শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৬ অপরাহ্ন

ওকে গাইতে দাও (পর্ব-৭)

  • Update Time : সোমবার, ১ জুলাই, ২০২৪, ৮.০৪ পিএম

মণীশ রায়

তুষ্টির একমাত্র বিনোদনের জায়গা এই ছাদবাগান।

সুযোগ পেলেই সে ছুটে আসে এখানে। টবে বেড়ে ওঠা  প্রিয় দুটো যেন ওর অপেক্ষাতেই প্রহর গোনে। দেখা হলেই তাদের ভেতর কথা বলা শুরু হয়ে যায়। এভাবে কতক্ষণ যে কেটে যায় তুষ্টি নিজেও তা জানে না।

ছয়তলার ফ্ল্যাট-মালিকের লাউ-মাচা রয়েছে এই ছাদবাগানে। সেই মাচার ফাঁকে-ফোঁকরে সাদা লাউফুল উঁকি মারছে। তুষ্টির ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটে লাউফুলের দিকে তাকিয়ে। ওর যে কী ভালো লাগে। নীরব অথচ  প্রাণবন্ত, বাতাস পেলেই মাথা নাড়ায়। মনে হয় খিলখিল করে হাসছে সারাক্ষণ।

লতানো এই  লাউ-মাচাটি বড় আপন ওর। পাশে দাঁড়ালে শরীরের রন্ধ্রে-রন্ধ্রে অজানা সুগন্ধির মতো সুখ ছড়িয়ে পড়ে। একটি ডাগর লাউফুল বাতাসের দোলায় সহসা এলিয়ে পড়ে ওর মুখে-চোখে ; মনে হলো, ওর স্বর্গীয় ঠাম্মা যেন গল্প বলতে বলতে পরম মমতায় ওর  মুখে-চোখে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

এখন  ঠাম্মা জীবিত নেই ; কবেই মারা গেছেন ; ব্রাম্মণবাড়িয়ার কালিকচ্ছ গ্রামে বাড়ি-ঘরও কিছু  নেই ;  সেসব বিক্রির টাকায় কেনা এ ফ্ল্যাট। বড়োদের মুখে সেই গল্প বারবার করে শুনেছে তুষ্টি। কিন্তু এই লাউমাচাটা ওকে ঠিকই ঠাম্মার কাছে নিয়ে যায় প্রতিদিন। ফিরিয়ে দেয় আগলে রাখা সেসব সংগোপন আদুরে সব স্মৃতি।

তাছাড়া নিজেদের ডালিম আর লেবুগাছের টব দুটি তো আছেই। সেদিকে তাকালেও সময় কেটে যায় ফুরফুরে হাওয়ার মতো।

কবেই শীত চলে গেছে। ফাগুন হাওয়া হালকা তাপ ছড়াচ্ছে চারপাশে। পাতাঝরা ন্যাড়া গাছগুলো ধীরে ধীরে নিজেদের সৌন্দর্য ফেরত পাচ্ছে । এরই সুবাস ও মাদকতা গাছেদের অন্তরে-বাহিরে।

ইদানীং আরও একটা আকর্ষণ যোগ হয়েছে ওর জীবনে। বিকালের দিকে  পাশের ছতলা বাড়ির ছাদে  অপরিচিত ছেলেটার উপস্থিতি। ওরা ভাড়া থাকে দোতলায়। ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকা যেন ছেলেটার নিত্য অভ্যাস। কেমন বোকা বোকা দৃষ্টি। চোখে চশমা। মাথাভরা এলোমেলো চুল। ফাগুন হাওয়ায় লাউলতা যেরকম করে শিরশির করে ওঠে, ছেলেটির ওপর দৃষ্টি পড়লে তুষ্টিরও সেরকম লাগে।  ছেলেটা এভাবে তাকায় কেন  ওর দিকে?

একদিন ছেলেটা বেশ সাহসী হয়ে ওঠে ; গলা ফাটিয়ে ওর কাছে মোবাইল নম্বরটা চায়।

ছেলেটার নাম অর্ঘ্য। মতিঝিল সরকারী কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র।  রবোটিক ইঞ্জিনীয়ার হবার স্বপ্ন ভবিষ্যতে। সেভাবেই  নিজেকে তৈরি করছে সে। কথা বলে মিষ্টি করে। মোট দুদিন আলাপ হয়েছে ওর সঙ্গে মোবাইলে। দুদিনেই অর্ঘ্য ওকে স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে, তুষ্টিকে ওর ভালো লাগে।

নিজের নম্বরটা ওকে দিতে চায়নি তুষ্টি। ভাড়াটে বাসার ছেলেদের কে বিশ্বাস করে ? কিন্তু অর্ঘ্যকে মোটেই সেরকম বলে মনে হলো  না।

কদিন ভেবেচিন্তে শেষপর্যন্ত দিয়েই দিল নিজের নম্বরটা। ওর নিজের কোনো মোবাইল নেই। এটা ওর মায়ের। মোবাইল নিয়ে মায়ের কোনো আদিখ্যেতা নেই। তাই এটি বলতে গেলে অনাদরে-অবহেলায় এখানে-সেখানে পড়ে থাকে। তুষ্টি-সৃষ্টির কোচিং কিংবা স্কুলের এসএমএস ছাড়া আর কিছু জমা হয় না এর ভেতর।

মাঝে মাঝে অর্ঘ্য এই মোবাইলটায় রিং দিয়ে বসে। কখন ওর রিং আসবে তা নিয়ে সদা সন্ত্রস্ত থাকে তুষ্টি। কেবলি ধরা পড়ার ভয়।

ছাদে মুখোমুখি হলে প্রথম প্রশ্ন ওর,‘পড়াশুনো ক্যামন হচ্ছে ?’ হাতে ধরা ট্যাবটায় দৃষ্টি। একনাগাড়ে কী যে করছে Ñ দূর থেকে বোঝা দায়। হয়তো মজার কোনো গেম নিয়ে ব্যস্ত।

সে মাথা নাড়ে। মনে হয়, অর্ঘ্যর জন্যে আজ থেকে সে মনোযোগী হবে। কিন্তু পড়ার টেবিলে বসলেই নানারকম কথা মনে পড়তে শুরু করে। তখন  লেখাপড়া করতে আর ভাল লাগে না।

অর্ঘ্য একদিন ওকে বলে উঠল,‘তোমাকে কিন্তু ডাক্তার হতে হবে।’

তুষ্টি মাথা নাড়ে। ছাদের কার্নিশে ঠেস দিয়ে উত্তর দেয়,‘আমি ভাল ছাত্রী নই, ভাইয়া।’

‘পড়াশুনো করো মন দিয়ে।’

‘পড়াশুনা করলেও পারব না ডাক্তার হতে। আমার মাথায় গোবর। হিহিহি।’

‘আমি রাতে ফোন দেব। কথা হবে। ’

একথায় আঁতকে ওঠে তুষ্টি। যদি বিষয়টা মা কিংবা সৃষ্টির নজরে আসে তো ওর মান-সম্মান বলে কিছু থাকবে না ওদের পরিবারে।

সে তীব্রভাবে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানায় এ প্রস্তাবে।

‘কেন ? কোন সমস্যা ?’

‘হ্যা।’ বলেই সে ছুটে পালিয়ে যায়।

আনন্দটুকু থেকে যায় বুকের ভেতর। তখন পড়াশুনা আরও বিস্বাদ লাগে। কেবল ভাবতে ইচ্ছে করে আর ডাক্তার হতে চায় মন। সাদা এ্যাপ্রন পরে লম্বা করিডোর দিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে। নাকের ডগায় চশমা। গলায় স্টেথো। হাতে প্রেশার-মেশিন। চারপাশের সবাই নিশ্চুপ। চোখ ভরা সমীহের দৃষ্টি।

সে কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা লিফটে উঠে পড়ল। সবাই জায়গা ছেড়ে দিল। একটা অন্যরকম অনুভূতি। সে এরকম একটা দৃশ্যই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে।

সহসা মা এসে বকা দিয়ে ওঠে,‘সামনে বই রেখে কি ধুনতেছিস ? এই ভাবে পড়লে ফেল মারবি। কইয়া দিলাম। ’

তবু ওর ঘোর ভাঙে না। ডাক্তার হয়ে পাশের বাড়ির ভাড়াটে ছেলেটাকে দেখিয়ে দিতে ইচ্ছে করে খুব। কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কণ্ঠে কিছুটা অহংকার মিশিয়ে বলতে চায়,‘এই যে আমি ডাক্তার হয়েছি। এটা আমার জন্য কোন ব্যাপার না। ’

সৃষ্টি ওকে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে। কিছু একটা পরিবর্তন ঠাহর করার চেষ্টা করে।

বোনের কৌতূহলী দৃষ্টির সামনে সে বিব্রত হয়ে পড়ে। কি করলে যে নিজেকে লুকানো যাবে,  তা-ই বুঝতে পারে না। অগত্যা জোরে জোরে বই পড়তে শুরু করে দেয়। যদি কোনোভাবে অর্ঘ্যর ব্যাপারটা ওর নজরে আসে তো রক্ষা নেই। চ্যুইংগামের মতো সে এখানে সেখানে লাগাতে শুরু করে দেবে আর ওর কাছে ঘুষ হিসাবে  ফুচকা চাইবে।

সে সৃষ্টির দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারে না। পড়া ছাড়া ওর জীবনে আর কোনো সাধনা নেই Ñ এ কথাটা বহুদিন পর যেন তুষ্টি বুঝতে পারছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024