মিথুন আশরাফ
চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি : ১৯৯৮। মনে পড়ে সেই হ্যানসি ক্রনিয়ের শিরোপা উচিয়ে ধরার কথা। আইসিসির কোন টুর্নামেন্টে দক্ষিণ আফ্রিকার সেটিই প্রথম ও একমাত্র শিরোপা জয় হয়ে আছে। সেটিই যেন শেষও!
শিরোপা জয়ের পর দক্ষিণ আফ্রিকার ওপেনার ড্যারিল কুলিনান বলেছিলেন, ‘গর্বিত। বিশ্বকাপের মতো একই মর্যাদা মনে হচ্ছে।’ মিনি বিশ্বকাপ নামও ছিল তখন। এবার যখন বিশ্বকাপ জয়েরই এত কাছে চলে গেলেন দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটাররা, তা আর ছুয়ে দেখতে পারলেন না।
সেই যে দক্ষিণ আফ্রিকা আইসিসির কোন টুর্নামেন্টে ফাইনালে উঠেছিল, এরপর তো আর কোন আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালেই খেলতে পারেনি প্রোটিয়ারা! প্রায় ২৬ বছর পর যখন কোন ফাইনালে খেলার সুযোগ মিলল, শিরোপার এত কাছে গিয়েও তীরে এসে তরী ডুবল। ইতিহাস গড়ার সুযোগ হাতছাড়া হলো। ফাইনালের মতো এত বড় ম্যাচের চাপটাই শেষে নিতে পারলেন না এইডেন মার্করামরা। তাতে করে শিরোপা জয়ের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে গেল।
ভারত ক্রিকেটাররা সেই চাপ নিখুঁতভাবে সামলে নিয়ে ৭ রানে জিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়ে ইতিহাসও গড়ে ফেলল। প্রথমবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে কোন দল অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হলো। রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা তা করে দেখালেন।
বিশ্বকাপের ফাইনালে এরআগে কখনোই খেলেনি দক্ষিণ আফ্রিকা। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দলে থাকা দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটাররা তো বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ কি, তা কোনদিন পরখ করেই দেখতে পারেননি! এবার শিরোপা জয়ের স্বপ্নের এত কাছে গিয়েই গোলমাল বেঁধে গেছে। শেষে গিয়ে এমন ছন্নছাড়া হয়ে পড়েছেন মিলাররা যে রানার্সআপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে।
বিরাট কোহলি ফাইনালের আগ পর্যন্ত টুর্নামেন্টজুড়ে বাজে ব্যাটিং করলেন। যেই স্নায়ুচাপের ম্যাচ আসলো, জাত চিনিয়ে দিলেন। কথায় আছে, ফর্ম ইজ টেম্পোরারি, ক্লাস ইজ পারমানেন্ট। বিরাট কোহলি তা যেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে দেখিয়ে দিলেন। শুরুতে ৫ ওভারের আগেই ৩৪ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর বিপদে পড়ে ভারত। সেখান থেকে নিজেকে সামলে নিয়ে ৭৬ রানের অসাধারণ ইনিংস উপহার দিলেন।
ভারত ৭ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৭৬ রান করে ১৭৭ রানের লক্ষ্য ছুড়ে দিল। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটাররা যেভাবে ব্যাটিং করছিলেন, তাতে মনে হয়েছে শিরোপা জিততেই তারা ফাইনালে নেমেছিল। ১৭.৪ ওভারেই ১৫৬ রান হয়ে গিয়েছিল। তৃতীয় উইকেটে কুইন্টন ডি কক ও ট্রিস্টান স্টাবস মিলে ৫৮ রানের, চতুর্থ উইকেটে ডি কক ও হেনরিক ক্লাসেন মিলে ৩৬ রানের ও পঞ্চম উইকেটে ডেভিড মিলার ও ক্লাসেন মিলে ৪৫ রানের জুটি গড়লেন। কিন্তু ম্যাচের শেষ তিন ওভারেই যত গন্ডগোল লাগলো।
বার্বাডোজের ব্রাইটনের কেনিংটন ওভাল স্টেডিয়ামে একদিকে ভারতের ফ্যানদের উত্তেজনা, চিৎকার। আরেকদিকে ম্যাচ জেতার এত কাছে চলে যাওয়ার হৃদস্পন্দন। কুলিয়ে উঠতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকান ব্যাটাররা। সব মিলিয়ে আসলে শেষে গিয়েই সব ওলট-পালট হয়ে যায়।
তিন পেসার জাসপ্রিত বুমরাহ, আর্শদীপ সিং ও হার্দিক পান্ডিয়া এক এক করে শেষ ৩টি ওভার এমনই করলেন, দক্ষিণ আফ্রিকানদের স্বপ্ন ধুলিস্মাৎ হয়ে গেল। ১৮ বলে জিততে ২২ রান লাগে, এখান থেকেই দক্ষিণ আফ্রিকার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যাওয়া এবং ভারতের ২০০৭ সালের পর আবার দ্বিতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আশা জাগে। ভারতের শিরোপা জেতার আলো নিভে যাচ্ছিল, এমন সময়েই স্নায়ুচাপের আসল সময় শুরু হয়। তাতে ভারতই বাজিমাত করে।
জাসপ্রিত বুমরাহ এসে ১৮তম ওভারে ২ রান দিয়ে ১ উইকেট শিকার করেন। আর্শদীপ ১৯তম ওভার করতে এসে মাত্র ৪ রান দেন। শেষ ওভারে, শেষ ৬ বলে জিততে যখন ১৬ রান দরকার, হার্দিক পান্ডিয়া প্রথম বলেই ডেভিড মিলারকে (২১) আউট করে দেন। সূর্যকুমার যাদব বাউন্ডারি থেকে এমনভাবে ক্যাচটি ধরলেন, সেখানেই ভারত জয়ের সুবাতাস পেয়ে যায়। শেষে আরও একটি উইকেট নিয়ে ৮ রান দেন পান্ডিয়া। ৮ উইকেট হারিয়ে ২০ ওভারে ১৬৯ রান করতে পারে দক্ষিণ আফ্রিকা।
দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য আসলে কষ্টই হয়। দলটি ৫০ কিংবা ২০; কোন বিশ্বকাপেরই ফাইনালে এরআগে খেলেনি। প্রথমবার খেলেছে। বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার যোগ্যতা এবারও হয়নি। ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে ৫ বার এবং ২০ ওভারের বিশ্বকাপে ৩ বার সেমিফাইনাল খেলেছে। দুই বিশ্বকাপ মিলিয়ে মোট ৮ বার ফাইনালে ওঠার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারেনি। তাতেই তো চোকার্স খেতাব মিলে গিয়েছিল। এবার ফাইনালে উঠেছে। চোকার্স থেকে মুক্তি মিলেছে। কিন্তু শিরোপা আর উচিয়ে ধরতে পারেননি দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেটাররা।
ভারত সেই দিক থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। বিশ্বকাপ হিসেব করলে তিনবার শিরোপা ঘরে তুলেছিল। দুইবার ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে (১৯৮৩, ২০১১ বিশ্বকাপে) ও একবার ২০ ওভারের বিশ্বকাপে (২০০৭ সালে প্রথম বিশ্বকাপে) শিরোপা জিতেছিল। এবার ৫০ ও ২০ ওভার মিলিয়ে চারবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হলো ভারত। কপিল দেব (১৯৮৩, ওয়ানডে বিশ্বকাপ), মহেন্দ্র সিং ধোনির (২০১১ ওয়ানডে বিশ্বকাপ, ২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ) পর রোহিত শিরোপা জিতলেন। ২০১৪ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ফাইনালে খেলেছিল ভারত। কিন্তু শিরোপা জিততে পারেনি। আর ওয়ানডে বিশ্বকাপে গত আসরসহ চারবার ফাইনালে খেলে দুইবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। এবার সেই স্বাদ অনেকদিন পর আবার পূরণ হলো। ২০১৩ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতার পর আর কোন আইসিসির আসরে চ্যাম্পিয়ন হতে পারেনি ভারত। এবার সেই শিরোপা খড়াও ঘুচলো ভারতের।
অবশ্য ফাইনালে দক্ষিণ আফ্রিকা কুলিয়ে উঠতে নাও পারে, সেই ধারণা জন্মেছিল। কারণ, প্রথম রাউন্ড, সুপার এইট কিংবা নক আউটে যে দক্ষিণ আফ্রিকার নৈপুন্য খুব ভালো ছিল না। প্রথম রাউন্ডে নেদারল্যান্ডসের সাথে ১৮.৫ ওভারে গিয়ে জিততে হয়েছে। বাংলাদেশের বিপক্ষে ৪ রানে জিতে। নেপালের বিপক্ষেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ১ রানে জিতে। সুপার এইটে যুক্তরাষ্ট্রকেও ৭ রানে হারায়। সেমিফাইনালে তো আফগানিস্তানকে পায় দক্ষিণ আফ্রিকা। হারিয়ে ফাইনালে ওঠে। ভারতের মতো দলকে প্রথমবার পায়। আর তাতেই কাঁত হয়। তাও আবার সেই ম্যাচটি ফাইনাল ম্যাচ।
ভারতের উজ্জ্বল সম্ভাবনা ছিলই। প্রথম রাউন্ডে পাকিস্তানের সাথে শুধু ৬ রানে জিতে। এই একটি ম্যাচই একটু কষ্ট করে জিততে হয়। এরপর আর কোন ম্যাচেই চাপে পড়েনি। দাপটেই জিতেছে। সুপার এইটে অস্ট্রেলিয়ার মতো দলকে ২৪ রানে হারানোর পর সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৬৮ রানে হারিয়েছে। শক্তিশালী দলকে হারিয়ে ফাইনালে খেলেছে ভারত। তাই ফাইনাল ম্যাচের স্নায়ুচাপ সামলে নেওয়ার ক্ষমতাও আছে। তাছাড়া ভারতের বর্তমান দলের বেশিরভাগ ক্রিকেটারই আইসিসি টুর্নামেন্টের ফাইনালে খেলার অভ্যাস আছে।
২০০৭ সালে প্রথম টি২০ বিশ্বকাপের শিরোপা যখন জিতে ভারত, সেই দলের রোহিত তো এবার অধিনায়ক হিসেবে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদও পেলেন। ২০১৪ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের যে দলটি খেলেছিল, সেখান থেকে রোহিত, কোহলি, রবীন্দ্র জাদেজা এবারও খেললেন। ২০১৩ সালে ভারত সবশেষ যখন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জিতে, সেই দলের রোহিত, কোহলি, জাদেজা এবারও আছেন।
২০১৭ সালে সবশেষে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালের দল থেকে তো রোহিত, কোহলি, পান্ডিয়া, জাদেজা, বুমরাহ আছেন। গতবছর ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনালের দল থেকে রোহিত, কোহলি, জাদেজা, বুমরাহ, সূর্যকুমার যাদব, কুলদীপ যাদব আছেন। ফাইনালে খেলার অভিজ্ঞতা ভারত ক্রিকেটারদের ভালোই ছিল।
সেই তুলনায় দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটাররা প্রথমবার কোন বিশ্বকাপের ফাইনালে খেললেন। এই দক্ষিণ আফ্রিকান দলটির ক্রিকেটাররা তো কোনদিন আইসিসি টুর্নামেন্টের কোন ফাইনালই খেলেননি। আর এখানেই মাত খেয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। শুরু ও মাঝে ভালো খেললেও শেষে চাপ সামলে নিতে পারেনি। এখানেই বাজিমাত করেছে ভারত। তাতে চ্যাম্পিয়নও হয়েছে।
Leave a Reply