শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৫৫ অপরাহ্ন

সুপতির মানুষখেকো

  • Update Time : বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪, ৯.২৯ পিএম

বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ তেমন একটা দেখা যায় না। সুন্দরবনের বাঘ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু একটি সময় ছিল যখন সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে বাঘ ছিল। ঐ সময় বাঘের পরিমাণ বেশি থাকায় কিছু কিছু বাঘ গবাদি পশু এমনকি মানুষও খেয়ে ফেলত। আর তখন এই বাঘগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল মানুষ খেকো বাঘ। সেই সব বাঘ শিকারের কাহিনী গুলো আজও রোমাঞ্চকর। বাংলাদেশে মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ছিলেন তার নাম পচাব্দী গাজী। তারা কয়েক পুরুষ ধরেই ছিলেন এ ধরনের বাঘ শিকারি। পচাব্দী গাজী নিজেই বলেছিলেন তার  এবং তার পিতা মেহের গাজীর ভয়ংকর সব বাঘ শিকারের কাহিনী ।  এমনই কিছু ভয়ংকর বাঘ শিকারের কাহিনী সারাক্ষণে  প্রকাশ করা হলো।


হুমায়ুন খান 

বাগেরহাট জিলার শরণখোলা রেঞ্জের অধীনে সুপতি বন অফিস। বাংলা ১৩৫৭ সনে শত শত বাওয়ালী ও জেলে এই অফিস থেকে টিকিট কেটে বনে কাজ করছিল। চিংড়ি, কাইন, কোরাল, জাবা, সেলেট, দাঁতনী, ইত্যাদি মাছ জেলেদের নৌকার পর নৌকা বোকাই হয়ে যাচ্ছিল খুলনায় ও সেখান থেকে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। আর বাওয়ালীরা সুন্দরী, গরান, বাইন, বোলা, পশুর, কাঁকড়া, হেতাল, ইত্যাদি গাছ কেটে দুইশ, তিনশ, চারশ, পাঁচশমণী নৌকা বোঝাই দিয়ে চালান দিচ্ছিল খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ঢাকা, নোয়াখালী ও অন্যান্য জায়গায়। বাওয়ালীরা কাজ করছিল ঠিকাদার বা কন্ট্রাক্টারের জন্যে, ঠিকাদার বন দফতর থেকে নিলামে বন ডেকে এদেরকে কাজে নিয়োগ করেছিলেন। জেলেরা নিজেরাই টিকিট কেটে নদী বা খাল থেকে মাছ ধরছিল।

এটাই বনে কাজ করার রীতি।

জেলে-বাওয়ালীদের কাজ যখন পূর্ণ উদ্যমে চলছিল আর বন দফতরের কর্মচারীগণ তাদের নিরাপত্তা সম্বন্ধে নিশ্চিত হয়ে কাজ পরিচালনা করছিলেন ঠিক তখন, একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে, একটি বাঘ পর পর দুইজন জেলে ও বাওয়ালীকে খেয়ে সমগ্র সুপতি এলাকাময় আতঙ্কের সৃষ্টি করে ফেলে। জেলে-বাওয়ালীরা দলে দলে এসে সুপতির বন দফতরে ভীড় করতে লাগল, এলাকা ছেড়েও চলে যেতে আরম্ভ করল।

বন কর্মকর্তা প্রথম ঘটনার সংবাদ পাওয়ামাত্রই সেখানে শিকারী পাঠিয়েছিলেন এবং বাওয়ালীদের আবেদনে পরবর্তী দুই দিনে শিকারীদের সংখ্যা আরো বাড়িয়ে নিরাপত্তা জোরদার করেছিলেন, কিন্তু তারপরেও, অবস্থাদৃষ্টে, তাঁর পক্ষে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হয়নি। নিজের বিশেষ লোক মারফত তিনি সুন্দরবনের সর্বশ্রেষ্ঠ শিকারী, আমার বাবা মেহের গাজীর নিকট জরুরী চিঠি পাঠালেন, আর বাবাও সেই চিঠি মুহূর্তমাত্র দেরী না করে সুপতি রওনা হয়ে গেলেন। পেয়ে তিনি বরাবর নিজের দোনলা গাদা বন্দুক দিয়ে শিকার করতেন, সেবারও গাদা বন্দুকই নিয়ে গেলেন। সঙ্গে নিয়ে গেলেন নাঁতীকে, অর্থাৎ আমার ভাই তাহের গাজীর ছেলে হায়াত আলীকে এবং আরও দুইজনকে।

শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো বাঘ শিকার করতে গিয়ে বাবা মারাত্মকভাবে জখম হয়েছিলেন। বাঘের থাবায় তাঁর মাথা থেকে কান, চোয়াল ও গালের মাংশপেশী সব আলগা হয়ে গিয়েছিল। বাবার হুকুমে ও দোয়ায় তিনি শয্যাগত থাকতেই আমি গিয়ে শিঙের গোলখালীর মানুষখেকো বাঘ মেরেছিলাম।

বন অফিস থেকে চিঠি পাঠালেও সুপতির বাঘ মারতে যাওয়া বাবার জন্যে কোন বাধ্যতামূলক ছিল না, তবে তাঁর নৈতিক দায়িত্ব ছিল। বনের কোন এলাকায় মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব শুরু হয়েছে শুনলেই তিনি অস্থির হয়ে পড়তেন, এবারেও অস্থিরতার মধ্যেই তিনি রওনা হলেন।

শিকারীরা মানুষখেকো বাঘ-মারতে গেলে তাঁদের পরিবার পরিজনের মনে একটা ক্ষীণ ভীতি থাকেই যে সুসংবাদ বা দুঃসংবাদ যে কোনটি ঘরে আসতে পারে, কিন্তু বাবার এবারের তাড়াহুড়ার শিকার যাত্রার সময়ে তিনি নিজে বা আমরা কেউ ভাবিনি যে, অত বড় দুঃসাহসী, সুকৌশলী ও অভিজ্ঞ শিকারীর সেই হবে শেষ যাত্রা।

বাবা নিজের নৌকা করে গিয়েছিলেন। সুপতির বন অফিসে হাজিরমাত্র হয়ে সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে কটকার খালে রওনা হয়ে যান, কটকার খালেই বাঘ দুইজন জেলে ও বাওয়ালীকে খেয়েছিল। তার পরবর্তী চারদিন ধরে তিনি সকাল-সন্ধ্যা বাঘের সন্ধান করতে থাকেন।

বাবা একাই ছিলেন না, সুপতির ত্রাস সৃষ্টিকারী এই বাঘের সন্ধানে তখন সেখানে আরো কয়েকজন দক্ষ শিকারীই ছিলেন; তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন মাদার শেখ।

চারদিনের দীর্ঘ অনুসন্ধান সত্ত্বেও বাবা, মাদার শেখ বা অন্য কেউ একবার বাঘ দেখতে পাননি। আমি আগেই বলেছি যে, সুন্দরবনের দুর্গমতা ও অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিবেশের কারণেই এটা সম্ভব হয়। পঞ্চম দিনে পাঠাকাটার খালের পাড় থেকে একজন বাওয়ালীর মৃত্যুসংবাদ আসে। পূর্বদিন উক্ত পাঠাকাটার খালের পাড়ে কয়েকজন বাওয়ালী কাঠ কাটছিল। হঠাৎ বাঘ হুঙ্কার দিয়ে একজনের উপরে লাফ দিয়ে পড়ে। হতভাগ্য বাওয়ালী কোনরকম আত্মরক্ষার চেষ্টা তো দূরের কথা, একটা শব্দ করারও সুযোগ পায়নি। বাঘ সবার চোখের সামনে তাকে নিয়ে যায়।

এই ঘটনার পরে বাকী বাওয়ালীরা অনেকক্ষণ বেদিশা অবস্থায় ছিল, পুরাপুরি হুঁশ ফিরে ফেলে তখন তারা ছুটে গিয়ে অন্যান্য বাওয়ালীদেরকে ডেকে আনে। প্রায় চারশ হাত দূরে আঁটো জঙ্গলে গিয়ে তারা মৃতদেহ খুঁজে পায়, কিন্তু তার মধ্যে বাঘ বেশ কিছু অংশ খেয়ে ফেলেছে।

অর্ধভুক্ত লাশ নিয়ে তারা সুপতি বন অফিসে এসে মৃত্যু রেকর্ড করায় ও চরেই দাফন করে। ঘটনার পরের দিন বাবা খবর পান।

সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাঁঠাকাটার খালে গেলেন এবং পরবর্তী তিনদিন পর্যন্ত চারপাশের এলাকায় তল্লাশ করতে থাকলেন। শিকারী মাদারও তখন বাবার সঙ্গে ছিলেন।

চারদিনের দিন খাল থেকে অনেকখানি ভিতরে গিয়ে তিনি একটু দূরে এক ঝোপের পিছনে কট্ কট্ আওয়াজ শুনতে পেলেন। জঙ্গলের দুর্গমতা ডিঙিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সামনে এগুলেন এবং খুবই আঁটো এক জায়গার ভিতরে বাঘ দেখতে পেলেন-একটা বড় হরিণ খাচ্ছে।

তিনি যতদূর পারলেন কাছে এগুলেন, কিন্তু গুলি করার সুবিধা পেলেন না। মানুষখেকো বাঘকে এত কাছে পেয়েও গুলি না করে ফিরে আসবেন, তা হতে পারে না। বাঘ বাবার উপস্থিতি টের পায়নি, তিন্নি অতি অসুবিধাজনক অবস্থাতে, বাধ্য হয়ে, গুলি করার জন্যে উঠে দাঁড়াতে বাঘ তাকে দেখতে পেল এবং নিক্ষিপ্ত গুলিতে জখম হয়ে একটা হুঙ্কার দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। সামনে গিয়ে তিনি বাঘের রক্ত দেখতে পেলেন কিন্তু যথেস্ট বেলা না থাকায় সেদিনকার মত আর অনুসরণ না করে নৌকা নিয়ে ফিরে এলেন।

পরদিন সকালে শিকারী মাদার শেখকে সঙ্গে নিয়ে বাবা আহত বাঘের সন্ধানে বের হলেন। জখমী মানুষখেকো অপেক্ষা মারাত্মক ও বিপজ্জনক আর কোন জন্তু দুনিয়াতে নেই। আগের দিনের অর্ধভুক্ত হরিণের কাছে গিয়ে বাঘের পারা আর রক্তের চিহ্ন ধরে ধরে দুইজনে বনের ভিতরে এগুতে লাগলেন। বন্দুক হাতে আগে যাচ্ছিলেন মাদার শেখ আর পিছনে বাবা। অত্যন্ত ঘন কাঁটায় ভরা এক হেতাল বনের মাঝামাঝি একটা জায়গায় গিয়ে তাঁরা হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন; দুই অভিজ্ঞ শিকারীরই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যেন তাঁদেরকে বলে দিল যে, বাঘ সামনে। হঠাৎ এক গর্জন করে ক্রুদ্ধ বাঘ হেতাল ঝোপ থেকে মাদারের মাথায় লাফ দিয়ে পড়ল, ভূলুণ্ঠিত মাদারকে ছেড়েই চক্ষের পলকে আবার বাবার হাত কামড়ে ধরল এবং পরমুহূর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল। তাঁরা কেউ একটু পিছনে সরে আসারও সময় পেলেন না।

মাটিতে পড়ে আহত অবস্থায় বাবা দূরের নৌকা থেকে হায়াত ও অন্যান্যদের ডাক দিলেন। তারা ছুটে গিয়ে মাদার শেখকে কোলাকুলি করে নৌকায় নিয়ে এল, কিন্তু নৌকা পর্যন্ত আনার আগেই তিনি মারা গেলেন; একটা কথাও বলতে পারেননি। বাবার হাত কনুই-এর উপর থেকে সামান্য চামড়ার সঙ্গে কেবল ঝুলছিল, সেই অবস্থায়ই ধরাধরি করে তাঁকে নৌকায় আনা হল।

যথাসম্ভব দ্রুত বন অফিসে মাদারের মৃত্যু রেকর্ড করিয়ে তারা বাড়ীমুখী রওনা হল। বাবার হাতে ব্যান্ডেজ করে রক্ত বন্ধ করা হল, কিন্তু মাদার শেখের লাশ তাঁর গ্রামের বাড়ী আংটিহারাতে পৌঁছিয়ে দিয়ে নিজ বাড়ী ১০ নং সোরাতে ফিরতে দুইদিন সময় লেগে গেল। এর মধ্যে বাবার হাতে পচন ধরে যায় এবং গ্রামের হেকিম- কবিরাজদের সকল বনজ চিকিৎসা ব্যর্থ করে দিয়ে রক্তক্ষরণে ও অসহ্য ব্যথায় পরদিন সকাল নয়টায় বাবা মারা যান। সত্তর বছরের দুঃসাহসিক জীবনে পঞ্চাশটিরও বেশী রয়াল বেঙ্গল বাঘ মারার অবিশ্বাস্য কৃতিত্বের অধিকারী সুন্দরবনের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিকারীর জীবনাবসান হল।

সুন্দরবনের অন্যান্য সকল খ্যাতনামা শিকারীর সঙ্গেই বাবার অতি সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল, সারা জীবন বাঘ শিকার করে প্রচুর আর্থিক পুরস্কারও লাভ করেছিলেন। মেহের গাজীকে বাদ দিলে সুন্দরবনের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তাঁর মৃত্যুসংবাদ শুনে অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি দেখতে এসেছিলেন এবং জানাজায় বহু লোক শরীক হয়েছিলেন। আমার নাম পচাব্দী গাজী নয়, আমার আসল নাম আব্দুল হামিদ গাজী। পর পর কয়েকটি শিশুসন্তান মারা যাওয়ার পরে আমার জন্ম হলে আজরাইলের অবহেলার পাত্র করে রাখার জন্যে বাবা-মা আমাকে পচা বলে ডাকতেন। পরবর্তীকালে আব্দুল হামিদ নাম থাকা সত্ত্বেও সবাই আমাকে পচাব্দী বলে ডাকত এবং সেটাই শেষ পর্যন্ত আমার নাম হয়ে যায়।

বাবার মৃত্যুর প্রায় একমাস পরে বন দফতর থেকে আমাকে খবর পাঠানো হয়। সুপতির বাঘের তৎপরতা কেউ বন্ধ করতে পারেননি এবং গত পনের দিনে আরো তিনজন মানুষ খেয়েছে। শোকের মাঝে এই পিতৃহন্তা বাঘটির কথা আমি একদিনের জন্যে ভুলতে পারিনি; বাঘ মারা পড়েছে সে রকম কোন খবরও আমরা পাইনি। জখম হবার পরের প্রায় দিন পনের কোন মানুষ ধরেনি এবং তার পরের পনের দিনে পর পর তিনজনকে নিয়ে যাওয়ার খবর থেকে ধারণা করতে পারলাম যে, বাবার গুলিতে বাঘ বেশ ঘায়েল হয়েছিল, কিন্তু এখন ঘা শুকিয়েছে এবং বাঘ আবার মানুষ ধরতে শুরু করেছে। দুই ছোট ভাই ও ভাতিজা হায়াতকে সঙ্গে নিয়ে নিজেদের নৌকা করে আমি রওনা হলাম। অনেক রাত্রে সুপতি বন অফিসে গিয়ে পৌঁছলাম এবং অফিসেই ঘুমালাম। পরদিন সকালে বন অফিসের বন্দুক ও কার্তুজ নিয়ে চারজনে আবার নৌকা ছাড়লাম। ভাই-এর ছেলে হায়াত গাজী বাবার সঙ্গে সুপতির বাঘ মারতে এসেছিল, কটকার খালের পাড়ে ঠিক কোনখানে বারা বাঘকে গুলি করেছিলেন এবং পরে কোনখানে বাঘ মাদারকে ও বাবাকে আক্রমণ করেছিল সেই দুইটি জায়গাই সে আমাকে দেখিয়ে দিল। দিন রাত অনুসন্ধান করতে লাগলাম। গত কয়েক দিনে বাঘ যে দুইজন বাওয়ালী ও একজন জেলেকে খেয়েছে তাদের একজনকে দিনের বেলা কাজ করার সময়ে কয়েকজনের মাঝখান থেকে নিয়ে যায়। বাকী সকলে সাহসের সঙ্গে চীৎকার ও লাফালাফি করেছিল, একজন হাতের দা পর্যন্ত বাঘের মাথায় ছুঁড়ে মেরেছিল, কিন্তু বাঘ ভূক্ষেপ না করে শিকার মুখে করে নিয়ে যায়।

গভীর বনে কাজ করছে একদল বাওয়ালী [ছবি: খসরু চৌধুরী।

কখনো দুইজন, কখনো তিনজন এবং কোন বেলা চারজনেই নৌকা করে সন্ধান করতে লাগলাম। তখন আরো কয়েকজন শিকারী সেখানে ছিলেন, বন কর্মকর্তাও ছিলেন। সারাদিন আমরা নৌকা করে, কখনো পায়ে হেঁটে, সম্ভাব্য সকল কৌশল অবলম্বন করে বাঘের খোঁজ করতে লাগলাম। রাত্রে জঙ্গলে বাঘ চলাফেরা করতে পারে এমন সব স্থানে ‘কল’ পেতে রাখলাম, কিন্তু কটকোর খালে পৌঁছানোর পরবর্তী চারদিনের মধ্যেও আমি বা আমরা কেউ একবার বাঘ দেখতে পেলাম না, কোনখানে একটা তাজা পারাও না।

এর মধ্যে একদিন সকালে আমি গভীর ঘুমে মগ্ন নাক ডাকানো একটি বাঘ খুব সহজে শিকার করি, সে কথা পিছনে বলেছি। তাতে সমস্ত সুপতি এলাকায় মহা আনন্দ- উল্লাসের সৃষ্টি হয়ে যায় এবং বহু জেলে-বাওয়ালীর উপস্থিতিতে বাঘটির চামড়াও ছাড়ানো হয়। মানুষখেকো হবার কোন লক্ষণ যদিও বাঘের ছিল না-বুড়া বাঘ নয়, দাঁত পড়া নয়, চামড়া উজ্জ্বল ও নিখুঁত, তথাপি মানুষখেকো বাঘের এলাকাতেই শিকার করে একটা প্রবণতার বশে আমিও যেন ধরে নিয়েছিলাম যে সেটাই আমার পিতৃহন্তা বাঘ। আমাদের আনন্দ একদিনও স্থায়ী না হতে কটকার খালের আধ মাইল দূরবর্তী ডোরার খাল থেকে মানুষখেকো বাঘের পরবর্তী খবর এল। আমি যেদিন সকালে নাক ডাকা বাঘ মারি সেই বিকালেই মানুষখেকো বাঘ ডোবার

খালের পাড় থেকে এক বাওয়ালীকে নিয়ে যায়। বিকাল চারটায়। এক ঘন্টার মধ্যে জনা পঁচিশেক জেলে-বাওয়ালী সেই ঘটনাস্থলে একত্রিত হয়েছিল, কিন্তু ভীতিহেতু শেষ পর্যন্ত তাদের আর লাশ উদ্ধারের জন্যে যাওয়া হয়নি। আমাদের কাছে এই খবর পৌছল পরদিন।

তৎক্ষণাৎ নৌকা নিয়ে রওনা হয়ে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌছলাম। নিহত খাওয়ালীর পাঁচজন সঙ্গীই জানাল যে গতকাল সকালে আমি যে কটকার খালের পাড় থেকে একটি বাঘ মেরেছি সে খবর তারা পায়নি। তারা যে এই এলাকার মানুষখেকো বাঘ সম্বন্ধে একেবারে বেখেয়ালী ছিল তাও নয়। কাজ করছিল, হঠাৎ ভয়ঙ্কর গর্জন করে বাঘ উপুড় হয়ে থাকা বাওয়ালীর উপরে পড়ে। আতঙ্কিত দুইজন মাটিতে পড়ে যায়, আর তিনজন মড়ার মত দাঁড়িয়ে থেকে কেবল প্রত্যক্ষ করে যে বিড়ালের ইঁদুর ধরার মত বিশাল বড় বাঘ তাদের সঙ্গীর মাথা কামড়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, সে ডাক দেয়নি, কথা বলতে পারেনি।

আমরা ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে কথা বলতে থাকতেই আরো দুইজন শিকারী নৌকা করে সেখানে এসে পৌছলেন। তখন আমরা মোট তিন শিকারী এবং আরো প্রায় পনেরজন বাওয়ালী জঙ্গলের ভিতরে অগ্রসর হলাম। শ খানেক হাত ভিতরেই বাওয়ালীর লাশ- বলা উচিত হাড়-পাওয়া গেল। প্রায় সবই খেয়ে ফেলেছে, তবু পায়ে, হাতে এবং মাথার সঙ্গে যতটুকু গোশত লেগে ছিল তার জন্যে বাঘ আবার মরির কাছে আসবে, আশা করা গেল। কারণ খাবারের মত আর কিছু নেই সে রকম হরিণের হাড় পর্যন্ত আমি ক্ষুধার্ত বাঘকে চাটতে দেখেছি।

শিকারী দুইজন একটা বড় গাছে বসলেন, মরি থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে প্রায় চল্লিশ হাত দূরে? সেদিক থেকে বাঘ আসার একটা সম্ভাবনা ছিলই, আর তাছাড়া অন্য কোন দিক থেকে এলেও ঘুরে গুলি করা যেত। আমি আমার ভাইয়ের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বসলাম মরি থেকে হাত বিশেক সোজা উত্তরে সেঁও একটা বেশ বড় গাছে। আমি বললে তখন আর সব বাওয়ালীরা জোরে কথা বলতে বলতে নৌকায় চলে গেল।

তখন বেলা প্রায় বারোটা। হায়াত আলী আমার মাথার উপরের ডালে বসল আর আমি বসলাম গাছের খাড়া কাণ্ডের সঙ্গে পিঠ ঠেকিয়ে সামনের ডালে দুই পা রেখে, হাঁটু একটু ভাঁজ করে, খাল রইল আমার পিছনে বাম হাতে।

বাওয়ালীর লাশ বা হাড়গোড় পরিষ্কার জায়গাতেই ছিল আমার সামনে। হাঁটুর নীচ থেকে পায়ের আঙুল পর্যন্ত, আর দুই হাতের গোশত ছিল, কিন্তু হাঁটু থেকে গলা পর্যন্ত, কিছুই ছিল না; তাতে ঘোলাটে বড় বড় দুই চোখ থাকাতে বাওয়ালীর দেহাবশেষ বর্ণনাতীতভাবে বীভৎস দেখাচ্ছিল।

অন্ততঃ দুই ঘণ্টা নিস্তব্ধতার মধ্যে কেটে যাওয়ার পরে আমার বামদিকে দুইশ হাত সামনে, খালের উজানে; ‘টাই।’ করে এক হরিণ’ ডেকে উঠল। কিন্তু একবারমাত্র ডাক, তারপরে আবার নীরবতা। বেলা পড়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বনের বিভিন্ন দিক থেকে হরিণ, বানর আর মোরগের ডাক বেশ ঘন ঘন শুনতে থাকলাম, কিন্তু সেগুলো কোন ভয়ার্ত ডাক ছিল না।

বিকাল পাঁচটার সময়ে বনে প্রায় অন্ধকার নেমে এলে তখন গাছ থেকে শিকারী দুইজন আমাদেরকে ডাকলেন এবং তখন আমিও জোরে জবাব দিয়ে নীচে নামলাম। এমনও হতে পারে যে আমরা গাছে অবস্থান নিবার সময়ে বাঘ তা আড়াল থেকে লক্ষ্য করেছিল, নিরাপদবোধ করেনি বলেই আসেনি। বাওয়ালীর ‘লাশ’ খালের পাড়ে দাফন করে বোটে ফিরতে ফিরতে আমাদের বেশ রাত হয়ে গেল।

সে রাত্রে আমি আর কল পাততে পারলাম না, কারণ সম্ভাব্য স্থান নির্বাচন না করে যেখানে সেখান কল পেতে কোন ফল হয় না. আর সেটা নিয়মও নয়। বিভ্রান্তি ও গ্লানিময় চিন্তার মাঝে আমি বোটে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সাতটার মধ্যে গরম ভাত খেয়ে, পান খেয়ে দুই ভাই ও ভাতিজাকে নিয়ে সেদিনের মত যখন নৌকায় উঠলাম তখন কেন জানি আমার মনে হল যে, সেদিন কোন সুফল ফলবে। অবিশ্রান্তভাবে খোঁজ করতে থাকলাম তারার বেলা বন অফিসের দুইজন সুফসম্যান দ্রুত ডিডি বেয়ে আমার ডোয়ার মাঝামাঝি জায়বর দিল যে বোটম্যানার আগে কটকার খাল আর ডোরার ম্যান্ডের গিয়ে মাসিস্থ জায়গা থেকে বাধ কিছুজন বাওয়ালীকে নিয়ে গেছে। তৎক্ষণায়ে বোটের গিয়ে সেই সংবাদ বহনকারী একজনা মোর নিয়ে আবার দ্রুতবেগে নৌকা বেয়ে আমরা ঘটনাস্থলে গিয়ে পৌঁছলাম।রি ওয়ালীদের বাওয়ালী গভীর বনে, খাল থেকে অন্ততঃ দুই-আড়াই শ হাত ভিতরে কাঠ কাটছিার জবাঘ ভয়ঙ্কর গর্জন করে পশ্চিম দিক থেকে লাফ দিয়ে গিয়ে একজনকে ধার কাটতিনটা ঝাড়া দিয়ে মেরে ফেলে মুখে তুলে নিয়ে য়ায়ান যে ঝোপের ভিতর থেকে দুই-তিনট দিয়েছে সেখানে লাফের দাপটে নরম মাটিতে যেন গর্ত হয়ে গেছে আর হাত ছয়েক দূরে যেখানে বাওয়ালীকে ধরেছে সেখানে তার কুড়ালটা পড়ে রয়েছে।

একাদূরে পারা আর রক্তের চিহ্ন ধরে সোজা দক্ষিণমুখে এগুতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই একটা ডালের সঙ্গে আটকা তার কাপড় পেলাম। একেবারে তাজা রক্ত আর চার-পাঁচ হাত পর পর বাওয়ালীর পায়ের আঙুল হ্যাঁচড়ানোর দাগ ধরে অন্ততঃ পাঁচ শ হাত গেলাম, এর মধ্যে একবারও বাঘ মুখের শিকার মাটিতে রাখেনি; সেখানে একটা খুবই ছোট খালের পাড়ে, হেতাল ঝোপে বাওয়ালীর দেহ পেলাম।শরীর গুটানো, মাথা একদিকে কাত হয়ে পড়ে আছে, পেট থেকে চার-ছয় খাবলামাত্র খেয়েছে। বেলা তখন দেড়টা। শীতের সুন্দরবনে আরো চার ঘন্টা আলো থাকবে। তাই নিহত বাওয়ালীর আত্মীয়-স্বজনকে লাশ সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে রাখতে সম্মত করাতে পারলাম। সন্ধ্যা হলে আর কোন অজুহাতেই আমি আটকে রাখতে পারব না, সেই শর্তে তারা রাজী হল, কেন না বোটে ও সুপতি বন অফিসে মৃত্যু রেকর্ড করিয়ে রাতারাতি তারা গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে গিয়ে লাশ দাফন করবে। বাওয়ালী যেখানে পড়ে ছিল তা থেকে বিশ হাতের মধ্যে দুই তিনটি গাছেই বসার সুবিধা ছিল। পনের হাত দূরে এক খুব বড় পশুর গাছে উঠে আমি বেশ সুবিধাজনক একটা মোটা ডালে বসলাম। ডালটা মাটি থেকে আন্দাজ নয় হাত উপরে ছিল এবং আমাকে আড়াল করার মত যথেষ্ট ডালপালা তিনপাশেই ছিল। ভাই-এর ছেলে হায়াত আমার কয়েক হাত উপরে একটা দোডালায় বসল। তখন আমার দুই ভাই বাওয়ালীদের নিয়ে জোরে কথা বলতে বলতে পিছনে নৌকায় চলে গেল।

সেদিন ছিলাম আমি একলাই শিকারী। বাবার চেহারাটা বার বার মনে ভাসতে লাগল। দোনলা বন্দুকটা শেষবারের মত খুলে কার্তুজ দুইটি বের করে দেখে আবার ভরে আমি তৈরী হয়ে বসলাম।

বন্দুকের নল আমার জোড় করা হাঁটুর মাঝখানে আর কুন্দা আমার ডান বগলের নীচে বাওয়ালীর দেহ বরাবর ধরা; বাঘ দেখলে কুন্দাটা শুধু কাঁধ পর্যন্ত তুলতে হবে। হায়াত ও আমি দুইজনেই যথেস্ট আবডালে বসেছিলাম, বাঘ খুব সতর্কতার সঙ্গে মাটি থেকে নয়-দশ হাত উপরে তন্ন তন্ন করে না খুঁজলে আমাদেরকে দেখতে পাবে না।

বনের একেবারে নীরবতার মধ্যে প্রায় চল্লিশ মিনিট হবে সময় পার হল। আমরা গাছে গাছ হয়ে বসে রইলাম। নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে মুখ অতি ধীরে ধীরে ঘুরিয়ে যতদূর দেখা যায় লক্ষ্য করতে লাগলাম। এক সময়ে বাওয়ালীর থেকে অন্ততঃ ত্রিশ হাত দূরে পূব-দক্ষিণ দিকে ঘন ঝোপের ভিতরে, কোন পাতার নড়াচড়া, নয়, কিন্তু একটু হলুদ রঙ সরে গেল বলে মনে হল। চোখের ভুল হতে পারে, কিন্তু ততটুকু ভুলকেও আমি অবহেলা করলাম না। ইঞ্চি ইঞ্চি করি বন্দুকের কুন্দা কাঁধে তুলতে লাগলাম।

দুই মিনিটের মধ্যেই যেখান থেকে একটু আগে বাঘের লেজটা সরে যেতে দেখেছিলাম তার হাত ছয়েক দক্ষিণ থেকে বাঘ বের হল। একবার মাথাটা উঁচু করল, তারপর মুখ সামনে বাড়িয়ে সোজা তার শিকার লক্ষ্য করে দাপটের সঙ্গে হেঁটে আসতে লাগল। কাছে এসেই বাওয়ালীর পেট থেকে এক খাবলা গোশত ছিঁড়ে মিটে আসতে কামড়ের টানে আধ হাত উপরে উঠে আবার মাটিতে পড়ল। আমি মাথায় জটিল করলাম। কোন গর্জন; গোঙানী বা আওয়াজ না করে বাঘ বাওয়ালীর দেহের উপরে পড়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় গুলি করলাম এবং বন্দুক কোলের উপরে রেখে ভার দিলাম, ‘আল্লা! আল্লা! আল্লা। আল্লা! আল্লাহ্!’ অনেক দূরে নৌকা থেকে আমার দুই ভাই ও বাওয়ালীদের ফিরতি ডাক ভেসে এল।

গাছ থেকে নেমে বাওয়ালীর উপরে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা বাঘের পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। বুড়া বাঘ, আমার গুলিতে মাথা ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। কাঁধে ঘা, বাবার গুলি ঠিক কাঁধে লেগে চামড়ার নীচ দিয়ে প্রায় ছয় ইঞ্চি গিয়ে বের হয়েছিল, যথেষ্ট গোস্ত ভেদ করেনি।

ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও এই মানুষখেকোকে আমি গ্রামের বাড়ীতে নিয়ে আসতে পারিনি, সুপতি বন অফিসের সামনে যেতেই সকল কর্মচারী আর শত শত জেলে-বাওয়ালী সেখানেই চামড়া ছাড়ানোর জন্যে জোর-জবরদস্তি করতে লাগলেন। অগত্যা আমাকে তাই মেনে নিতে হল। জেলে-বাওয়ালীদের ইচ্ছার কাছে নতি স্বীকার করে সেখানেই সাড়ে দশ’ ফুট লম্বা বাঘের চামড়া ছাড়ানো হল।

পুরস্কারের টাকাসমেত বাড়ী ফিরে আমার মাকে সর্বপ্রথমে এই খবর দিতেই মা দুই হাত তুলে বলেছিলেন, ‘বাবা, যে দুই বাঘে তোমার বাবাকে কামড় দিল, সেই দুইটিই তোমার হাতে মারা পড়ল!’

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024