উর্স আর কেট
লকড়ি-গুদামটায় উঠে উর্সে’র কাছে ঘে’ষবে এমন কোনো ছেলের কথা আমি শুনি নি। কিন্তু একটি মেয়ের কথা জানি, কেট সে এটা পারে। উর্সকে সে ভয় পায় না। কাঁটা-তারের তল দিয়ে সে ঢোকে, উর্স’ কিন্তু খোঁকিয়ে আসে না, ডাকে না।
ভাঙা-ভাঙা গলায়, কামড়ে ছোড়ে না তার ফ্রক। দু’জনের মধ্যে বেশ ভাব রোগা সরু-ঠেতে কেট আর দক্ষিণ রাশিয়ার পাহারাদার কুকুর উর্স’।
ছেলেপিলেরা বলে, কেট কী একটা মন্ত্র জানে। সেটা বাজে কথা। আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। তাতে নাক কটূচকে ওঠে তার। কেউ মিথ্যে কথা বললে সে বরাবরই নাক কোঁচকায়।
উস’ দেখতে প্রকাণ্ড। গায়ের লোম তার ঝুলে ঝুলে থাকে নোলকের মতো। কপালের নোলকগুলো পড়ে চোখের ওপর। চোখের সামনে অনবরত ওরকম নোলক দুললে নিশ্চয় দেখতে অসুবিধা হয়। কিন্তু কেট বলে, ওটা দরকার মাছি তাড়াবার জন্যে। কুকুর আর অন্যান্য জীবজন্তুর কথা কেট সবই জানে সার্কাসে জন্তুজানোয়ারের খেলা দেখাবে সে। নামটাও সে নিয়েছে সার্কাসী কায়দায় কেট। আসলে ওর নাম কিন্তু কাতিয়া।
ছেলেপিলেরা বলে, ও বেড়ে উঠেছে বনের মধ্যে, নেকড়ে-মা ওকে পালে। সে কথা ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। চুপ করে রইল। হ্যাঁ-ও বলে না, না-ও বলে না। থাকে সে মাসির কাছে, কেউ কিছু জানে না তার মায়ের কথা। বাপের কথাও। হয়ত মাসি ওকে ছিনিয়ে এনেছে নেকড়েনীর কাছ থেকে?
যে-কোনো নেকড়ের চেয়েও উর্স’ ভয়ঙ্কর। চোখ ওর ঠাণ্ডা, ভেজা-ভেজা ছেদক দাঁতগুলো আঙুলের মতো লম্বা। একবার এক চোরের প্যান্ট ছি’ড়ে দেয় সে, কামড়ও বসায় জবর। ভয়ঙ্কর হিংস্র কুকুর। কিন্তু কেট বলে সে নাকি ভারি ভালো।
আমি বলি: ভালো আবার কোথায়, যাকে খুশি তাকে টুকরো-টুকরো করে দেয় যে! কেট বলে, লোকে ওকে হিংস্র করে দিয়েছে; তেমন লোক তো আছে।
‘আচ্ছা, এমন লোক আছে যারা ওকে ভালো করে দিতে পারে?’
এক পা দিয়ে আরেক পা চুলকে কেট বললে:
‘কে জানে। হয়ত আছে।’
‘আর তুই ওকে ভালো করে দিতে পারিস না, কেট?’
কেট মাথা নাড়লে:
‘আমার সঙ্গে ওর ভাব হতে পারে। তবে অন্যের ওপর সে হিংস্রই থাকবে।’ ‘কিন্তু কী করে হিংস্র করে দিলে উর্স’কে?’
‘জানি না… হয়ত খেতে না দিয়ে।’
আমি ভাবলাম কেট চুপি-চুপি উর্দুকে খাওয়ায়, উস’ও তাই কৃতার্থ হয়ে ওকে কাছে আসতে দেয়। কিন্তু ব্যাপারটা দেখা গেল অন্যরকম। খাওয়া উর্স পেত নিয়মমতোই।
কেটের সঙ্গে আমার ভাব দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে। ওকে বসানো হয় আমার পাশেই।
জিজ্ঞেস করেছিলাম:
‘তুই কী ভাবে পড়িস, ঠোঁট নেড়ে নেড়ে নাকি আঙুল দিয়ে দিয়ে?’
‘আঙুল দিয়ে,’ কবুল করলে কেট।
‘আঙুলগুলো মুঠো করে রাখিস,’ পরামর্শ’ দিলাম আমি।
‘তুই ঠোঁট কামড়ে থাকিস,’ উপদেশ দিলে কেট।
এখন অবিশ্যি আমরা পড়ি বড়োদের মতোই চোখ দিয়ে।
কেটের নিজের কোনো কুকুর ছিল না, এমন আশাও ছিল না যে কোনো দিন হবে। উসে’র ওপর তার টান পড়ল। লকড়ি-গুদামটার কাছে গিয়ে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। উস’ কিন্তু ভ্রক্ষেপও করলে না। কেট তখন মরচে-পড়া কাঁটা-তারটার কাছে গিয়ে এমনভাবে তাতে টান মারলে যে একেবারে ঝন-ঝন করে উঠল। দুই লাফে উর্স’ এসে গেল পাশেই। লোমের নোলকগুলোর তল থেকে চক-চক করে উঠল চোখ, বেরিয়ে এল হিংস্র হলদেটে ছেদক দাঁত। গর্-গর্ করে উঠল উর্স… লাফিয়ে পালিয়ে আসতে পারত কেট, কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল সে: চওড়া-চওড়া তার হাই বুট, মুগুরের মতো পা, হাঁটুর কাছে মোজা রিপু করা। ঠান্ডায় নীল-হয়ে-আসা মুখখানা সে নিয়ে এল কাঁটা-তারের কাছেই, কথা বললে উর্সের সঙ্গে। প্রথমটা সে কান দেয় নি, গর্জে উঠল। তারপর দাঁত বন্ধ করল।
দেখা গেল কুকুরকে শুধু খাওয়ালেই হয় না, তার সঙ্গে কথাও বলতে হয়। উর্সে’র সঙ্গে কিন্তু কেউ কথা কইত না। নিজেই ভেবে দ্যাখো, পাশ দিয়ে অসংখ্য লোক চলে যাচ্ছে, কিন্তু তোমায় নজরই করছে না, কথাও বলছে না। খিদের চেয়েও এটা সাঙ্ঘাতিক। সত্যি বলছি।
উর্সে’র সঙ্গে কথা কইলে কেট। অভ্যাস নেই তো, তাই গর্জে উঠে মাথা ঘুরিয়ে নিলে উর্স। কিন্তু পরে শুনলে, কৌতূহলের বশে আর কি। কেট কী বলছে উর্স’ অবশ্য তা কিছু বোঝে নি, যে-কুকুরের সঙ্গে কেউ কথা বলে না, সে তা বুঝবে কাঁ করে। কিন্তু লম্বা-ঠেঙে কেটের গলার স্বরে সে এমন একটা কিছু টের পেলে যেটা তার জুটছিল না। শব্দ না বুঝলেও কণ্ঠস্বরটা সে বুঝেছিল। কেটের গলার স্বর ছেলেদের মতো: গাঢ়, ভাঙা-ভাঙা। কিন্তু সে গলার স্বরটা উর্সে’র পছন্দ হল, মনে ধরল। এমনকি পাশকেভাবে মাথাও নোয়ালে। কুকুর যে কথা শুনছে, আলাপ করছে, এটা তার প্রথম লক্ষণ।
লকড়ি-গুদামটা যখন খোলা থাকত, উর্স’ তখন বাঁধা থাকত শেকলে। কিন্তু গুদাম বন্ধ করার পর ও হয়ে বসত সেখানকার সর্বেসর্বা। আমার মনে হয় কেট যদি সেখান থেকে কিছু কাঠ নিতে চাইত, তাহলে উর্স’ কিছু করত না। কিন্তু কাঠে কেটের আগ্রহ ছিল না। তার আগ্রহ উসে। নোলকগুলোর ফাঁক দিয়ে তার নজরে পড়ল যে উর্সে’র চোখে পাঁজ হয়েছে।
‘বেচারি কুকুর!’ বললে কে একজন বুড়ি।
রেগে কেট চাইলে তার দিকে। বললে:
‘জন্তু-জানোয়ারকে সারিয়ে তোলার চেয়ে করুণা করা অনেক সহজ।’
কেট ঠিক করলে উর্সে’র চিকিৎসা শুরু করবে।
কাঁটা-তারের কাছে কেটের অপেক্ষায় থাকত হিংস্র কুকুরটা। আনন্দের বেলায় সব কুকুরই এক: বড়ো, ছোটো, ঝাঁকড়া, চিকন, বুড়ো, বাচ্চা আনন্দ হলে সব কুকুরই লেজ নাড়ে। কেট এলে উর্স আনাড়ীর মতো লেজ নাড়ত অনভ্যাসের ফলে আর কি। কেট অবিশ্যি ওর জন্যে এটা-ওটা নিয়ে আসত, কিন্তু অমন এক প্রকাণ্ড কুকুরের কাছে এক টুকরো সসেজ আর রুটি তো প্রায় কিছুই না। উর্স’ ওর অপেক্ষায় থাকত সসেজের জন্যে নয়।
লকড়ি-গুদামের সামনে কেট দাঁড়িয়ে রইল অনেকখন, আর বরফের ওপর বসে উর্স’ তাকে দেখছিল তার লোমের নোলকের ভেতর দিয়ে। ছেদক দাঁতের বদলে উর্স’ বার করে রেখেছিল তার জিবের প্রান্তটুকু। কাঠের গাদা থেকে বনজ সোঁদা গন্ধ উঠছিল, তার পেছ-পেছ আসছিল রজন, ব্যাঙের ছাতা, মধুর গন্ধ। আড়ষ্ট-হয়ে- যাওয়া পায়ের কথা ভুলে কেট সে গন্ধ নিচ্ছিল বুক ভরে। উর্সও। উর্সের জিবে সবুজ একটা ঘাস চোখে পড়ল তার।
তারপর হাত বাড়িয়ে দিলে কেট। অভ্যেসবশে গর্-গর্ করে উঠল উর্স’, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই লেজ নামিয়ে নিলে লজ্জায়। হাত সরিয়ে নিলে না কেট। হয়ত খুবই সে সাহসী, কিংবা খুবই ভরসা ছিল উর্সের ওপর। তার নব-আঁচড়ানো নোংরা লোমের মধ্যে হাত দিলে কেট। আরামে গা কুকড়ে উঠল কুকুরটার।
একদিন রবিবার, লকড়ি-গুদাম যখন বন্ধ, কাঁটা-তারের তল দিয়ে কেট ঢুকে পড়ল একেবারে বাঘের খাঁচায়! এগিয়ে গেল সোজা উর্সে’র কাছে। আশপাশ দিয়ে যারা যাচ্ছিল, তারা ঐ সর্-ঠেঙে বোকা মেয়েটার জন্যে ভয়ে অস্থির হয়ে চে’চামেচি লাগালে ভয়ঙ্কর উর্সে’র একেবারে খাবার নাগালে যে।
কেট কিন্তু জানত যে উস’ ভারি ভালো। তাকে সে কামড়ে টুকরো-টুকরো তো করলই না, বরং নাক নামিয়ে তার ঝাঁকড়া মুখটা ঘষতে লাগল তার পায়ে।
প্রকাণ্ড কুকুরটাকে বসিয়ে কেট তার লোম আঁচড়াতে লাগল। প্রাণপণে সে তার লোম টানছিল অমন কুকুরের লোম আঁচড়ে দেওয়া তো আর চাট্টিখানি কথা নয়!- উর্স’ কিন্তু গর্-গর্ ও করলে না, কামড়ও দিলে না। সহ্য করে গেল। বলতে কি, আরামই লাগছিল তার, কৃতার্থে’র মতো চাইছিল কেটের দিকে।
লোকে কিছুই বুঝতে পারলে না ব্যাপারটা। কেউ কেউ বললে নিয়ে আয়। কেউ কেউ বললে- ছুটে গিয়ে ওর মাসিকে খবর দে। ছটে বন্দুক
কেট ভ্রুক্ষেপও করলে না। চোখের জন্যে কাঁ একটা ওষুধ দিলে সে উর্সকে। উস’ সেটা চেটে নিলে জিব দিয়ে। আর কাঠের স্তূপগুলোর মাঝখান দিয়ে ওরা হাঁটতে লাগল পাশাপাশি উর্স’ আর কেট। বার্চ, অ্যাম্প, পাইন। বেড়াতে লাগল তারা কাটা গাছগুলোর মধ্যে, কেননা অন্য কোনো গাছ তো ছিল না।
বাড়িতে বেশ একচোট বকুনি খায় কেট। এমনিতেই বকুনি তার জোটে ঘন-ঘন। মুখ ভার করে ঘোরে সে। আর তার নামে যত গাঁজাখুরি গল্প রটিয়ে বেড়ায় ছেলেগুলো, যদিও উর্সের কাছে যেতে পারলে ওরা বর্তে যেত। গিয়ে তার এলোমেলো লোমে হাত বুলিয়ে যদি বলতে পারত: ‘ভারি ভালো কুকুরটা।’
Leave a Reply