শ্রী নিখিলনাথ রায়
নবাবের প্রকোঠমধ্যে রুদ্ধ হওয়ায় কথা শুনিয়া, ভিন্ন ভিন্ন স্থান হইতে তাঁহার সমস্ত অনুচরবর্গ আসিয়া তথায় উপস্থিত হইলেন। সিরাজ তাঁহাদিগকে দেখিয়া বলিলেন যে, এই সকল জমীদার ও জমীদারদিগের প্রতিনিধির নিকট হইতে একটি করের ব্যবস্থা করা হউক। নবাব সন্তুষ্টচিত্তে তাহাতে সম্মত হইয়া হীরাঝিলের প্রাসাদের জন্য যে কেবলই কর নির্দেশ করিলেন এমন নহে, কিন্তু সিরাজের জন্য একটি গঞ্জও স্থাপন করিহা দিলেন। কথিত আছে, এই সময়ে ৫, ০১, ৫৯৭ টাকার আবওয়াব আদায় হয়। সিরাজের মনসুর উল মোক উপাধি হইতে প্রাসাদের নাম মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ এবং নবস্থাপিত গঞ্জটিও মনসুরগঞ্জ আখ্যা প্রাপ্ত হয়। যে স্থলে গল্পটি স্থাপিত হইয়াছিল, তাহাকে অস্থাপি মনসুরগঞ্জ বলিয়া থাকে। দেশীয় • গ্রন্থকারগণ সিরাজ উদ্দৌলার প্রাসাদকে মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। কিন্তু ইউরোপীয়গণ সাধারণতঃ তাহাকে হীরা- ঝিলের প্রাসাদ বলিতেন।
হীরাঝিলের প্রাসাদ নির্মাণ হইলে, যুবরাজ সিরাজ মুর্শিদা– বাদে অবস্থানকালে সেই কাল অতিবাহিত করিতেন। কেল্লার মধ্যে থাকিলে বিলাসোপভোগের তারশ সুবিধা হইত না বলিয়া, হীরাঝিলের প্রাসাদে বাস করাই তাহার একটি প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তথায় তাঁহার সমস্ত জীবন অতিবাহিত হয়। তিনি নবাব হইলেও, কেল্লা পরিত্যাগ করিরা, বনহুরগরে মসনর স্থাপনপূর্ব্বক রাজকার্য নির্ব্বাহ করিতেন। তাহার পর রাজাচ্যুত হইয়া, তিনি কিয়ৎপরিমাণ সম্পত্তি লইয়া, প্রিয়তমা মহিষী লুংফ উন্নেসার সহিত ১৭৫৭ খৃঃ অব্দের ২৪শে জুন শুক্রবার রাত্রিতে সাধের হীরাঝিলের প্রাসাদ পরিত্যাগ করিয়া, মুর্শিদাবাদ হইতে পলায়ন করিতে বাধ্য হন। তৎপরে আর সিরাজকে হীরাঝিলের প্রাসাদে পদার্পণ করিতে হয় নাই। ধৃত হইয়া তিনি মুর্শিদাবাদে আনীত ও জাফরাগজে নিহত হন।
সিরাজ উদ্দৌলার পলায়নের পূর্ব্বেই মীরজাফর পলাশীপ্রান্তর হইতে আসিয়া মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন। সিরাজের পলায়নের কথা শুনিয়া, তিনি মনসুরগঞ্জের প্রাসাদ অধিকার করেন। কিন্তু ক্রাইবের আগমনের পূর্ব্বে মসনদে উপবিষ্ট হন নাই। ক্লাইব পলাশী হইতে প্রথমে দাদ- পুরে, পরে বহরমপুরের নিকট মাদাপুরে শিবির সন্নিবেশ করেন। তাহার পর ২৯শে জুন পর্যন্ত কাশীমবাজারে অপেক্ষা করিয়া, ঐ দিবস মুর্শিদাবাদে উপস্থিত হন। হীরাঝিলের উত্তর মোয়াদবাগে, তাঁহার বাসস্থান নির্দিষ্ট হয়।
মোরাদযাগ হইতে ক্লাইব মনসুরগঞ্জের প্রাসাদে মীরজাফরের সহিত সাক্ষাৎ করিতে গমন করেন। মনহরগঞ্জের প্রাসাদের দরবারগৃহের উত্তর দিকে বিশাল নবাবী মসনদ স্থাপিত ছিল; সিরাজ সেই মসনদে বসিতেন। ক্লাইব মীরজাফরের হস্ত ধারণ করিয়া মসনদের উপর উপবেশন করাইয়া, নুতন নবাবকে এক পাত্র মোহর নজর প্রদান করিলেন। পরে অন্ত্যান্ত ইংরেজ ও দেশীয় কর্মচারী এবং সম্ভ্রান্ত জনগণ তাঁহাকে যথারীতি নজর প্রদান করিলে, মীরজাফর সমস্ত নগরে বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব বলিয়া বিঘোষিত হইলেন। মীরজাফরের মসনদে উপবেশন করার পর, হীরাঝিলের প্রাসাদস্থিত সিরাজ উদ্দৌলার ধনাগারলুণ্ঠনের ব্যবস্থা হইল।
Leave a Reply