ইদানীং অর্ঘ্য প্রায়ই রিং দেয়। মুখে কিছু বলে না। তুষ্টি ঠিক বুঝতে পারে, এটা অর্ঘ্য ছাড়া অন্য কেউ নয়। মায়ের মোবাইলে ওর রিং এলেই সে ঠিক বুঝতে পারে। ছুটির দিনে দুপুরবেলায় ওর রিং আসে। ও যে নম্বরটা থেকে ওকে রিং দেয়, সেটির শেষ ডিজিটটা ওর চেনা। একটু তাকিয়েই সে সরে যায় সেখান থেকে।
হন্তদন্ত হয়ে এসময় তপতী ছুটে আসে। অনবরত হ্যালো, হ্যালো বলতে থাকে ফোনে। কিন্তু কেউ ধরে না। হয়তো মায়ের গলা ওর চেনা হয়ে গেছে। তপতীর চোখেমুখে বিরক্তি, মুখে বলে ,‘খেয়েদেয়ে আর কাজ নাই , খালি রং নম্বর। ’
তুষ্টির হাত-পা কাঁপাকাঁপি শুরু হয়ে যায়। রিং বন্ধ হলে তখনই সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
এমনিতেই তুষ্টির উপর সবার নজর ; সবার চোখেমুখে সংশয় ; সামান্য এদিক-সেদিক হলেই মা-বাবা দুজনই উদগ্রীব হয়ে ওঠে ওকে নিয়ে। যেন সে কোনো কঠিন রোগে আক্রান্ত ; আচরণের কিঞ্চিৎ হেরফেরে বাসার সবার ঘুম হারাম হয়ে যায়।
সে সব বুঝতে পারে। নিজের কাছে নিজেকেই অপরাধী মনে হয়। কী করলে যে ওর প্রতি সবার পুরনো আস্থা ও স্বস্তি ফিরে আসবে, সে তা বুঝতে পারে না।
একদিন ভর দুপরে তপতী সৃষ্টিকে নিয়ে পাশের বাসায় যায় গল্প করতে। মোবাইলটা মায়ের বিছনার উপর পড়ে থাকে। সুযোগ পেয়ে তুষ্টি রিং দেয় অর্ঘ্যকে,‘ এ্যাই , তুমি রিং দিবা না। ’
‘আচ্ছা। কি করবো তাহলে ? মনে পড়ে তো। ’
‘না। এসব আমার ভাল লাগে না। ’
‘কি ভাল লাগে না ? জানো, আমাদের বাড়ির পাশে একটি ছেলে কাকাতুয়া পোষে। কী সুন্দর সব পাখি। তুমি দেখলে বুঝতে পারতে। তুমি তো পাখি খুব ভালবাসো ’
‘আমার ভাল লাগে না।’ তুষ্টির কণ্ঠে বেদনার ছায়া।
‘কি ?’
‘খাঁচার পাখি। কষ্ট লাগে।’
‘ও। সরি। আচ্ছা, কাল একটা রিং দিবা ?’
‘না। ’
‘অপেক্ষায় থাকব। ’
‘না। স্কুল আছে। ’
‘অপেক্ষায় থাকব।’
‘কোনদিন না ’ বলে মোবাইলের লাইনটা কেটে দেয় তুষ্টি। একটা ঘোরের মতো লাগে সবকিছু। সে দ্রæত মোবাইল থেকে কলটি কেটে দিয়ে চুপচাপ পড়ার টেবিলে এসে বসে থাকে। চোখের সামনে অর্ঘ্যর চেহারা ভাসে। বুকের ভেতর ঝুমঝুমি। কিস্যু ভালো না লাগার এক অনুভব।
পরদিন সে মায়ের মোবাইলটা সাথে করে নিয়ে যায় স্কুলে। বাসায় এমনিতেই পড়ে থাকে এটি। খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে তাপস রিং দেয় না। তুষ্টি নিশ্চিন্তে উঠিয়ে নেয় সেটি।
টিফিন পিরিয়ডে সবার অগোচরে পুকরপাড়ে গিয়ে রিং দেয় অর্ঘ্যকে,‘ আমাকে ভুলে যাও। আমাকে দিয়ে এসব হবে না। ’
ছেলেটা হো হো করে হেসে ওঠে। যেন তুষ্টি একটা হাসির কথা বলে ফেলেছে ।
‘তুমি হাসছো কেন ?’
‘তোমার সাথে আমার কি হয়েছে যে ভুলে যাবো ? হা হা হা। তুমি একটা আস্ত বোকা। হাহাহা। ’
তুষ্টি হেসে ফেলল। সত্যিই তো। কি হয়েছে ওদের মাঝে যে অর্ঘ্যকে সব ভুলে যেতে হবে।
সে এবার গম্ভীর হয়ে বলল,‘এত হাসতে হবে না। রাখি। এসএসসি পরীক্ষাটা ভাল করে দিও। ’
‘এ প্লাস পাবো।’
‘রাখি।’ বলে সে দ্রæত মোবাইলটি লুকিয়ে ফেলে।
এর ঠিক আধঘন্টা পর ওকে ডাকা হল প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে। রীতা আপা আর প্রধান শিক্ষিকা বসে রয়েছেন সেখানে। ওরই জন্যে অপেক্ষা করছেন। দুজনই অসম্ভব গম্ভীর। মনে হচ্ছে তুষ্টি কাউকে খুন করে ফেলেছে। এমনিতেই রীতা আপার কথা শুনলে ওর জ্বর চলে আসে গায়ে। এর উপর প্রধান শিক্ষিকার কক্ষ।
জিহŸা শুকিয়ে কাঠ। মাথা ঘুরছে। সে কি অকস্মাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাবে ?
১৮
প্রধান শিক্ষিকার কক্ষটি জুড়ে থমথমে পরিবেশ।
ওকে ঢুকতে দেখে রিতা আপা এসে সরাসরি ওর মুখোমুখি দাঁড়ায় ওর । ভয়ে ত্রাসে তুষ্টি সরাসরি তাকাতে পারছে না তার দিকে।
কোনো ভণিতা না করে ঝাঁঝালো গলায় তিনি জিজ্ঞাসা করে উঠলেন,‘ এত সাহস তুমি পাও কোথা থেকে ?’
তুষ্টি আকাশ থেকে পড়ে। সে কি এমন অন্যায় করেছে যে আপা ওর সঙ্গে এভাবে কথা বলছে ?
‘কথা বলছ না কেন ?’ তাড়া দেন রিতা আপা।
‘আপা , আমি বুঝতে পারছি না। ’ মিনমিন করে উত্তর দেয় সে।
‘তুমি বুঝতে পারছ না ? চুরি করে বুঝতে পার না, চুরি করেছো? তোমার মা-বাবা কি শিখাচ্ছে ? আশ্চর্য, আমি বুঝতে পারি না।’ বলেই রিতা আপা প্রধান শিক্ষিকার দিকে তাকান। মুখে বলেন,‘ম্যাডাম, এমন অসভ্য অমনোযোগী অপদার্থ মেয়েকে স্কুলে রাখা ঠিক হবে না। এর মা-বাবাকে বলে আজই টিসি ধরিয়ে দিন, ডিসগাস্টিং। ’
‘আপা, আমি কি করেছি ?’ ফের মাটির দিকে চেয়ে মৃদু গলায় প্রশ্ন করে তুষ্টি। বাবা-মায়ের জন্যে মনটা টনটন করছে। ওর জন্যে ওদের বারবার করে গালি খেতে হচ্ছে। ভাবতেই মোচড় দিয়ে ওঠে ভেতরটা।
‘তুমি কি করেছো বুঝতে পারো না ? তোমার হাতের মোবাইলটা কোথায় ? দেখি?’ বলেই মহিলা একটানে ওর টিফিন বাক্সটা খুলে ভেতর থেকে মোবাইলটি বের করে চিৎকার দিয়ে ওঠেন,‘ এই বদমাশ মেয়ে, এটা কি ?’
রিতা আপা ছোঁ মেরে সেটি নিয়ে প্রধান শিক্ষিকার টেবিলে রাখে। এবার প্রধান শিক্ষিকা রওশন আরা চেঁচিয়ে ওঠেন,‘ তুমি জান না মোবাইল নিয়ে এই স্কুলে আসা যায় না ? জান কি না বল ?’
‘হ্যা, জানি।’ চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে তুষ্টির।
‘তাইলে কেন আনলে ? প্রেম করতে ? এইটুকুন মেয়ে, মোবাইলে প্রেম করছে স্কুলে এসে, মা-বাবার খবর নেই। কী জঘন্য টাইপ মা-বাবা। লজ্জায় মাথা হেঁট হচ্ছে।’ মহিলা ওর থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেন চরম ঘৃণায়।
এবার রিতা আপা মুখ খোলেন,‘ সিসিটিভিতে সমস্ত কান্ড তোমার রেকর্ড করা আছে। তোমার কারণে অন্যরাও খারাপ হবে। তোমার মা-বাবাকে খবর পাঠাচ্ছি। এক্ষুনি এসে যেন টিসি নিয়ে যায়। আমরা তোমার মতো বাজে মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারবো না।’ বলে ওর হাতে টেলিফোনটি ফিরিয়ে দেয়।
তুষ্টি কঁকিয়ে ওঠে কষ্টে। রিতা আপার পা জড়িয়ে ধরে অনুনয় করে,‘ আপা, আমাকে শাস্তি দেন। মা-বাবাকে জানাবেন না। আপা আপনি যা বলবেন তাই করব। প্লিজ, আপা।’ ডুকরে কেঁদে ওঠে ও। বুকটা ওর কেন যেন ভেঙে খান-খান হয়ে যাচ্ছে। বারবার বাবার অসহায় চেহারাটা ভেসে উঠছে চোখের সামনে। ওর বাবাকে সে খুব ভালোবাসে। তুষ্টি ওর বাবার বড় আদরের বড় মেয়ে। আর কারও কাছে নয়, যখনই যা চেয়েছে সব পেয়েছে বাবার কাছ থেকে। বাবার মন খারাপ হলে সবার আগে সে-ই জানতে পারে। বাবার মন খারাপ হলে সবার আগে ওকেই গান শোনাতে বলে। অথচ আজ সেই বাবা তুষ্টির জন্য কথা শুনবে ?
সে একবার রিতা আপার পা, অন্যবার রওশন আরার পা জড়িয়ে ধরে আকুতি জানাতে থাকে।
নিমিষে পুরো স্কুল জুড়ে ব্যাপারটা ছড়িয়ে পড়ে। সৃষ্টি ছুটে আসে ক্লাস ফেলে। বড় বোনের সঙ্গে ওর সারাক্ষণের খুনসুটির সম্পর্ক। আজ চোখের সামনে বড় বোনকে এমন অসহায়ভাবে ডুকরে কাঁদতে দেখে সে-ও চিৎকার দিয়ে ওঠে। রিতা আপার পা জড়িয়ে ধরে সে-ও। বোনের মতো সে-ও বলতে থাকে,‘ আপা ওকে ক্ষমা করে দিন। আমাদের মা-বাবা জানতে পারলে বড় কষ্ট পাবে। ও আর একম করবে না। ’
‘চুপ। চোরের সাক্ষী মাতাল। যেমন বড়টা, তেমনি ছোটটা। এক্ষুনি রিং কর মা-বাবাকে। এই যে বোনের মেবাইল ফোন। এটা দিয়েই তোমাদের মা-বাবাকে জানাও স্কুলে আসতে। জানাও বলছি বদমায়েশ মেয়ে ? ’ ধমকে ওঠেন আপা।
সৃষ্টি মাকে টেলিফোন করে বলে,‘ মা, বাবাকে নিয়ে স্কুলে আসো তাড়াতাড়ি।’
ওর কান্নার শব্দে তপতী ওপাশ থেকে চিৎকার দিয়ে ওঠে,‘কি হয়েছে তোর, মা ?’
‘তাড়াতাড়ি আসো। আমি আর পারতেছি না, মা।’ বলেই হুহু করে বুকের সমস্ত আবেগ ঢেলে সৃষ্টি কঁকিয়ে ওঠে। তারপর মোবাইলটা রেখে দেয়।
সৃষ্টি আর কথা বলতে পারে না। বোবা কান্নায় বাকরুদ্ধ হয় ওর কণ্ঠস্বর।
Leave a Reply