি আমি রিপোর্টের সঙ্গে যাতে পাঠকরা বিষয়টি ভালভাবে অনুধাবন করতে পারেন। তবে, এ কথাও বলা দরকার যে এই ছবিগুলি যে সময়ের তা হল রিপোর্ট প্রকাশের ৩৭ বছর পর। ১৮২৩ সালে দারাক যখন বোর্দোতে অবতরণ করেন তখন তিনি সঙ্গে আনেন ছয় পেটি বোঝাই নীলের বীজ (দুই পেটি বেনারসের বীজ, দুই ফার্টিগুর বীজ, দুই পেটি মসজিঞ্জের বীজ)।
বীজগুলো বাংলাদেশ থেকে জাহাজে তোলার সময় যে অবস্থায় ছিল, এখনো আছে সেই অবস্থায়। ফরাসী শুল্ক বিভাগ পেটিগুলি তল্লাসী করার পর আবার পাঠিয়ে দেয় তখুনি।” দারাকের নীল সংক্রান্ত রিপোর্ট ও নীলের বীজ সেনেগালে পৌছালে ক্ষণিকের জন্য হলেও মনে হয়েছিল বাংলার নীলের জন্য ফরাসী চ্যালেঞ্জ বুঝিবা সফলকাম হবে। কিন্তু আসলে হল না কিছুই। আশা করা সত্ত্বেও দারাকের আনা বীজ ফলদায়ক হল না সেনেগালে। বাংলাদেশের নীলকুঠি সম্পর্কে তার সংগ্রহ করা তথ্য কাজে এল না। ১৮৩১ সালের মধ্যে সেনেগালে নীল প্রস্তুত করার ফরাসী স্বপ্ন বুদবুদের মত উড়ে গেল। এরপর বাংলার নীলের আধিপত্য কায়েম ছিল আরও তিরিশ বছর।
বাংলাদেশে নীলের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায় শেষ হয়ে যায় ১৮৬০ সালের দিকে তবে তা সফল প্রতিযোগিতার জন্য নয় বা বিশ্ব বাজারে চাহিদা কমে যাওয়ার জন্য নয় অথবা নীলের গুণগত অবনতির জন্য নয়। বরং এ অবস্থা হয় স্থানীয় দুটি বড় কারণের জন্য। প্রথমতঃ বাংলার রফতানীমুখী কৃষি-বাজারে আরও অর্থকরী ফসলের আবির্ভাবের কারণে। এর মধ্যে প্রধান হল পাট। দ্বিতীয়তঃ খোদ বাংলাদেশেই নীলচাষীরা কয়েকবার বিদ্রোহ করে। এই সব বিদ্রোহ একত্রে নীলবিদ্রোহ হিসাবে পরিচিত। এই বিদ্রোহের কারণে ১৮৬০ সালের ইউরোপীয় নীলকররা বাংলাদেশে নীলের চাষাবাদ থেকে ক্ষান্ত হন। এরপর পার্শ্ববর্তী বিহারে চলতে থাকে নীলচাষ আরও প্রায় চল্লিশ বছর। এরপর কৃত্রিম নীলের প্রভাবে বিশ্ববাণিজ্য থেকে নীল হয়ে যায় উধাও।৯৩ দারাকের রিপোর্ট প্রণয়নের শতাব্দীকালের মধ্যে দারাকের বর্ণিত দুনিয়া অপসৃত হয়।
ডিউক এলিংটন যখন তাঁর বিখ্যাত সঙ্গীত “মুড ইন্ডিগো” রচনা করেন তখন পৃথিবীর শেষ নীলকুঠিটি বন্ধ হয়ে যায় চিরতরে। এখন তো আর সে নীল নেই, আছে নীলের প্রেতাত্মা। বাংলার নদী তীরের নীলকুঠিগুলির ধ্বংসাবশেষে আশ্রয় নিয়ে আছে সে প্রেতাত্মা। হাইতির গ্রামাঞ্চলে আর এল সালভাদরের উপকূলীয় প্রান্তরে। সে নীল এখন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে; এখন বিশ্বভুবনে সে নীল মনভুলানো দ্যুতি ও নীলচাষীদের রক্তজল করা মেহনতের মধ্যে হয়ে গেছে অদৃশ্য।
Leave a Reply