আমার জানা এক জলহস্তী
মানুষের স্বভাবই এই যে গ্রীষ্মে তার মন কেমন করে নীলাভ তুষার-কণা আর শার্সিতে বরফের নক্সার জন্যে। আবার শীতে তার চাই তপ্ত সূর্য, পল্লবের সবুজ খস-খস, বিলবেরির গন্ধ।
যাচ্ছিলাম আমি গভীর মুড়মুড়ে তুষারের ওপর দিয়ে আর ভাবছিলাম গ্রীষ্মের কথা। অনাড়ম্বর রুশী গ্রীষ্ম নয়, দক্ষিণী গ্রীষ্ম জ্বলজ্বলে ফুলের গন্ধে যা চনমনে, পাথর যেখানে আতপ্ত, গরমে সমুদ্র যেখানে অলস, নিস্তেজ। ভাবতে ভাবতে আমার নিজেরই কেমন গরম ঠেকল, ওভারকোটের বোতাম খুলে ফেললাম, টুপিটা সরিয়ে দিলাম কপাল থেকে। তুষার-কণা হয়ে দাঁড়াল ঝুরঝুরে চকমকি বালি, ফার
গাছ উঠে দাঁড়াল সাইপ্রাস গাছ হয়ে, পাইনের ডাল নড়ে উঠল পাম গাছের সবুজ পাখার মতো।
এই সময়েই শাদা তুষার স্তূপের ওপর দেখলাম গোলাপী মেঘ। আসছিল সে ধীরে ধীরে, এপাশ-ওপাশ হেলে দুলে। মাঝে মাঝে থামছিল, ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল আমার দিকে, তারপর আবার চলছিল নিজের মনে। ও এক জলহস্তী! পা তার দেখা যাচ্ছিল না, জলহস্তীদের পা হয় বে’টে বে’টে, নিশ্চয় তা ডুবে গেছে তুষারে তাই মনে হচ্ছিল যেন জলহস্তীটা তার গোল পেটে আলগোছে তুষার ছয়ে ভেসে যাচ্ছে। জলহস্তীটা অবিশ্যি ঐ ঝুরঝুরে বালি, সাইপ্রাস, পাম গাছের মতোই কল্পিত।
তবে ইদানীং আমার জীবনে দেখা দিয়েছে পুরোপুরি বাস্তব এক জলহস্তী। কথা বলেছি তার সঙ্গে, কান চুলকে দিয়েছি। কান ওর ছোটো ছোটো, কাগজের তেকোণা ঠোঙার মতো মোচড়ানো দুটি গোলাপী রঙের ঠোঙা। সার্কাসে সে খেলা দেখায়। খেলা দেখার পর আমি যাই যবনিকার আড়ালে ওকে দেখতে। সত্যি বলতে কি, খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ওর কান চুলকিয়ে দেবার। এ ব্যাপারে আমার কিছু অভিজ্ঞতাও আছে। যেমন, ছোট্ট একটা কুমিরেরও কান চুলকে দিয়েছিলাম। চোখ তার ছিল সবুজ, মণিটা পলকাটা কালো হীরের মতো। মুখের ডগাটা ওপর-মুখো, পুরনো জুতোর নাকের মতো। ছোটো ছোটো পাগুলো গায়ের সঙ্গে আঁটা আর ঘাড় থেকে লেজের ডগা পর্যন্ত গোটা পিঠটায় সারি সারি ঢিপি। কুমিরটার কান চুলকিয়ে দিই আমি, সেও তৃপ্তিতে চোখ বন্ধ করে আস্তে ঘড়ঘড়িয়ে উঠেছিল। দেখাই যাক না, জলহস্তীটা আমার আদর নেয় কি ভাবে?
জলহস্তীটার রঙ কালচে-গোলাপী। মনে হবে যেন এইমাত্র তপ্ত জলে স্নান সেরেছে, সাবান-মাখা, বুরুশ-ঘষা, দলাই-মলাই হবার পর শুকনো ভাপে দাঁড় করিয়ে কাঁচা পল্লবের ঝাড়ন দিয়ে পেটানো হয়েছে তার গোলালো গা। ফলে গরম খেয়ে সাফসুফ হয়ে জন্তুটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফ্লেমিঙ্গো পাখির মতো গোলাপী। শুধু যেসব জায়গা সাফ করা যায় নি, সেগুলো মনে হয় কয়লার গাঁড়ো ছিটানো।খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে ওকে দেখতে লাগলাম কাছ থেকে। মাথাটা তার প্রকাণ্ড আর ভারী একটা ঘণ্টার মতো।
বিরাট হাঁ-মুখটা চলে এসেছে কান পর্যন্ত, তার চারপাশে ফার গাছের কাঁটার মতো খোঁচা-খোঁচা পাটকিলে কুচি। কাঁটা-মোচ, কাঁটা-দাড়ি। যখন মুখ হাঁ করলে, আমি বলতে কি পিছিয়েই এলাম গরম ভাপ-ওঠা দাঁতালো সে সীমাহীন হাঁ তার গোলাপী রঙে চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। গোলাপী জিভ, গোলাপী কণ্ঠা, গোলাপী তালু। তাল, নয়, নবারুণ আকাশ। মনে হয় যেন ওই বিশাল গহবরে এক্ষুনি সূর্য দেখা দেবে। তার তপ্ত নিশ্বাস যেন সূর্যেরই সান্নিধ্য জানাচ্ছে…
হয়ত জলহস্তীটার কথা ভেবে, হয়ত-বা গভীর তুষার উজিয়ে হেটে চলার ফলে আমার গরম লাগতে লাগল। বরফের ওপর একটা তপ্ত পথ করে চললাম আমি, সামনে জেগে উঠল জলহস্তীর চোখ। সবসময় তা চেয়ে আছে শুধু, একদিকে, অন্য কোনো কিছুর দিকে খেয়াল নেই। তবে সেটা নিষ্কর্মার অলস উদাসীনতা নয়, কিছু একটাতে তা নিবদ্ধ। হয়ত তার জন্মভূমির কথা মনে হচ্ছে, হয়ত ভাবছে তার সঙ্গিনীর কথা, কিছু হয়ত ব্যথা করছে তার…
যতবার সার্কাসে গেছি, জলহস্তীর কান চুলকে দিয়েছি। মোটা চামড়া ওর ঠান্ডা, কিন্তু আমার হাতের ছোঁয়ায় তা উষ্ণ হয়ে উঠত। চোখ বন্ধ করত না সে, ঘড়-ঘড় করত না। তাকিয়ে থাকত কেবল একদিকে।
জলহস্তীর কাছে আমি আসতাম তার বন্ধু, তার ট্রেনার স্তেপানের সঙ্গে। মুখ হাঁ করে জলহস্তী তাকে সেলাম জানাত তার অপূর্ব হাসি দিয়ে আকর্ণ বিস্তৃত হাসি, সারা দাঁত দিয়ে হাসি, উষ্ণ চোখ-ধাঁধানো হাসি। স্তেপান তার মুখের মধ্যে হাত ঢুকিয়ে মাড়ি চুলকিয়ে দিত তার পোষ্যের। জলহস্তীর দাঁত ওঠে ক্রমাগত।। দাঁত ভেঙে যায়, আবার তা গজায়। আর কেবলি মাড়ি খুশ-খুশ করে তার, বাচ্চাদের দাঁত ওঠার সময় যেমন হয়। তারপর স্তেপান হাত লাগায় তার ‘থলিতে’ খাপে-ঢাকা হাতিয়ারের মতো এই ‘থলিতেই’ লুকনো থাকে তার ছেদক দন্ত। পুরো একটা মুঠো ঢুকে যাবে তাতে। জলহস্তীকে আদর করার সময় তার ‘থলি’ চুলকিয়ে দেবার কথা কখনো ভুলো না কিন্তু; এটা তার ভারি ভালো লাগে।
স্তেপান আসতেই জলহস্তীটা হয়ে উঠত চুলবুলে। হুটোপুটি করত জলে, ছোট্ট লেজখানা নাড়াত, চারিদিকে জল ছিটিয়ে পড়ত তা থেকে। শুধু তার চোখ, জলহস্তীর ধাঁধা-ভরা চোখদুটিই থাকত অচঞ্চল, এমনকি বিষণ্ণ।
যাচ্ছিলাম আমি শীতের বন দিয়ে আর গোলাপী মেঘটা আমার পিছে-পিছে ফিরছিল সর্বত্র, গুলিয়ে দিচ্ছিল উত্তর দক্ষিণ শীত গ্রীষ্ম। মোট কথা, মধ্য আফ্রিকার অধিবাসী রাশিয়ায় থাকছে এটা মোটেই ঠিক নয়।
জলহস্তী আমাদের এখানে দেখা দেয় যত অপমানকর সব উপমায়: ‘জলহস্তীর মতো ধুমসো’, ‘জলহস্তীর মতো বেঢপ’, নিরেট, আকাঁড়া, মোটা-চামড়া… জলহস্তী কিন্তু আজ এই তিন দিন হল ছানি খাচ্ছে না। এখানকার ছানি ওর মুখে রোচে না। ক্লোভার ঘাস তাতে হয়ত খুব কম, আর টিমোথি ঘাস একটু তেতো। ঘোড়া গরুর অমন বাছবিচার নেই, অথচ এই মোটা-চামড়াটার আছে। চোখ তার বিষণ্ণ।
কান চুলকিয়ে দিই ওর, হাসে না। হয়ত ভাবছে তার সীমাহীন হাসিতে আমি যদি ভয় পেয়ে যাই। কিংবা হয়ত আমি তার হাসি পাবার যোগ্য নই- ওর জন্যে আমি সামান্য যেটুকু করেছি, ওর হাসিটা তার চেয়ে অনেক দামী। ওর সঙ্গে কথা বলে স্তেপান, হুকুম দেয়, সব বোঝে জলহস্তী, কথা শোনে।
‘শুয়ে পড়!’
জলে ঢেউ উঠে প্রচণ্ড ধাক্কা মারে কানায়। প্রকান্ড দেহটাকে জলহস্তী তলিয়ে দেয় জলে। সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে পড়ে যায় আর্কিমিডিসের সূত্র। একেবারে কানা পর্যন্ত জল উঠে এসেছে। কিন্তু ভাসিয়ে তোলার শক্তিটাকে দাবিয়ে রাখতে পারে জলহস্তী। এমনিতেই জোর তার অসাধারণ।
‘মাথাসুদ্ধ!’
জলহস্তীও আর নেই। একেবারে অদৃশ্য। যেন গলে গেছে। সামান্য দুলছে জল। বেশ কিছুক্ষণ পরে জলের ওপরে ভেসে ওঠে পেরিস্কোপের মতো চোখ। তারপর গোলকের মতো নাকের ফুটো। শেষ পর্যন্ত সশব্দে জল চলকিয়ে হস করে ওঠে মাথা।
‘সাবাস!’
হাসে জলহস্তী। মুখ হাঁ হয়ে যায়। ফুলে ওঠে নাকের ফুটো। খাড়া হয়ে ওঠে কান। হাসে না শুধু চোখ। সে চোখ রইল তার নিজের মনেই।
ঠিক ওই রকম এক জোড়া চোখের কথা আমার মনে পড়ল। অবিশ্যি তা মানুষের চোখ। লোকটা ছিল ভালোমানুষ, মোটাসোটা। মুখে তার বরাবর একটা দুঃখের ছাপ। দুঃখ ছিল তার বড়ো বড়ো ঢিপ-ঢিপ চোখে। গাল ছিল তার গোলাপী, কানদুটো ছোটো ছোটো…
তাহলেও জলহস্তীর চোখের রহস্য আমি ভেদ করেছি। তক্কে-তক্কে থেকে একেবারে হাতে-নাতে ধরে ফেলেছি। তার সুযোগ পেয়ে যাই যে ঘটনাটায়, সেটা স্তেপানের পক্ষে মারাত্মক হতে পারত। সাধারণ রিহার্সাল চলছিল সার্কাসে। আশ্চর্য অনায়াসে মেঘের মতো গোল দেহটার ভারসাম্য বজায় রেখে জলহস্তী ছোটো ছোটো থামের ওপর দিয়ে হেটে যাচ্ছিল। হাঁটছিল সে পায়ের দিকে না তাকিয়ে, জলহস্তীদের পক্ষে পায়ের দিকে তাকানো এমনিতেই অসম্ভব আর চোখ তার বরাবরের মতোই আছে নিজের ভাবনা নিয়ে। হে’টে যেতে সে পারত চোখ-বাঁধা থাকলেও। এরেনায় ‘গজিয়ে উঠেছে’ রবারের পাতা মেলা পাম গাছ, মাথা তুলেছে ‘পাহাড়’, পামের নিচে চরছে অ্যান্টিলোপ হরিণ।
অ্যান্টিলোপটা দেখতে এক প্রকান্ড ছোপ-ছোপ গরুর মতো, ঘোড়ার মতো সর্ মাথা তাতে লম্বা, ছাঁচলো, পাক-দেওয়া শিঙ। অ্যান্টিলোপ চরে বেড়াচ্ছে, আর কসরত অভ্যাস করছে জলহস্তী। তারপর জলহস্তী সরে গেল। সপাং করে শব্দ হল চাবুকের, অ্যান্টিলোপও চক্কর দিতে লাগল রঙ্গমঞ্চে। ছুটছিল সে হালকা লাফ দিয়ে দিয়ে, ওঠাচ্ছিল নামাচ্ছিল শিঙ, নাড়াচ্ছিল লোমের থুপি সমেত লেজ। স্তেপান তার ছুট দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে শব্দ করছিল চাবুকের। আর দূরে দাঁড়িয়ে জলহস্তী ডুবে ছিল নিজের চিন্তায়।
হঠাৎ চকে গেল অ্যান্টিলোপটা। বোঝা গেল না কেন: চাবুকের সপাঙে নাকি দরজা বন্ধের আওয়াজে। এমন চকে গেল যা শুধু অ্যান্টিলোপের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠল ক্ষিপ্ত, উদ্দাম, মরিয়া। লাফিয়ে গেল দূরে, ঝাঁপিয়ে পড়ল স্তেপানের ওপর। ভয়ঙ্কর দুই শিঙের মাঝখানে পাথরের মতো কপালের ঢং দিয়ে অ্যান্টিলোপ তাকে ঠেসে ধরল নকল পাহাড়ের গায়ে। চকা অ্যান্টিলোপের হামলাটা ঘটল এত অপ্রত্যাশিত ও এত বিদ্যুৎ-গতিতে যে কেউ বুঝে উঠতে পারল না কী ব্যাপার। স্তেপানও চুপ করে রইল। পরে বোঝা যায় যে, অ্যান্টিলোপের ঢংয়ে তার বুকে এমন চোট লাগে যে চে’চাতেও পারে নি, নিশ্বাস নিতেও পারে নি। বুনো জানোয়ারটার আরো একটা ছোট্ট ঢং খেলেই ট্রেনারের প্রাণ যেত… আর ঠিক সেই মুহূর্তেই পাশে দেখা দিল জলহস্তী। এতটুকু দেরি হয় নি এই গদাইলস্কর বিষণ্ণ-দৃষ্টি জন্তুটার। বন্ধুর বিপদ সে টের পেয়েছিল সবার আগে।
যেন এই সংকট-মুহূর্তটার কথা সে জানত, আগে থেকেই তৈরি ছিল তার জন্যে। সামান্য মাথা ঝাড়া দিলে সে, আর আটশ’ কিলোগ্রাম ওজনের অ্যান্টিলোপ ছিটকে গিয়ে পড়ল একেবারে চতুর্থ সারির আসনগুলোর ওপর। জলহস্তী ফের তার নিজের জায়গায় গিয়ে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টে।
ওর চোখের রহস্য ফাঁস হয়ে গেল আমার কাছে। বন্ধুর যাতে বিপদ না হয়, সময় থাকতেই যাতে তাকে বাঁচাতে পারে, তার জন্যই একাগ্র হয়ে থাকত সে। এই কথাই সে ভাবত সর্বদা। মানুষকে ভালোবেসে এই হয়ে উঠেছিল তার একমাত্র ধ্যান।
জানি না কেন গোলাপী রঙ ধরেছে তুষারে সূর্যাস্তের আভায় নাকি আমার মনের মধ্যে যা রয়ে গেছে সেই জলহস্তীর হাসিতে। তুষারের ওপর দিয়ে উষ্ণ হাঁটাপথ ধরে আমি চলেছি। মেঘও গোলাপী হয়ে উঠল। এক পাল মেঘ – মন্থর, বর্তুলাকার। টুপি নাড়ালাম তাদের উদ্দেশে।
Leave a Reply