শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:৫০ অপরাহ্ন

রূপের ডালি খেলা (পর্ব-৬)

  • Update Time : শুক্রবার, ২৮ জুন, ২০২৪, ৪.০০ পিএম

ইউ. ইয়াকভলেভ

কিজিল কাঠের ছড়ি

সে গ্রীষ্মে গরম একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। দিনের গরমের পর আসে সাঁঝের গরম, সাঁঝের পর রাতের। শুধু ভোরের দিকেই একটু তাজা আমেজ আসে সমুদ্র থেকে। কিন্তু এই ক্ষীণ শীতলতাটুকুও টেকে বেশিক্ষণ নয়। আর তাপ ছড়ায় কেবল সূর্য’ই নয়। পাথর, বালি, এমনকি গাছের পাতা থেকেও চুইয়ে পড়ে গরম। মাথার ওপর আলস্যে ভাসা বিরল দু’ একটি মেঘ দেখে আর তুষারের কথা মনেও পড়ে না। এমন গরমে আদৌ কল্পনা করাই অসম্ভব যে দুনিয়ার কোথাও আছে তুষার-কণা, বরফ, ঠান্ডা।

সমুদ্রতীরের এই বসতটায় নিথর হয়ে গেল জীবন। লোকে হাঁটে গা-ছাড়াভাবে, নেতিয়ে পড়ে, রোদে বেরতে ভয় পায়। এমনকি ঝানু পুলিন-বিলাসীরাও হামলা সইতে না পেরে ঠাঁই নিয়েছে ছায়ায়।

কিজিল কাঠের ছড়ি-বেচিয়ে বুড়োটাই কেবল এই তপ্ত সূর্যকে ত্যাগ করে নি। বসত সে ঠিক জলের কিনারায় নয়, একটু দূরে, পাথরের নিচু বাঁধটায়। ছায়া খুজেত না সে, নিজের সমস্ত ভাবভঙ্গি দিয়ে যেন চ্যালেঞ্জ করত দুপুরের ঝাঁঝকে। দেখতে রোগা, বে’টে, পোড়া মাটির মতো গায়ের রঙ। মুখের অসংখ্য বলিরেখাগুলোকে মনে হত রোদ-পোড়া ক্ষেতের ফাটল। মাথার ছোটো ছোটো পাকা চুলগুলোকে লাগত নুনের মতো।

বুড়োর পাশে কিজিল কাঠের তিনটে টাটকা ছড়ি। বোঝা যায়, তাদের ঘষা- মাজার কাজ শেষ হয়েছে অতি সম্প্রতি, এখনো হলদে হয়ে ওঠার ফুরসূত পায় নি। মসৃণ, মজবুত, ওজনদার ছড়ি, ফলাও করে বাঁকানো হাতল। দূরে ভ্রমণে খুবই উপযুক্ত। কালক্রমে তাতে হাতির দাঁতের রঙ ধরবে, দেখাবে ভারিক্কী, বনেদী।

দুঃখের বিষয়, কিজিল কাঠের ছড়ির মর্ম’ সবাই বোঝে না। তাই বুড়োর বেসাতির জন্যে চাহিদা ছিল কম। খামোকাই, সে বসে থাকত তপ্ত পাথরে, লোকের। চেয়েও দেখত না। যে-কোনো একটা শিলাখণ্ড কি শুকনো গাছের মতো চোখ-সহ্য হয়ে গিয়েছিল সে।

এমনি একটা দিনে একবার বুড়োর কাছে দাঁড়াল মন্তো শাদা পানামা-হ্যাট পরা একটি ছেলে। ভারি রোগা সে, লিকলিকে হাত, লম্বা গলা। টুপিটা ওর পক্ষে বেশ বড়ো, কান পর্যন্ত ঢেকে গেছে।

ছেলেটা যে এখানকার বাসিন্দা নয়, দক্ষিণী এই বসতটায় নিতান্ত নবাগত, সেটা নির্ভুলভাবে বলে দেওয়া যায় তার গায়ের ঈযৎ গোলাপী রঙ দেখে, এখনো তা রোদ- পোড়া হয়ে ওঠে নি। বুড়োর সামনে জেগে উঠল শাদা টুপিটা ছড়িগুলো দেখতে লাগল ছেলেটা। হাতের মুঠোয় ওর টাকা ছিল, কিন্তু ছড়ি কেনাটা ওর পরিকল্পনায় ছিল না। এমন আত্মসম্মানী ছেলে কে আছে যে লাঠির জন্যে পয়সা খরচ করবে, সে তো গাছ থেকে কেটে নেওয়া বা অন্য কোনো উপায়ে সংগ্রহ করা খুবই সম্ভব! কিন্তু কিজিল কাঠের ছড়িগুলো খুবই অসাধারণ। সাধারণ লাঠির তুলনায় তাদের রঙ চেহারার পার্থক্য ছাড়াও আরো একটা পার্থক্য এই ছিল যে এগুলোর জন্যে দাম দিতে হয়।

‘কত করে?’ জিজ্ঞেস করলে শাদা-টুপি-পরা ছেলেটা।

‘এক-এক আধুলি,’ গা-ছাড়াভাবে জবাব দিলে বুড়ো। ছেলেটার ধারণা হল নিজের মাল বেচার জন্যে বুড়োর মোটেই কোনো চাড় নেই। বুড়োর গোটা মুখ-ভর্তি’ ছোটো ছোটো ফাটল, তার মধ্যে দুটো ফাটল অনাগুলোর চেয়ে বড়ো: তার ভেতর থেকে বুড়োর চোখ নির্বিকারভাবে ছেলেটার দিকে একবার চেয়ে ফের ফাটলে সে’ধাল। ছেলেটা চলে গেল আইসক্রীম কিনতে। এখানে ছেলেটা উঠেছিল তার বাবার পরিচিতদের এক বাড়িতে। এ পরিচিতরা কেমন লোক, সেটা সে ঠাহর করতে পারে কেবল আসার দু’দিন পরে। পরিচিত এই লোকটি ছিল বেশ মোটা, কিন্তু আশ্চর্য’ চটপটে। হাঁটে, খায়, কথা বলে সবই খুব তাড়াতাড়ি। তাছাড়া মেজাজও তার তাড়াতাড়ি বদলায়। প্রথম দিনে সে অতিথিকে বরণ করে সোরগোল তুলে, উল্লাস করে, যেন এতদিন সে কেবল ওর আসার পথ চেয়েই বসেছিল, এবার ছেলেটির একটু মুখের কথা খসামাত্র সে তার জন্যে সবকিছ, করে দেবে। কিন্তু পরের দিন সে ছেলেটাকে চেয়েও দেখলে না, নিজের কাজ নিয়েই রইল, সর্বদাই যেন তার কী একটা তাড়া। গৃহকর্ত্রী, পরিচিতের স্ত্রী চুপচাপ, নিরুচ্ছাস মানুষ।

‘এখানে ঘুমাবি। দুপুরের খাওয়া দু’টোর সময়। সাতটায় রাতের খাওয়া। আর প্রাতরাশ আমরা করি সকাল-সকাল,’ ছোট্ট অতিথিকে এই কথাটুকু জানিয়ে সে চুপ করে যায়।

পানামা-পরা ছেলেটিকে কেউ কিছু করার অনুমতিও দেয় নি, নিষেধও করে নি। যা মর্জি হত সবই সে করতে পারত। যখন সে সমুদ্র-স্নান করলে কেউ ধমক দিল না: ‘নে হয়েছে!’ ‘উঠে আয়!’ সেও উঠে আসে নি।

তারপর ওর ইচ্ছে হল পাহাড়ে যাবে। মনে হয়েছিল, পাহাড় বুঝি এই হাতের নাগালে, আসলে হাঁটতে হয়েছিল অনেক। সমুদ্রতীর থেকে যা মনে হয়েছিল পাহাড়ের গায়ে ঘাস, দেখা গেল তা আসলে বড়ো বড়ো গাছ- পাহাড়ী বন, ঘন, দুর্ভেদ্য, খোঁচা-খোঁচা। আঁকাবাঁকা পাথুরে হাঁটাপথ দিয়ে উঠে যায় ছেলেটা, তৃপ্তি করে শরীর জুড়িয়ে নেয়।

ডাল ভাঙার শব্দ কানে আসে ছেলেটার। সতর্ক হয়ে জড়াজড়ি ডালপালা- গুলোকে সরাতে সরাতে সে শব্দটার অনুসরণ করে। দেখতে পেলে সেই বুড়োটাকে, সমুদ্রতীরে যে কিজিল কাঠের ছড়ি বেচে। একটা ঢিবিতে উঠে বুড়ো সরু, একটা চারা কাটছিল। কিন্তু পারছিল না। সশব্দে দম নিয়ে বুড়ো ফের কাজে নামছিল। অস্ফুট খ্যাক-খ্যাক শব্দ করে মুদা কোঁথাচ্ছিল:

‘আহ… আহ…’

ডালপালার মধ্যে থেমে গেল শাদা টুপিটা। গাছটা কি অতই শক্ত যে বুড়ো কাবু করতে পারছে না? নাকি বুড়োই অত দুর্বল? তার পিঠটা দেখতে পাচ্ছিল ছেলেটা: বাঁকা, পরিশ্রান্ত। পিঠের শার্টটা ঘামে ভেজা। ‘আহ…. আহা…’ ভেসে আসছিল জায়গাটা থেকে।

ছেলেটার মনে হল এই বুঝি বুড়োর কিছু, একটা ছি’ড়ে যাবে, ফেটে যাবে, ভেঙে পড়বে। খয়েরী রঙের গলায় ফুটে উঠেছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম। সমস্ত বলিরেখাগুলো জল-জ্বল করছে যেন শিশির-ভেজা।

অনেক মেহনত করতে হল বুড়োকে। শেষ পর্যন্ত কাটা গেল গাছটা। হয়রান হয়ে মাটিতে বসে পড়ে সে চোখ বুজলে।

সন্ধ্যার দিকে শাদা-টুপি ছেলেটা যখন সমুদ্রতীরে দেখা দিল, বুড়ো তখন বসে ছিল তার বরাবরের জায়গাটিতে। সামনে তার নুড়ির ওপর কিজিল কাঠের দুটি টাটকা ছড়ি। কাছ দিয়ে চলে যাচ্ছে লোক, বুড়ো বা তার বেসাতির দিকে কেউ তাকিয়েও দেখছে না।

একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছেলেটা দেখতে লাগল কেউ ওর ছড়ি কেনে কিনা। যেন বুড়োর সুকঠিন ভাগ্যের খানিকটা ভাগ নিতে চাইল সে। বাঁধের ওপর বুড়োর নিশ্চল মুর্তিটার দিকে তাকাল সে, মনে পড়ে গেল কী ভাবে ওর গলার সমস্ত ভাঁজগুলো জ্বল-জ্বল করছিল ঘামে, বুক ভেঙে বেরিয়ে আসছিল কাতরানি: আহ…. আঁহ….

সে ঘাম কেউ দেখে নি। শোনে নি কাতরানি। কিনলে না তার ছড়ি। ছেলেটা তখন তার পকেট থেকে আইসক্রীম কেনার পয়সাটা নিয়ে এগিয়ে গেল বুড়োর কাছে। কিজিল কাঠের টাটকা ছড়িটা কিনলে সে। ছেলেটা ভেবেছিল সওদা বেচতে পেরে খুশি হয়ে উঠবে বুড়ো, কিন্তু তার অচঞ্চল মুখের ওপর কোনো আনন্দের চিহ্নই দেখা গেল না। দামটা নিয়ে বুড়ো মাথা হেলিয়ে দেখালে ছড়িগুলোর দিকে:

যেটা খুশি বেছে নে। হাতের কাছে যেটা পেল সেইটে নিয়ে চলে গেল ছেলেটা।

সেই থেকে প্রত্যেক দিন সে আসত বুড়োর কাছে, আইসক্রীমের বদলে কিনত কিজিল কাঠের ছড়ি। ঘরের কোণে তার জমে উঠল ছড়ির স্তূপ। ওর কিন্তু নতুন নতুন ছড়ি কেনার বিরাম নেই।

‘গাছগুলো এমন খামোকা নষ্ট করছিস কেন বল তো?’ মন্তব্য করেছিল একবার বাবার সেই পরিচিত।

ছেলেটা চুপ করে থাকে। কিন্তু পরের দিন ফের আরেকটি ছড়ি যোগ হয় তার মজুসে।

আর প্রত্যেক দিন সে ছড়ি কিনলেও কানে নেমে পড়া শাদা পানামা-টুপিটা যেন বুড়োর নজরেই পড়ত না।

গ্রীষ্মের শেষ মাসটা শেষ হতে চলেছে। কমে গেছে গরম। গাঢ়, কালচে, তারা- ভরা সন্ধ্যাগুলো শুরু, হয় তাড়াতাড়ি। কাছিয়ে আসছে চলে যাবার দিন। হঠাৎ ছেলেটার মনে হয়, ও চলে গেলে কে কিনবে তার ছড়ি?

যাবার আগেকার এমনি এক দিনে ছেলেটা গেল তার নিত্যকার সওদা কিনতে। নিজের অচল পশরা নুড়ির ওপর বিছিয়ে বসে ছিল বুড়ো। হয়ত ঢুলছিল সে, নয়ত মগ্ন হয়ে ছিল নিজের গভীরে। সামনে তার যখন শাদা পানামা-টুপিটা দেখা দিল, তখন একটু নড়লও না। যে ছড়িটাই কিন্‌ক, ছেলেটার তাতে এসে যায় না, তাহলেও বুড়ো যাতে ক্ষুন্ন বোধ না করে সেজন্যে ছড়িদুদুটোকে অনেকখন নাড়াচাড়া করে তার একটিকে বাছলে। বেশ ভারি ছড়ি, তাজা ছালের ঝাঁঝালো গন্ধ বেরুচ্ছে তা থেকে। দাম মিটিয়ে ছেলেটা চলে যাচ্ছিল, কিন্তু বুড়ো তার দিকে চেয়ে বললে:

‘বস্ এখানে।’

উবু হয়ে বসল ছেলেটা।

‘কাজ আমার একটা চাই-ই,’ ছেলেটার দিকে না তাকিয়ে বললে বুড়ো, ‘কাজ ছাড়া থাকতে পারি না।’

ছড়ি-বেচিয়ের গলা ছেলেটা এই প্রথম শুনলে: চাপা গলা, যেন তা উঠছে সমুদ্রের গর্জন থেকে। কী উত্তর দেবে ছেলেটা তা ভেবে পেলে না। মুখে ওর চিন্তা ফুটে উঠল। বড়ো শাদা পানামা-টুপিটা খসে পড়ল একটা কান থেকে।

‘আমি শিগগিরই চলে যাব… কী হবে তাহলে?’ জিজ্ঞেস করলে সে।

কোনো জবাব দিলে না বুড়ো। ঘড়ঘড়ে শব্দ করে চণ্ডল হয়ে কী একটা জিনিস বার করলে ন্যাকড়ায় মোড়া। সেদিকে নজর ছিল না ছেলেটার। বুড়ো কিন্তু ধীরে সুস্থে মোড়ক খুললে, মেটে-রঙা তার হাতে দেখা গেল রূপোর খোদাই করা একটা ছোরা। কালো খাপটায় রূপোর কাজ করা। গাঢ় লাল রঙের হাতলটা নিষ্প্রভ হয়ে এসেছে কালক্রমে।

‘ধর,’ বলে বুড়ো এগিয়ে দিল পুরনো ছোরাটা।

প্রথমে ছেলেটা ভেবেছিল বুড়ো তাকে বড়োলোক ঠাউরেছে, কিজিল কাঠের ছড়িগুলোর মতো ছোরাটাও তাকে বেচতে চায়। প্রায় সে বলেই ফেলেছিল, ‘আমার ঢাকা নেই,’ কিন্তু বুড়োর মুখ দেখে খেয়ালু হল ওটা বিক্রির জন্যে নয়, উপহার। তাহলেও এমন একটা উপহার নিতে সঙ্কোচ হল তার।

‘ধন্যবাদ, কিন্তু না, না, আমার দরকার নেই,’ বললে ছেলেটা, ছোরাটা ছোঁবারও সাহস হল না তার।

‘নে, ধর!’ দৃঢ়ভাবে বললে বুড়ো, ‘তোকে আমার মনে ধরেছে। তুই একটা মানুষ।’

ছেলেটার হাতে সে যে-হাতিয়ারটা গুজে দিলে তা কেবল পরমবন্ধুই দান করে তার বন্ধুকে।

বেশ ভারি ছোরা, আর ওই ভারটার জন্যে কেন জানি বুক ভরে উঠল আনন্দে। তারপর একা নিরিবিলিতে ছেলেটা বার বার করে ছোরাটা খুলেছে খাপ থেকে, দেখেছে, তারপর ফের ঢুকিয়ে রেখেছে।

ফলাটা ভালো করে দেখতেই হাতলের কাছে চোখে পড়ল একটা লেখা। হরফ- গুলো বেশ ক্ষয়ে গেছে, তাহলেও বালকের তীক্ষা চোখে তা ধরা না দিয়ে পারল না। হরফগুলো জুড়ে জুড়ে হয়ে উঠল শব্দ, আর সগর্বে সে শব্দ কঠোর ঘোষণা করেছে: ‘বিশ্বস্ত বন্ধুকে!’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024