রিতা আপাকে ভয় পায় না এমন কোনো ছাত্রী নেই এই স্কুলে।
বড় আপাদের সাথে কথা হলে সবার আগে বলবে,‘তোমাদের তো রিতা আপার ক্লাস আছে। খুব কঠিন আপা। জান বাঁচাইয়া চইলো। ’
তুষ্টির তাতে কিছু আসে-যায় না। অঙ্ক ওর মোটেই ভাল লাগে না। প্রায়ই সূত্র ভুলে যায়। প্লাসের জায়গায় মাইনাস আর মাইনাস বেশিরভাগ সময় প্লাস হয়ে গিয়ে গন্ডগোল বাধে। এজন্য রিতা আপা ওকে চোখে চোখে রাখে। সবার আগে ওকে প্রশ্ন করে ওর প্রস্তুতি বুঝে নিতে চায়। যেন সে রিতা আপার গিনিপিগ। ধরেই নেন, তুষ্টির পক্ষে এ উপপাদ্য করা সম্ভব নয়। তবু বারবার করে ওকে ঘাটাবে আর পুরো শ্রেণিকক্ষের ছাত্রীদের মাঝে ওকে বকাঝকা করবে। কখনও বেঞ্চের উপর দাঁড় করিয়ে রাখবে। চোখ ফেটে জল চলে আসে তখন। মনে হয় , টিয়াটার মতো সে-ও অন্য কোন শহরে চলে যাবে। নইলে এক ডাল থেকে অন্য ডালে উড়ে চলে যাবে। কেউ তখন ওকে খুঁজে পাবে না।
কিন্তু তুষ্টি তো উড়তে জানে না। ওর পাখনা নেই। তাছাড়া চারপাশে এত বেড়াজাল যে সেগুলো ভেদ করে বেরিয়ে পড়া অত সহজ কাজ নয়।
রিতা আপার মাথায় চুল কম। তালু দেখা যায়। তাই শিশুদেও মতো কদমছাঁট চুল তার। এর ওপর হিজাব। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কন্ঠস্বর খনখনে।
প্রতিবারের মতো এবারও শ্রেণিকক্ষে ঢুকে প্রথমেই দৃষ্টি কাড়ে তুষ্টির। মনে হয় ওর প্রতি একটা তীব্র আক্রোশ জমা হয়ে রয়েছে তার অন্তরে। সেটা প্রকাশ করার কোন ভাষা নেই তার কাছে। তাই জেরা করে ওকে নাজেহাল করার ভেতর তিনি একধরনের সুখ খুঁজে পান। নইলে তুষ্টি প্রতিদিন কেন তারই হাতে এত নাজেহাল হবে ?
কাছে এসে সে প্রশ্ন করে,‘হোম-টাস্ক করেছ ?’
‘হ্যা।’ আমতা আমতা করে উত্তর দেয়।
‘তাহলে বল তো জ্যামিতি বলতে কি বোঝায় ?’
এবার তুষ্টি পড়ে যায় ফাঁপড়ে। সে সম্পাদ্য কাকে বলে শিখে এসেছে। কিন্তু জ্যামিতি কি ? জ্যামিতি তো জ্যামিতিই। কি বলবে সে? ঘাড় ঘুরিয়ে কড়ই গাছটার দিকে তাকাল। এক পলক। ওমনি চেঁচিয়ে ওঠেন রিতা আপা,‘ ওদিকে কি ? গাছের ডালে জ্যামিতি কি তা লেখা আছে নাকি মেয়ে ? তুমি জ্যামিতি পড়ছ আর জ্যামিতি বলতে কি বোঝায় সেটাই জান না ? এত বেখেয়ালি কেন ? আমি আমার ক্লাসে কতবার বলেছি? এই মেয়েরা, বল কতবার বলেছি ? ’
সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রিরা জিকির দিয়ে ওঠে,‘ বহুবার।’
রিতা আপা এবার নিষ্ঠুর হয়ে ওঠেন,‘এরকম একটা সহজ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছ না ? তুমি কিভাবে ক্লাস এইটে উঠলে ? মেয়েরা বল তো জ্যামিতি বললে তোমরা কি বোঝ ? আমি কি শিখিয়েছি ?’
‘আপা, জ্যা মানে ভূমি আর মিতি মানে পরিমাপ। যে বিদ্যা দিয়ে ভূমির পরিমাপ করা সম্ভব তাই জ্যামিতি। এটি এক প্রাচীন বিদ্যা। ’ বলে খলবলে মিমি ওর দিকে তাকিয়ে হাসে।
তুষ্টির এবার মনে পড়ে। কিন্তু ততক্ষণে রিতা আপা ওর উপর ক্ষেপে আগুন,‘আমি তোমার গার্জিয়ানদের ডাকাব। এভাবে চলবে না। ’ বলে তিনি ডায়াসে গিয়ে দাঁড়ান। পুরো কক্ষ জুড়ে স্তব্ধতা। বোকার মতো শুধু তুষ্টি দাঁড়ানো। মাথা ঘুরিয়ে যে সে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে দৃষ্টি দেবে Ñ তাও নয়। সেটাও রিতা আপা লক্ষ্য করেন।
তিনি ওকে এতটুকু পাত্তা না দিয়ে অঙ্ক বোঝাতে শুরু করলেন। সে যে এই শ্রেণিকক্ষের ছাত্রি তা যেন তিনি ভুলেই গেলেন। পাঠদান শেষ না হওয়া পর্যন্ত তুষ্টি দাঁড়িয়েই রইল। ঘণ্টা পড়ার পর যখন রিতা আপা চলে যাচ্ছেন তখনও একবার ফিরে তাকান নি ওর দিকে। এরকম খারাপ আর অমনোযোগী ছাত্রীর দিকে তিনি তাকবেন না Ñ এরকমই তার ভাবগতিক। সহপাঠীরা পর্যন্ত ওকে পাত্তা দিতে চাইছে না। প্রত্যেককে মনে হচ্ছে এক একজন রিতা আপা। তুষ্টির বুকটা ভেঙে যাচ্ছে কষ্টে।
বাড়ি ফিরে সে ছুটে গেল ছাদে। ডালিম ফুলটা এই কদিনে সামান্য পুষ্ট হয়েছে। সে ফুলটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠল,‘ খুব কষ্ট। তোরা বুঝবি না। ’ বলে ওপাশের ছাদে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে গেল অর্ঘ্যেও সঙ্গে।
অর্ঘ্য হাসিমুখে হাত নাড়ল ওর দিকে তাকিয়ে। সে মুখ ফিরিয়ে নিল। কষ্টের সময় এসব অদিখ্যেতা বিষের মতো লাগে।
ছেলেটা অবাক হল। কিছুক্ষণ পর সে গলা হাঁকিয়ে বলে উঠল,‘ তুমি একটা পাগল।’
সঙ্গে সঙ্গে ভীষণ রাগ হল ওর। ফোঁস ফোঁস করে উঠল অন্তর। বুকের ভেতরকার কষ্টটুকু রাগের বাষ্প হয়ে বের হতে চাইল। তুষ্টি সেটি বের হবার রাস্তা করে দিল শুধু।
কার্নিশের সামনে এসে হিসিহিস কওে বলে উঠল,‘ হ্যা আমি পাগল। আমার সঙ্গে কথা না বললেই হয়। কখনও রিং দিবা না। বাজে ছেলে কোথাকার ! ’ বলে সে একটুও না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিজের ঘরে ছুটে এল। রীতিমতো হাঁফাচ্ছে সে।
সৃষ্টি ওকে বলল,‘ কিরে, তোর কি হয়েছে ? স্কুল থেকে এসেই ছাদে গেলি যে ?’
‘কিছু না।’ কষ্টে ফুঁপিয়ে কান্না করতে ইচ্ছে করছে ওর। এতো চাপ সে নিতে পারছে না। সবকিছু কেমন বিস্বাদ লাগে।
সৃষ্টি আর কোন কথা না বলে বোনের পাশে শুয়ে পড়ল।
তুষ্টির চোখভরা শূন্যতা।
Leave a Reply