শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:১৩ অপরাহ্ন

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (১ম কিস্তি)

  • Update Time : বুধবার, ৩ জুলাই, ২০২৪, ৫.৪৪ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

ঢাকার তাঁতে প্রস্তুত সুতী কাপড় কয়েক ভাগে বিভক্ত ছিল। একদিকে যেমন নওয়াব-বাদশাহদের উপযুক্ত সূক্ষ্মতম মসলিন তৈরী হত, অন্যদিকে তেমনি সাধারণ  কৃষকদের ব্যবহারোপযোগী মোটা কাপড়ও ঢাকায় তৈরী হত। সে হিসাবে বিচার করলে ঢাকায় তৈরী সুতী কাপড়কে কয়েকটি সাধারণ ভাগে ভাগ করা যায়-মসলিন, মাঝারি রকমের কাপড়, মোটা কাপড় ও এক  ধরনের রেশম মিশ্রিত সুতী কাপড়। রং এবং বুনন প্রণালীর পরিপ্রেক্ষিতেও মসলিন বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত ছিল যেমন, ডোরাকাটা, মসৃণ (plain), চারকোনা চিত্রবিশিষ্ট বা ছককাটা (chequered), এবং রং করা।

সূক্ষ্মতা, ব্যবহারিকতা ও বুননের পরিপ্রেক্ষিতেও মসলিনের বিভিন্ন নাম ছিল, যেমন, আব-ই-রওয়ান, শবনম, জামদানী ও সরবন্দ। এর মধ্যে আবার নওয়াব-বাদশাহদের জন্য তৈরী মসলিন এক একটি বিশেষ নামে পরিচিত ছিল। যেমন, মোগল বাদশাহ ও তাঁর পরিবারবর্গের জন্য তৈরী মসলিনকে মলবুস খাস বা খাসবস্ত্র (অর্থাৎ বাদশাহর জন্যই বিশেষভাবে তৈরী) বলা হত এবং বাংলার সুবাদার বা নওয়াবের জন্য তৈরী মসলিনকে বলা হত সরকার-ই-আলা। আঠার ও উনিশ শতকে মলবুস খাস মলমল খাস নামেও পরিচিত ছিল। মলবুস খাস বা সরকার-ই-আলা কোন বিশেষ রকমের কাপড়ের নাম নয় বরং যে সব কাপড় মোগল বাদশাহ বা বাংলার নওয়াবের জন্য নির্দিষ্ট ছিল তা বুনন, রং ও সূক্ষ্মতার বিচারে বিভিন্ন রকমের ও বিভিন্ন নামের হলেও ঐ একক নামেই পরিচিত ছিল। একে এক- প্রকার দরবারী পরিভাষা বলা চলে।

সাধারণতঃ একখানি মসলিন ২০ গজ লম্বা ও ১ গজ চওড়া ছিল। মসলিনের ওজন, মূল্য এবং সূক্ষ্মতা বিচারের সময় এই পরিমাণই আদর্শরূপে গণ্য ছিল। প্রত্যেক টুকরা মসলিনের সুতার সংখ্যা নির্ধারণ করা যেত এবং এর হিসাবের জন্য টানা সুতা গণনা করবার নিয়ম ছিল। সানার দাঁতের সংখ্যাই টানা সুতার সংখ্যা হিসাবে গণ্য হত, যদিও প্রকৃত পক্ষে টানা সুতার সংখ্যা সানার দাঁতের সংখ্যার দ্বিগুণ থাকত, কারণ সানার প্রত্যেক দাঁতের সাথে দুইটি করে সুতা বাঁধা থাকত। আবার মসলিনের মূল্য নির্ধারণের সময় তার ওজন, ‘দৈর্ঘ্য ও সুতার সংখ্যা বিচার করা হত।

যে কাপড় যত বেশী দীর্ঘ এবং যত বেশীসংখ্যক সুতাবিশিষ্ট হয় অথচ ওজনে কম হয় তাই সুক্ষ্মতম এবং উৎকৃষ্টতম বিবেচিত হত এবং তার মূল্যও সর্বোচ্চ নির্ধারিত হত। আগাগোড়া একই রকম সূক্ষ্ম বানা সুতার তৈরী মসলিন খুব কমই পাওয়া যেত; একমাত্র মলবুস খাস বা সরকার-ই-আলাই এর ব্যতিক্রম ছিল বলে মনে হয়। কারণ প্রয়োজন মাফিক পর্যাপ্ত পরিমাণ বানা সুতার অভাব ছিল। আবার মাঝে মাঝে তাঁতিরা নিজেদের লাভের জন্য অপেক্ষাকৃত কম সুক্ষ্ম সুতা মাঝে মাঝে চালিয়ে দিত। এজন্য ইংরেজ কোম্পানীর কর্মচারীরা মসলিনকে অর্ডিনারী, ফাইন, সুপার ফাইন এবং ফাইন সুপার ফাইন ইত্যাদি কয়েক ভাগে ভাগ করে নিত।

সৌভাগ্যবশতঃ আঠার এবং উনিশ শতকে ঢাকায় তৈরী বিভিন্ন প্রকারের মসলিনের কয়েকটি তালিকা পাওয়া যায়। বিভিন্ন প্রকারের মসলিনের পরিমাণ, মূল্য ইত্যাদি নির্ণয়ের জন্য এসব তালিকা পর্যালোচনা করা প্রয়োজন। আঠার শতকের প্রথমদিকে নওয়াব মুর্শিদ কুলী খান মোগল সম্রাটের কাছে যে সব মসলিন পাঠাতেন তার তালিকা নিম্নরূপঃ

মলবুস খাস

ঢাকা আড়ং থেকে:

১০০ খানি জামদানী প্রত্যেকখানি

২৫০ হিসাবে                               ২৫,০০০ টাকা

ধোওয়া ও মেরামত

(dressing) খরচ                                                 ১,০০০        “    ২৬,০০০ টাকা

৫০ খানি সিল্ক, চিকন প্রত্যেকখানি

২০০ হিসাবে                                        ১০,০০০       “

ধোওয়া ও মেরামত খরচ                                              ২৮০       “

১০,২৮০    “

৬০ খানি রেজা রা ছোট টুকরা,

রূপার বাদলা সমেত; প্রত্যেকখানি

১০০ হিসাবে                                                                ৬,০০০   “

ধোওয়া ও মেরামত খরচ

২০০     “

৬,২০০    “

খাসনগর বা সোনারগাঁও আড়ৎ থেকে:

১০০ খানি সাদা (plain) কাপড়

প্রত্যেকখানি ২০০ টাকা করে                                       ২০,০০০ টাকা

ধোওয়া ও মেরামত খরচ                                                  ২,৮০০   “

২২,৮০০ টাকা

২০ খানি সরবন্দ, প্রত্যেকখানি

৮০ টাকা করে                                                          ১,৬০০  “

ধোওয়া ও মেরামত খরচ                                                   ১৫০.২৫

১,৭৫০.২৫  “

বাজিতপুর আড়ং থেকে:

১০০ খানি সাদা (plain) কাপড়,

প্রত্যেকখানি ২০০ টাকা করে                                             ২০,০০০   টাকা

ধোওয়া ও মেরামত খরচ                                                     ১,০৫০.৭৫   “

 

২১,০৫০.৭৫ টাকা

জঙ্গলবাড়ী আড়ং থেকে :

১০০ খানি সাদা (plain) কাপড়,

প্রত্যেকখানি ১০০ টাকা করে                                                          ১০,০০০ টাকা

ধোওয়া ও মেরামত খরচ                                                                     ১,০০০    “

১১,০০০ টাকা

 

মোট-৯৯,০৮১   “

 

 

ঢাকাস্থ ইংরেজ বণিক কোম্পানীর বাণিজ্য কুঠিতে রক্ষিত আঠার শতকের দলিলে দেখা যায় যে, তারা নিম্নবর্ণিত বিভিন্ন প্রকারের সুতীকাপড়  রপ্তানী করতঃ

                                           

পরিমাণ                      ১৭৬০-১৭৬৪             ১৮০০

নাম                সুতার সংখ্যা            (হাত)                           সালে মূল্য              সালে মূল্য

ডুরিয়া                  ১৫০০                ৪০×২ হাত                     ১২ টাকা                 ১৫ টাকা

 

মাঝারি ডুরিয়া       ১৯০০                  “                                   ১৮   “                    ২০.৯০

“      “ প্রশস্ত           “                      ৪০×২-                         ২০.২৫                   ২২.৭০

“        “ ফাইন        ২০০০                 ৪০×২  “                       ২৫ টাকা              ২৯  টাকা

 

চারকোনা সুপার

“   ফাইন               ২১০০                  “      “                           ৩০  “                       ২৮   “

চারকোনা সুপার

ফাইন প্রশস্ত                “                     ৪০×২  “                    ৩৩.৭৫                    ৩৭.৭০

চারকোনা ফাইন

সুপার ফাইন                “                       ৪০×২  “                        ৫০ টাকা             ৪৪ টাকা

আব-ই-রওয়ান        ১৪০০                    “   “                              ৩৬  “                 ৩৯.১০

জামদানী                     “                       ২০×২  “                        ৫০ ”                   ৩৬.২৫

সরকূটী অর্ডিনারী       “                       ৪০×২  “                          ৫ “                      ৭.৫০

সরবন্দ ফাইন              “                    ৪০×১/৪ “                         ৪ “                        ৪.৯০

মলমল                      ১২০০                  ৪০×২  “                       ৭.৫০                   ১০.২৫

“   ফাইন                     ১৩০০                   “    “                              ৯ “                    ১২.৯০

“ “     লম্বা                         “                         “    “                           ১১ “                   ১৪.৯০

সুপার ফাইন

লম্বা                             ১৪০০                   “     “                              ৩০ “                  ৩০.৫০

“ সুপার ফাইন            ১৬০০                   “     “                               ২০ “                  ২২.৩০

“ “   “ লম্বা                   ১৮০০                  ৪৫×২  “                          ৪৭ “                  ৫০.২৫

মাহমুদিয়াতি              ২৭০০                   ৪০×২    “                       ৩.৬০                  ৫.২৫

সরবন্দ                          ৬০০                  ৪০×১  “                          ৩.২৫                    ৩.৭৫

নয়নসুখ ফাইন                  “                       ৪০×২  “                       ১০ টাকা               ১৮ টাকা

“  সুপার ফাইন                 “                          “    “                               ১৬   “                   ১৮   “

খাসা চাঁদপুর ফাইন         ”                          “      “                             ১৪    “                   ১৫.৫০ “

সুপার ফাইন                    “                          “     “                              ২০  “                      ২১ টাকা

হামমাম ফাইন                 “                         ২৪×৩  “                         ১৬  ”                       ১৪  “

“  “ সুপার ফাইন                “                         “   “                                 ২১  “                        ১৮.৫০

ডিমিত্তি অর্ডিনারী              “                        ২৪×২                               ৬  “                        ৬.৯০

“     ফাইন                    “                                “     “                                ১১.৫০                     ১২.৫০

 

এছাড়াও ইংরেজ কোম্পানীর দলিলে নিম্নলিখিত কয়েক প্রকারের মসলিনের নাম পাওয়া যায়, যেমনঃ

তনজেব                সুতার সংখ্যা            ১৮০০ পরিমাণ      ৪০x২       হাত মূল্য       ৭.৭০

সরহদকোনা               “      “                ২১০০     “           ৪০x২          “     “                ৩০ টাকা

আলিবালি                   “      “                   ১৭০০     “           “     “         “       “                ১৫  “

“                            “     “                    ১৫০০    “            “    “          “      “                   ১০ “

তরান্দাম                      “     “                    ২১০০    “            ৪০x২        “      “                ১৮  “

ভিক্টোরিয়া আলবার্ট মিউজিয়ামে চিকন, চারকোনা, আব-ই রওয়ান, সরকার-ই আলি, শবনম, তনজেব, নয়নসুখ, জঙ্গলখাস, ডোরিয়া, জামদানী ও বুটী ইত্যাদি কয়েক প্রকারের মসলিন রক্ষিত আছে।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024