রেহান ফজল
২৩শে জুন, ১৭৫৭ সাল। পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হয়েছেন বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলা। তার রাজধানী প্রায় ৫০ মাইল দূরে – মুর্শিদাবাদে।
সারা রাত উটের পিঠে চেপে পরের দিন ভোরেই সিরাজ পৌঁছেছিলেন রাজধানীতে।
মীর জাফর আর রবার্ট ক্লাইভ তখনও পলাশীর প্রান্তরেই রয়েছেন।
পরের দিন সকালে রবার্ট ক্লাইভ একটি চিরকুট পাঠালেন মীর জাফরের কাছে। লেখা ছিল: “এই জয়ের জন্য আমি আপনাকে অভিনন্দন জানাই। এই জয় আমার নয়, আপনার। আশা করি আপনাকে নবাব ঘোষণা করতে পেরে নিজে সম্মানিত হতে পারব।”
এই চিরকুট পাঠানোর আগে, যুদ্ধ জয়ের পরের দিন সকালেই মীর জাফর গিয়েছিলেন ইংরেজদের শিবিরে, রবার্ট ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতে।
কিছুটা পরিশ্রান্ত, কিছুটা চিন্তিত লাগছিল তাকে।
ইংরেজ সৈনিকরা তাকে নিয়ে গিয়েছিল কর্নেল ক্লাইভের তাঁবুতে। রবার্ট ক্লাইভ তখনও লর্ড হননি, কর্নেল ক্লাইভ তিনি তখন।
ক্লাইভ মীর জাফরকে বললেন, “আপনার এখনই রাজধানী মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা হওয়া উচিত। শহরটা নিজের কব্জায় করে ফেলুন। আপনার সঙ্গে কর্নেল ওয়াটসও যাবেন।”
ক্লাইভ তার নিজের সেনাদের নিয়ে পেছনে পেছনে চললেন।
(রবার্ট ক্লাইভ)
সিরাজ যে দূরত্ব এক রাতের মধ্যে পার করেছিলেন, সেই ৫০ মাইল পেরুতে ক্লাইভ আর তার বাহিনীর লেগে গেল তিন দিন।
রাস্তার নানা জায়গায় তোপ দাগার ফলে গর্ত, ভেঙ্গে পড়া গাড়ি আর সিরাজউদ্দৌলার সৈনিক আর ঘোড়ার মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিল।
স্যার প্যান্ডেরল মুন তার ‘দা ব্রিটিশ কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডোমিনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ বইটিতে লিখছেন, “ক্লাইভের ২৭শে জুনই মুর্শিদাবাদে পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু জগৎ শেঠ তাকে বলেছিলেন যে ক্লাইভকে হত্যার পরিকল্পনা হচ্ছে। সেজন্যই আরও দু’দিন পর, ২৯ তারিখে ক্লাইভ শহরে পৌঁছান।
“মীর জাফর শহরের প্রধান ফটকে অপেক্ষা করছিলেন ক্লাইভকে স্বাগত জানানোর জন্য। দু’জনেই একসঙ্গে শহরে ঢুকেছিলেন।
রবার্ট ক্লাইভই মীর জাফরকে মসনদে বসিয়ে নতুন নবাবকে স্যালুট করেছিলেন। এরপরে তিনি ঘোষণা করেন মীর জাফরের শাসনে কোনও রকম হস্তক্ষেপ করবে না কোম্পানি। শুধু নিজেদের ব্যবসার দিকেই তাদের নজর থাকবে।”
তারপর থেকে ১৮০ বছর ভারতে একচ্ছত্র রাজত্ব চালিয়েছে ইংরেজরা।
সিরাজউদ্দৌলার রাজকোষ থেকে পাঁচ কোটি টাকা পেয়েছিলেন ক্লাইভ। তার আশা ছিল তিনি আরও বেশি পাবেন।
প্রসিদ্ধ ইতিহাসকার উইলিয়াম ডালরিম্পল তার বই ‘দা অ্যানার্কি’তে লিখেছেন: “এই যুদ্ধ জয়ের জন্য ক্লাইভের পাওনা হয়েছিল দুইলাখ ৩৪ হাজার পাউন্ড। এছাড়া জমিদারীর মালিক হিসাবে প্রতিবছর ২৭ হাজার পাউন্ড পাওয়ার কথা ছিল।
যদি এই বিপুল অর্থ তিনি সত্যিই পেতেন, তাহলে মাত্র ৩৩ বছর বয়সেই রবার্ট ক্লাইভ হঠাৎই ইউরোপের সবথেকে ধনী ব্যক্তিদের একজন হতে পারতেন।
(পলাশীর যুদ্ধ)
“পরের কয়েকটা দিন বেশ দুশ্চিন্তায় কাটিয়েছিলেন ক্লাইভ। তার ভয় ছিল মীর জাফর কথার খেলাপ করবেন না তো!
তাদের দেখে মনে হত, যেন দুই ক্ষমতাবান গুণ্ডা বড়সড় লুটের পরে ভাগাভাগিতে বসেছে।”
যখন লুটের ভাগ পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছেন ক্লাইভ, মীর জাফরের ছেলে মীরান তখন গোটা বাংলায় খুঁজে বেড়াচ্ছেন রাজধানী থেকে পালিয়ে যাওয়া সিরাজউদ্দৌলাকে।
“সিরাজউদ্দৌলা সাধারণ মানুষের বেশে রাজধানী থেকে বেরিয়ে গেছেন। সঙ্গে আছেন কিছু বিশ্বাসভাজন আত্মীয়স্বজন, আর কয়েকজন হিজড়া।
রাত তিনটের সময়ে স্ত্রী লুৎফ-উন-নিসা আর কয়েকজন ঘনিষ্ঠকে ঢাকা দেওয়া গাড়িতে বসানো হল। সোনা জহরত যতটা সম্ভব নিয়ে প্রাসাদ ছাড়লেন সিরাজ,” ইতিহাসবিদ সৈয়দ গুলাম হুসেইন খান লিখেছেন ফারসি ভাষায় লেখা ‘সিয়ারুল মুতাখিরী’ বইতে।
মুর্শিদাবাদ থেকে প্রথমে ভগবানগোলা গিয়েছিলেন সিরাজ।
দিন দুয়েক পরে, কয়েকবার বেশভূষা বদল করে পৌঁছিয়েছিলেন রাজমহলের কাছে।
তিন দিন ধরে কিছু খাওয়া হয়নি, তাই একটু বিরতি নিয়েছিলেন সবাই।
রান্না করা হয়েছিল খিচুরি।
(পলাশীর যুদ্ধ)
ওই এলাকাতেই থাকতেন শাহ দানা নামের এক ফকির। সে-ই গোপনে খবর দিয়ে দেয় যে সিরাজউদ্দৌলা সেখানে আছেন।
এ যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়ে গেল মীর জাফর, মীরানরা। দিনরাত এক করে যার খোঁজ চলছে গোটা বাংলায়, সেই সিরাজ এত কাছে রয়েছেন!
খবর পেয়েই মীর জাফরের মেয়ে জামাই মীর কাশিম সশস্ত্র সৈন্যদের সঙ্গে করে নদী পার করে ঘিরে ফেললেন গোটা এলাকা।
সিরাজকে দোসরা জুলাই, ১৭৫৭ নিয়ে আসা হল মুর্শিদাবাদে।
রবার্ট ক্লাইভ তখনও সেখানেই ছিলেন।
সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে শহরে আসার আগেই ক্লাইভ ফোর্ট উইলিয়ামে কোম্পানির দপ্তরে চিঠি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
লিখেছিলেন, “আমি আশা করব মসনদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এমন একজন নবাবের প্রতি মীর জাফর সেই শিষ্টাচারটা দেখাবে, যা এই পরিস্থিতিতে দেখানো সম্ভব।”
ওই চিঠি পাঠানোর দু’দিন পরে আরেকটি চিঠি লিখেছিলেন ক্লাইভ।
“সিরাজউদ্দৌলা এই পৃথিবীতে আর নেই। নবাব মীর জাফর হয়তো সিরাজউদ্দৌলাকে কিছুটা দয়া দেখাতেন।
কিন্তু মীরান মনে করলেন, দেশে শান্তি বজায় রাখার জন্য সিরাজউদ্দৌলাকে মারতেই হবে।
তাকে (সিরাজউদ্দৌলাকে) গতকাল সকালে খোশবাগে কবর দেওয়া হয়েছে,” ৪ঠা জুলাইয়ের চিঠিতে লিখেছিলেন কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ।
তেসরা জুলাই সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করা হয়েছিল।
পলাশীর যুদ্ধের পর মীর জাফর ও রবার্ট ক্লাইভের দেখা করার চিত্র (১৭৬০)
‘আ হিস্ট্রি অব দা মিলিটারি ট্র্যান্স্যাকশনস্ অব দা ব্রিটিশ নেশন ইন ইন্দোস্তান’ বইতে রবার্ট ওরমে বর্ণনা দিয়েছেন সেই দিনটার।
“পদচ্যুত নবাবকে মাঝ রাতে হাজির করা হল মীর জাফরের সামনে। ওই রাজমহলেই কদিন আগেও বাস করতেন সিরাজউদ্দৌলা। মীর জাফরের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁপতে কাঁপতে প্রাণভিক্ষা করেছিলেন সিরাজউদ্দৌলা।
সেপাইরা মহলের অন্য দিকে নিয়ে গেল সিরাজউদ্দৌলাকে। ওদিকে মীর জাফর তার পারিষদদের সঙ্গে আলোচনায় বসলেন সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে কী করা উচিত, তা নিয়ে।
“তাদের কাছে তিনটে পথ খোলা ছিল: হয় তাকে মুর্শিদাবাদেই বন্দী করে রাখা হোক, অথবা দেশের বাইরে অন্য কোথায় কয়েদ করা হোক। তৃতীয় বিকল্প ছিল প্রাণদণ্ড।
অনেকেই চেয়েছিলেন সিরাজকে বন্দী করে রাখতে। কিন্তু মীর জাফরের ১৭ বছর বয়সী পুত্র মীরান কড়া বিরোধিতা করেছিলেন। মীর জাফরের নিজস্ব কোনও মতামত ছিল না,” লিখেছিলেন রবার্ট ওরমে।
তারপরের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ইতিহাসবিদ সুদীপ চক্রবর্তী, সম্প্রতি প্রকাশিত তার বই ‘প্ল্যাসি: দা ব্যাটল দ্যাট চেঞ্জড দা কোর্স অব ইন্ডিয়ান হিস্ট্রি’তে।
মীর জাফর যেহেতু নিজস্ব কোনও মতামত দেননি সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে কী করা হবে, তাই “মীরান সেটাকেই বাবার সম্মতি বলে ধরে নিয়েছিল,” লিখছেন সুদীপ চক্রবর্তী।
(পলাশী স্মৃতি চত্বর ও মতিঝিল কমপ্লেক্সে সিরাজউদ্দৌলার ভাস্কর্য)
তিনি ওই বইতে লিখেছেন, “সে তার বাবাকে বলল আপনি এখন বিশ্রাম নিন। আমি এদিকটা সামলে নেব। মীর জাফর ভাবলেন কোনও হিংসাত্মক কিছু নিশ্চয়ই হবে না। তিনি অনেক রাতে দরবার শেষ করে শয়নকক্ষে চলে যান।”
সৈয়দ গুলাম হুসেইন খানের বইতেও এর পরের ঘটনাক্রম পাওয়া যায়।
মীরান তার এক সাথী মোহাম্মদী বেগ-কে দায়িত্ব দিল সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করার। মোহম্মদী বেগের আরেকটা নাম ছিল লাল মোহম্মদ।
“মীরান তার সঙ্গী সাথীদের নিয়ে যখন সিরাজউদ্দৌলার কাছে গেল, তখনই সিরাজ বুঝে গিয়েছিলেন কী হতে চলেছে এরপর।”
“তিনি আবেদন করলেন মেরে ফেলার আগে যেন তাকে ওজু করে নামাজ পড়ার অনুমতি দেওয়া হয়। নিজেদের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করার তাগিদে হত্যাকারীরা সিরাজের মাথায় এক ঘড়া পানি ঢেলে দেয়।
তিনি যখন বুঝলেন যে ঠিকমতো তাকে ওজু করতে দেওয়া হবে না, তখন তিনি খাওয়ার জন্য একটু পানি দিতে বললেন,” লিখেছেন সৈয়দ গুলাম হুসেইন খান।
“ঠিক তখনই মোহাম্মদী বেগ ছুরি দিয়ে সিরাজের ওপরে প্রথম আঘাতটা হানলেন। ছুরির আঘাত হানা হতেই বাকিরা তলোয়ার দিয়ে হামলা চালায় সিরাজের ওপরে।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই তাদের কাজ শেষ হল। মাথাটা ঝুঁকে পড়ল সিরাজের, তিনি গড়িয়ে পড়লেন,” নিজের বইতে লিখেছেন রবার্ট ওরমে।
তখন সিরাজউদ্দৌলার বয়স ছিল মাত্র ২৫ বছর।
(মুর্শিদাবাদের কাছে খোশবাগে সিরাজউদ্দৌলার সমাধি, এখানে ১৭৫৭ সালের তেসরা জুলাই তাকে সমাধিস্থ করা হয়)
পরের দিন সিরাজউদ্দৌলার ক্ষত-বিক্ষত দেহ হাতির পিঠে চাপিয়ে মুর্শিদাবাদের অলি-গলি, বাজারে ঘোরানো হয়েছিল।
যেন সকলের কাছে প্রমাণ করার চেষ্টা যে, সিরাজ পরাজিত।
সৈয়দ গুলাম হুসেইন খান এই বর্বরতার কথা জানাতে গিয়ে লিখছেন, “সেই বীভৎস শবযাত্রার মধ্যেই মাহুত জেনে বুঝেই হুসেইন কুলি খাঁয়ের বাসভবনের সামনে মৃতদেহ বহনকারী হাতিটিকে দাঁড় করাল।
দুই বছর আগে ওই হুসেইন কুলি খাঁকে হত্যা করেছিলেন সিরাজ।
“এখন তার মৃতদেহ থেকেও কয়েক ফোঁটা রক্ত রাস্তায় গড়িয়ে পড়ল, যেখানে হুসেইন কুলি খাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।”
মীরানের নিষ্ঠুরতা কিন্তু ওখানেই শেষ হয়নি।
কিছুদিনের মধ্যেই সে আলিবর্দি খানের বংশের সব নারীদের হত্যা করেছিল।
করম আলি ‘দা মুজফ্ফরনামা অব করম আলি’ গ্রন্থে আলিবর্দি খানের বংশের সব নারীদের হত্যা করার বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, “প্রায় ৭০ জন নিরপরাধ বেগমকে একটি নৌকায় চাপিয়ে মাঝ-গঙ্গায় নিয়ে যাওয়া হয় ,আর সেখানেই নৌকাটি ডুবিয়ে দেওয়া হয়। সিরাজউদ্দৌলার বংশের বাকি নারীদের বিষ খাইয়ে হত্যা করা হয়।
“নৌকাডুবি আর বিষ খাইয়ে যাদের হত্যা করা হল, সবাইকে একই সঙ্গে নদীর ধারেই খুশবাগ নামের একটি বাগানে দাফন করা হয়েছিল।”
শুধু একজন নারীকে মেরে ফেলা হয়নি।
(মীর জাফরের বাড়ি ‘নমক হারাম দেওড়ি’র প্রবেশপথ)
তিনি ছিলেন সিরাজউদ্দৌলার অসাধারণ সুন্দরী স্ত্রী লুৎফ-উন-নিসা।
মীর জাফর আর তার ছেলে মীরান – দুজনেই তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন।
করম আলি লিখছেন, “লুৎফ-উন-নিসা বাবা আর ছেলে – দু’জনের প্রস্তাবই এই বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যে, প্রথমে হাতির পিঠে চড়েছি, এখন গাধার পিঠে চাপা সম্ভব নয়।”
পলাশীর যুদ্ধের বছরখানেকের মধ্যেই মীর জাফরের তেজ ধীরে ধীরে নিভে আসতে শুরু করে।
কিছুদিন আগেও যে ক্লাইভ মীর জাফরের হয়ে কথা বলতেন, তিনিও তাকে ‘দা ওল্ড ফুল’ বা ‘বোকা বুড়ো’ বলে, আর তার ছেলে মীরানকে ‘আ ওয়ার্থলেস ডগ’ বা ‘বেকার কুকুর’ বলে উল্লেখ করতে থাকেন।
আলস্য, অক্ষমতা আর আফিমের নেশা মীর জাফরকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছিল।
এরপর ১৭৫৮ সালের ১১শে নভেম্বর ক্লাইভ জন পিনকে লেখা এক চিঠিতে বলছেন, “যে ব্যক্তিকে আমি মসনদে বসিয়েছিলাম, সে অহঙ্কারী, লোভী আর কথায় কথায় গালিগালাজ করা এক লোকে পরিণত হয়েছে।
তার এই ব্যবহারের জন্য নিজের প্রজাদের কাছ থেকেই সে দূরে সরে যাচ্ছে।”
ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার আগে অবধি মীর জাফর তার সৈন্যদের ১৩ মাসের বকেয়া বেতনের মাত্র তিনটে কিস্তি দিতে পেরেছিলেন।
বেতন না পেয়ে সৈনিকরাও ক্ষোভে ফুঁসতে শুরু করেছিল।
(পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে লেখা সুদীপ চক্রবর্তীর বইয়ের প্রচ্ছদ)
স্যার পেন্ডেরল মুন তার বই ‘ওয়ারেন হেস্টিংস অ্যান্ড ব্রিটিশ ইন্ডিয়া’ গ্রন্থে লিখেছেন, মীর জাফরের বাহিনীর ঘোড়াগুলোর অস্থিচর্মসার হয়ে পড়েছিল আক্ষরিক অর্থেই।
তাদের শরীরের হাড় গোনা যেত। সেগুলোর পিঠে যারা চাপত, তাদের অবস্থা সামান্য উন্নত ছিল। এমনকি জমাদাররাও (অফিসার পদের নাম) ছেঁড়া ফাটা পোশাক পড়তে বাধ্য হতেন।
পলাশীর যুদ্ধের তিন বছরের মধ্যেই ভারতের অন্যতম ধনী শহর মুর্শিদাবাদ দুস্থ হয়ে পড়ল।
এই পরিণতির জন্য মীর জাফর অনেকাংশেই দায়ী।
গুলাম হুসেইন খান লিখছেন, “সব সময়েই দামী গয়না-জহরত পড়ার একটা শখ ছিল মীর জাফরের। কিন্তু নবাব হওয়ার পরেই নানা রত্ন-খচিত ছয়-সাতটা গয়না পড়তে শুরু করেছিলেন তিনি।
গলায় তিন-চারটে মুক্তোর মালা থাকতো সবসময়েই। তার গান শোনা চাই আর নারীদের নাচ দেখা চাই।”
কিছুদিনের মধ্যেই মানুষ বুঝতে পারল যে, বাংলা শাসন করার ক্ষমতা মীর জাফরের নেই। তার আচার ব্যবহার একজন অশিক্ষিত আরব সৈন্যের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল, যার রাজ্য সামলানোর কোনও দক্ষতাই ছিল না।
স্যার প্যান্ডেরল মুন তার বই ‘দা ব্রিটিশ কনকোয়েস্ট অ্যান্ড ডমিনিয়ন অব ইন্ডিয়া’ বইটিতে লিখেছেন: “ক্লাইভ ইংল্যান্ডে ফিরে যাওয়ার জাহাজে ওঠার আগে বলেছিলেন, মীর জাফরের শাসন করার কোনও ক্ষমতাই নেই।
প্রজাদের ভালবাসা আর বিশ্বাস জয় করতেও সে অক্ষম। তার কুশাসন বাংলাকে অরাজকতার দিকে ঠেলে দিয়েছে।”
পলাশীর প্রান্তর, এখানেই হয়েছিল পলাশীর যুদ্ধ
একদিকে যখন মীর জাফরের রাজ্য শাসনে অক্ষমতা পরিষ্কার হচ্ছে, তখন তার ছেলে মীরান নিষ্ঠুরতা চালিয়েই গেছে।
দয়া বা ঔদার্য – এই শব্দগুলো তার অভিধানে ছিলই না। তার সবথেকে বড় চিন্তা ছিল আলিবর্দি খানের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে – যাতে ভবিষ্যতে কোনওদিন বিদ্রোহের কোনও সম্ভাবনাও না থাকে।
গুলাম হুসেইন খান লিখছেন: “আলিবর্দি খানের পুরো হারেম নদীতে ডুবিয়ে তো দিয়েইছিল মীরান, তারপরে তার নজর পড়ে সিরাজের সবচেয়ে কাছের পাঁচ আত্মীয়ের পরিবারের দিকে।
সিরাজের ছোটভাই মির্জা মেহেদীকে দুটো কাঠের তক্তার মাঝে রেখে পিষে মেরেছিল মীরান। ওই হত্যাকাণ্ডের যুক্তি হিসাবে সে বলেছিল সাপ মারার পরে তার বাচ্চাদের বাঁচিয়ে রাখা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।”
“সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের যতজন সদস্যকে সে হত্যা করেছিল, তার একটা তালিকা সে নিজের কাছে রাখত। খুব কম সময়ের মধ্যেই সেই তালিকায় নামের সংখ্যা ৩০০-রও বেশি হয়ে গিয়েছিল,” লিখছেন গুলাম হুসেইন খান।
তার প্রতিদ্বন্দ্বীরা আর আগের প্রশাসনের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি মীরানকে রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকের কাছেই হয় ছুরি দিয়ে হত্যা করেছিল, বা বিষ খাইয়ে মেরেছিল।
ওয়ারেন হেস্টিংস যখন সিরাজের পরিবারের সদস্যদের নৃশংস হত্যার ঘটনাগুলো শুনলেন, তারপরে তিনি কলকাতায় পাঠানো এক চিঠিতে লিখেছিলেন: “এই পাশবিক হত্যাকারী যা করেছে, তার পক্ষে কোনও যুক্তি-তর্কই টেকে না।
“আমি এই কথা বলার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী, কিন্তু তবুও বলছি, এরকম একজনকে আমাদের সমর্থন করা কোনওভাবেই সঠিক হবে না।”
বিবিসি হিন্দি
Leave a Reply