বেশিক্ষণ এতিমের মতো বাইরে অপেক্ষা করতে হয়নি তাপস-তপতি দম্পতির।
মিনিট দশেকের ভেতর তুষ্টির এ স্কুল ছাড়ার টিসি ওদের হাতে পৌঁছে গেল। চিঠিটি হাতে পেয়ে ভীষণ রাগ হল তাপসের। সামান্য কারণে এতবড় শাস্তি Ñ কিছুতেই মানতে পারছে না সে। ওর বোধ-বুদ্ধি প্রতিবাদ করতে চাইছে বারবার।
সে ছুটে যেতে চাইল প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে। শেষবারের মতো কড়া কটি কথা শুনিয়ে দেবার ইচ্ছে হচ্ছে। একজন ফাঁসির আসামিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয় কোর্ট ; অথচ জরুরি ও অত্যাবশ্যক এক মোবাইল Ñ যা দিয়ে কোনো অপরাধই সংঘটিত হয়নি তুষ্টির হাতে Ñ তবু অসহায় নিরীহ এক কিশোরীর উপর এতবড় মানসিক নির্যাতন ? মেয়েরা কি মেয়েদের বেলায় এতোই নিষ্ঠুর ? সে ছুটে গিয়ে এ প্রশ্নটাই করতে চায় ,‘একজন প্রাপ্ত বয়স্কা নারী হয়েও একটি নারী শিশুকে বুঝতে পারলেন না ? ওকে একটাও সুযোগ না দিয়ে আপনার উঠোন থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন? কতটা মানসিক চাপ নিয়ে মেয়েটি চলে যাচ্ছে, তা বুঝতে পারেন ? ’
কিন্তু ওদিকে পা বাড়ানোর আগেই তপতী ওর হাত ধরে ফেলে। মিনতিভরা কণ্ঠে অনুরোধ করে,‘ ওদের বলে কিছু হবে না। বরং তোমার কোন বন্ধু আছে কিনা খোঁজ নাও। শুধু শুধু কথা বলে কিছু হবে না। ’
তখনি মনে হল ওসমানের কথা। ভার্সিটি জীবনে সারাক্ষণ ওর কক্ষেই পড়ে থাকত। বাড়ির অবস্থা ভালো ছিল না। তাপস যখন ব্যবসা করার জন্যে মরিয়া, তখন ওসমান বিসিএসের জন্যে জান কবচ করে পড়াশুনো করছে। প্রথমবার না হলেও দ্বিতীয়বার ঠিকই হয়ে গেল। সে এখন জয়েন্ট সেক্রেটারী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ; প্রায়ই তাপস ওকে রিং দেয় আর পুরনো কথা মনে করে হাসি-ঠাট্টায় মশগুল হয়।
এতক্ষণ একদমই ওসমানের কথা মনে পড়েনি। সব মিলে তালগোল পাকানো তাপসের মাথা। তপতীর কথায় চকচক করে উঠল ওর চোখ। তাইতো , যে মাজারের যে শিন্নি । দেখা যাক , চেষ্টা করে।
পকেট থেকে মোবাইল বের করে ওসমানকে রিং দিতেই একবারের মাথায় ওপাশ থেকে বলে উঠল,‘ কিরে, কি ব্যাপার? ’
‘দোস্ত, আমি বিরাট বিপদে পড়ে গেছি।’ বলে সে কান্নাজড়িত কণ্ঠে পুরো ঘটনার বর্ণনা দেয় বন্ধুর কাছে।
মনোযোগ দিয়ে সব শোনে ওসমান। তারপর বলে ওঠে,‘এই মহিলাকে আমি চিনি। খুব বাজে। স্বামীটা আমাদের থেকে বেশ কবছর জুনিয়র। শিক্ষা কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করত ময়মনসিংহে। দুর্নীতির দায়ে চাকরি গেছে। ঠিকাছে , আমি দেখছি। তুই দাঁড়া একটুখানি। ’
এই প্রথম তাপসের একটুখানি ভালো লাগল। খানিকটা ভারমুক্ত লাগছে নিজেকে। ওসমান যেন ওর কাঁধ থেকে অপমানের এই ভারটুকু নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিল। আশার এক বিন্দু আলো যেন চকচক করছে তাপসের অসহায় দৃষ্টির সামনে।
মিনিট পনেরো ওরা দাঁড়িয়েছিল স্কুল-অফিসের সামনে। সহসা পিয়ন এসে জানাল, রওশন আরা ওদের ডাকছে।
ওরা চারজন মিলে ফের মহিলার কক্ষে পা দিতেই মহিলা অপ্রত্যাশিত রাগে ফেটে পড়েন। চেঁচামেচি শুরু করে দেন। মুখে বলতে থাকেন,‘ আপনারা পেয়েছেনটা কি ? তদ্বির করে সব সেরে ফেলবেন? চুরি করবেন, বললেই পাড়া-প্রতিবেশী এনে শাসাবেন ? ’
‘আমার মেয়ে কোন চুরি করেনি। একটি মোবাইল আনার জন্য তাকে আপনি টিসি দিতে পারেন না। এটা অন্যায়। দরকার হলে আমি কোর্টে যাব।’ ওসমানের কারণে সামান্য আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। তাই, মহিলার মতো সে-ও গলা দাগাচ্ছে।
‘যান, যান। আমি যদ্দিন এই সীটে আছি , আপনি যা খুশি করতে পারেন। সিদ্ধান্তের বদল হবে না। আপনি একজন হেডমিসট্রেসকে অপমান করেছেন। আপনাকে আমি পুলিশে দিতাম। শুধু ওসমান সাহেবের জন্য ছেড়ে দিলাম। অসভ্য কোথাকার ! মহিলাদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় তাও জানে না ! ’
‘আপনিও জানেন না কিভাবে ছাত্রীদের সাথে ব্যবহার করতে হয়। আপনি একটা হিং¯্র পাশবিক মহিলা। সিৎজোফ্রেনিয়ার পেশেন্ট। সাইকিয়াট্রিস্ট দরকার আপনার মেন্টাল স্ট্রাকচার ঠিক করার জন্য। বুঝলেন ?’
‘গেট লস্ট য়ূ রাসকেল।’ মহিলা রাগে ফেটে পড়ছেন। আরেকটু হলে হয়তো কোটর থেকে চোখ দুটো বেরিয়ে পড়বে , সমুদ্রের ঢেউর মতো এমনি উত্তাল নিয়ন্ত্রণহীন মহিলার ক্রোধ !
তপতী, তুষ্টি আর সৃষ্টি মিলে তাপসকে হাত ধরে টেনে রুমের বাইরে একটি পাতা বেঞ্চে নিয়ে বসায়। তুষ্টি ধরা গলায় বলে ওঠে,‘ বাপী, ওরা বড় নিষ্ঠুর। ওদের কিছু বলে লাভ হবে না। ’ বলতে বলতে ও ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে। এ কান্না যত না নিজের জন্যে, তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি বাবার ক্রমাগত অপমানিত হবার যাতনায়। তুষ্টির কাছে পৃথিবীর সেরা মানুষ এই বাবা। তাকে চোখের সামনে এভাবে অপদস্থ হতে দেখায় ওর বুকের ভেতরটা দীর্ণ-বিদীর্ণ হচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে। সহ্য করতে না পেরে সে একছুটে সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
Leave a Reply