আবু ইসহাক
পরীক্ষার খাতায় পঁয়ত্রিশ নম্বর আর পঁয়ত্রিশ টাকার চাকরি-এই ছিল হানিফের চরম আকাঙ্ক্ষা।
থার্ড ডিভিশনে ম্যাট্রিক পাস করল হানিফ। আকাঙ্ক্ষার প্রথমটা পূর্ণ হল। আর দ্বিতীয়টা খাবি খেয়ে মরতে লাগল। ঝাড়া দুটো বছর ধরে কত যে চেষ্টা তদবির করল সে, কতজনের দুয়ারে ধর্ণা দিল, কিন্তু পঁয়ত্রিশ টাকার একটা চাকরি জুটল না। সে বুঝতে পারল, তার আকাঙ্ক্ষা আর পূর্ণ হবার নয়। অগত্যা বিশ টাকা মাইনের প্রাইমারী স্কুলের মাস্টারী নিল সে। কোন গতি নেই যার, সেই হয় মাস্টার।
পাঁচ বছর পরে চাকা ঘুরল। হানিফেরও কপাল ফিরল। যুদ্ধের ডামাডোলের বাজারে জুটে গেল একটা কেরানিগিরি। পঁয়ত্রিশ টাকা মাইনে, আঠারো টাকা মাগী ভাতা। দিব্যি চাকরি, কিন্তু সম্পূর্ণ অস্থায়ী। যে কোন সময়ে বিনা কারণে, বিনা নোটিশে ছাঁটাইয়ের সম্ভাবনা। কিন্তু তাতে ঘাবড়াবার কি আছে? জীবনটাই তো অস্থায়ী। আর বজ্র যখন আঘাত হানে, তখন কি নোটিশ দেয়, না কারণ দর্শায়?
হানিফের আকাঙ্খা পূর্ণ হল। তবে কিনা তিন টাকা মনের চালের দাম হয়েছে তিরিশ টাকা, আর এক টাকার শাড়ির দাম হয়েছে দশ টাকা। অন্যান্য জিনিসের দামও বেড়েছে এই হারে। তবুও সে পরিতৃপ্ত। সাফল্যের আনন্দে সে মানতের তিন টাকা পাঠিয়ে দেয় খাজা বাবার দরগায়।
মানুষের আকাঙ্ক্ষার শেষ নেই বলে নাকি মানুষ সুখী নয়। তাকে পৃথিবীর অর্ধেক দিয়ে দিলেও নাকি সে খোঁজ করবে-বাকী অর্ধেক কোথায়? জীবনে সুখী হওয়ার জন্যে তাই অনেক সাধ্যসাধনা করে হানিফ আকাঙ্ক্ষা দমনের অনেক কৌশল আয়ত্ত করেছে। হানিফ বিয়ে করেছে সাত বিল তেরো খাল পেরিয়ে এক অজ পাড়াগাঁয়ে। ‘ক’- জানে না করিমন তার স্ত্রী। কিন্তু নিরক্ষর হলে কি হবে, তার গুণের কথা বলে শেষ করা যায় না। গুণের কথা তুলতেই কেউ হয়তো তাকে জিজ্ঞেস করে বসবে, পোলাও- কোর্মা রাঁধতে জানে?
উত্তরে সে বলবে, না, তা জানে না। পোলাও-কোর্মা আমাদের পকেট খালি ও পেট খালাস করে দেয়। তাই ভেবে আমার স্ত্রী তা রাঁধতে শিখেনি। তবে গুঁড়ামাছ, শাক, ডাল আর ভাত রান্নায় সে দক্ষহস্ত। মিলের মোটা শাড়ি তালি দিয়ে পরতে অভ্যস্ত। স্বামীর খেদমতে সর্বক্ষণ ব্যস্ত, কারণ তার পায়ের তলায় নাকি বেহেস্ত। মাসের শেষের দিকে নুন-ভাত খেয়েও তৃপ্ত। মিতব্যয়িতার বুদ্ধিতে দীপ্ত। ম্যালেরিয়া জ্বরে না হয় জব্দ। স্বামীর কটু কথায় না করে শব্দ।
এমন গুণবতী স্ত্রীকে বোরখা মুড়ি দিয়ে রেল-ষ্টীমারের পুলসেরাত পার করে হানিফ ঢাকা নিয়ে এলো। সাথে তিনটে ছেলে-মেয়ে। নাজিরা বাজারের এক ঘুপচি গলির শেষে, নর্দমার পাশে, খানদানী দেয়ালের বেষ্টনীর মধ্যে একটা কোচোয়ানী কুঁড়েঘর তার বাসা। ভাড়া দশ টাকা।
স্ত্রী খুশী। কারণ এহেন বাসায় তার পর্দার কোনরূপ বরখেলাপ হবে না। আর বাচ্চাকাচ্চাদের গায়ে বাও-বাতাস লেগে অসুখ করবে না।
হানিফ মহাখুশী। কারণ, বেনারসী, জামদানী, ক্রেপ, জর্জেটের ঝলমলানি আর সোনা গয়নার চকমকানি তার স্ত্রীর চোখে জ্বালা ধরাবে না। এসেন্স আর সুবাসিত তেলের সুগন্ধ নর্দমার দুর্গন্ধ ছাপিয়ে তার নাসারন্ধ্রে প্রবেশ করবে না। রুজ-লিপষ্টিক দূরের কথা, হেজলিন-পমেডের অস্তিত্ব আবিষ্কৃত হবে না কোন দিন। বিজলি বাতির আলো চোখ ধাঁধাবে না। সিনেমার বিজ্ঞাপন অনধিকার প্রবেশ করবে না। আর রেডিওর গান শরীয়ত বরবাদ করবে না। অল্প কথায় বলতে গেলে খানদানী দেয়াল বেষ্টিত করিমনের দুনিয়া আধুনিক বিজ্ঞানের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে। চার দেয়ালের মাঝে তাঁর আকাঙ্ক্ষার ঘোড়া স্বচ্ছন্দে চরে বেড়াবে। চার দেয়ালের মাঝেই থাকবে তার ‘সব পেয়েছির দেশ।’
হানিফের সংসার যাত্রা শুরু হল। কিন্তু ফেরিওয়ালারা তার বাজেট ঘাটতির ফিকির করলে যে। সে অফিসে গেলেই এদের আনাগোনা শুরু হয়। ছেলে-মেয়েদের চানাচুর, আইসক্রীম, বিস্কুট, লজেন্স, চরকি, বেলুন দিয়ে রোজ কম-সে কম চার গণ্ডা পয়সা নিয়ে যায়।
আয়ের একটা বিরাট অংশ এভাবে বাজে খরচ হবে, এটা বরদাস্ত করতে পারে না হানিফ। অনেক মাথা খাটিয়ে শেষে একটা ফন্দি বার করে সে। স্ত্রী ও ছেলে-মেয়েদের বেশ কায়দা করে বুঝিয়ে দেয়, ফেরিওয়ালারা সব ছেলে-ধরা সুযোগ পেলেই ধরে নিয়ে পালাবে।
ফন্দিটা তার কাজে লেগে গেছে। ফেরিওয়ালা তাদের লোভনীয় হাঁকডাকেও আর ছেলে-মেয়েগুলোকে কাছে ভিড়াতে পারে না আজকাল। তাদের হাঁক শুনলেই ওরা এখন ওদের মা’র বুকে এসে লুকোয়।
চাকরির প্রথম কয়েক মাস কোথায়, কিসে, কেমন করে কত খরচ করা দরকার ঠাহর করে উঠতে পারেনি হানিফ। তাই প্রত্যেক মাসে তার কিছু কিছু দেনা হতে লাগল। এ দেনার হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে ব্যয় সঙ্কোচ করা জরুরী হয়ে পড়ল। খরচের খাতা হাতড়ে সে দেখে-বুড়ো বাবা ও মাকে মাসে মাসে যে পনেরো টাকা পাঠায়, সেটাই একমাত্র বাজে খরচ। এ টাকা ক’টা না পাঠালে তার সংসারে টান-তাগাদা আর থাকবে না। শেষে তাই করে সে। বিবেক অবশ্য প্রতিবাদ করেছিল, চোখ রাঙিয়ে বার বার বলেছিল, তোমার কর্তব্য ভুলে যেও না। বাবা-মা তোমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছেন। তাঁদের ঋণ শোধ কর।
বিবেকের ওপর পাষাণ চাপা দিল হানিফ। কারণ তার অভিজ্ঞতা থেকে সে বুঝেছে, বিবেককে হত্যা না করলে কোন দিন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়া যায় না। যার বিবেক যত বেশি সজীব, এ সংসারে সে-ই তত বেশি দুঃখ পায়, দারিদ্র্যের লাঞ্ছনা ভোগ করে।
দুধের কথা ছেলে-মেয়েরা ভুলে গেছে কারণ অনেক দিন আগে থেকেই দুধ কেনা ছেড়ে দিয়েছে হানিফ। বারো আনা এক টাকা সেরের দুধ। মাথা পিছু এক পো করে কিনলেও মাইনের অর্ধেক নিয়ে টান দেবে। স্ত্রী মাঝে মাঝে অনুযোগ করে। তাকে সে বুঝিয়ে বলে, তিন পো পানিতে এক পো দুধ, তার সের এক টাকা। পয়সা দিয়ে পানি কিনতে যাব, এত বোকা হয়েছি আমি? ভাতের ফেন এর চেয়ে অনেক বেশি পুষ্টিকর। অনেক ভিটামিন আছে তাতে।
বড় দুটোকে ফেনই দেয়া হচ্ছিল। আর কোলেরটাকে চালের গুঁড়োর মণ্ড। ফেন দিয়ে ভাত মেখে মজিদ ও জমিলা যখন পরম তৃপ্তির সাথে খায়, তখন হানিফ চেয়ে দেখে আর ভাবে, তার কোন অভাব নেই। সে সুখী।
ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার জন্যে হানিফ একটুও ভাবে না। বড় ছেলে-মেয়ে দুটো ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে পড়ছে। সরকারী খরচে নাম আর নামতা গোনা পর্যন্ত শিখলেই হল, তার বেশি নয়। তার বেশি পড়বার খরচ যোগাতে পারবে না-সে জানে। তথাপি এটাকে কারণ বলে স্বীকার করতে রাজী নয় সে। কারণ হচ্ছে-বেশি পড়লেই ছেলেগুলোর চোখ খুলবে, ভ্রু কুঁচকাবে, বড় চাকরির দূরাকাঙ্ক্ষা করবে। কোন মতে একটা বড় চাকরি যদি জুটে যায় কারো, তবে তার আকাঙ্ক্ষার পাখি খুশিমত উড়তে না পারলে খালি হায়-আফসোস করবে-অমুকের তমুক জিনিসটা আছে, তার কেন থাকবে না? অমুকে সর্বাধুনিক মডেলের তমুক জিনিসটা কিনেছে, তার জিনিসটা বড্ড কদাকার। অমুক জিনিসটা না হলে ইজ্জত বাঁচে না।
এসব ভোগ-বিলাসের ‘রেস’ খেলায় অঢেল টাকার দরকার। মাইনের টাকায় পোষাবে না। তাই বলে টাকার কি আর অভাব আছে? টাকারা তো ‘কিউ’ দিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। কলমের খোঁচায় পথ তৈরি হলেই তারা সুড়-সুড় করে চলে আসবে। আর যদি কম মাইনের চাকরি জোটে, তবে মান-মর্যাদা বজায় রাখবার জন্যে অথবা বাজারদরের সাথে তাল মেলাবার জন্যে তাকেও কলমের খোঁচার কলা-কৌশল শিখতে হবে, আর বাঁ হাত বাড়াতে হবে টেবিলের তলা দিয়ে। তারপর হয়তো কোনদিন দুর্নীতি- দমন বিভাগের দাওয়াত নিয়ে লাল-ঘরের অতিথি হবে। তাই, হানিফের মত হচ্ছে- অধিক বিদ্যা ভয়ঙ্করী, অল্প-বিদ্যা শুভঙ্করী।
সমাজের উঁচু স্তরের লোকেরা কোথায় থাকেন, কি খান এ সব হানিফ খোঁজ করে না। কারণ তাঁদের বপু আর তার তনু এক নয়। তাঁদের ভুঁড়ির জুড়ি তার পেটের পটুতা নয়। তার জিভ তাঁদের রসনার মত রসিক নয়। এ জন্যই সে তার কৌতূহলকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ সে বুঝে নিয়েছে-কৌতূহলী মন বিকারগ্রস্ত।
হানিফ আরো বুঝে নিয়েছে-অভাবের অনুভূতি একটা রোগ বিশেষ। তাই কোটের বদলে কাঁথা, কোঠার বদলে কুঁড়ে, গাড়ির বদলে গাড়ির টায়ারের স্যান্ডেল পেয়েও সে সুখী। যদি কচিৎ কখনো তার স্ত্রীর মুখ দিয়ে কোন অভাবের কথা শোনা যায়, তখন তাকে মহাপুরুষদের অনাড়ম্বর জীবন-যাপনের কাহিনী শোনায় সে। স্ত্রীর মুখ দিয়ে আর টু শব্দটি বার হয় না। স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রী-ই বটে। হানিফের সংসার ভালো ভাবেই চলছে। সে অফিসে দশটা-পাঁচটা করে, আর তার স্ত্রী বাসায় পাঁচটা-দশটা করে। খুশির খবর এই যে, পে কমিশন-এর সুপারিশে বিশ টাকা মাইনে বেড়েছে। আরো খুশির খবর, এই বিশ টাকার ভাগীদারও দুটি এসেছে।
মুন্সিগঞ্জ ৬ পৌষ, ১৩৫৮ ডিসেম্বর, ১৯৫১
Leave a Reply