শুক্রবার, ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ০২:০১ পূর্বাহ্ন

অর্থনেতিক পরিকল্পনা ও অবকাঠামোর পরিবর্তিত বাস্তবতা

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ৪ জুলাই, ২০২৪, ১২.২০ পিএম

স্বদেশ রায়

দেশের সচেতন মানুষ অন্তত আশা করেছিলো এবারের বাজেট ভিন্ন আঙ্গিকে হবে। সরকার যেহেতু ইতোমধ্যে স্বীকার করেছে, দেশের অর্থনীতিতে বড় একটা ধাক্কা লেগেছে। আইএমএফ, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ছাড়াও নানা উৎস থেকে দেশের অর্থনীতিকে সাপোর্ট করার জন্যে অর্থ খোঁজা হচ্ছে। আইএমএফও নানা অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচী দিচ্ছে-এ সময়ের বাজেটটি নিঃসন্দেহে ভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ন ছিলো।

কিন্তু সংসদে বাজেট পেশ করার পরে দেখা গেলো সেটা নিতান্তই গতানুগতিক একটি বাজেট। এমনকি আবুল মাল আব্দুল মুহিতের প্রস্থানের পর মোস্তফা কামাল অর্থমন্ত্রী হিসেবে বাজেটকে যেখানে নামিয়ে এনেছিলেন, এটা সেখানেই আছে। মোস্তফা কামালের আমলে বাজেট থেকে ভবিষ্যৎ দীর্ঘ অর্থনৈতিক পরিকল্পনা অনেকখানি সরে গেছে। পাশাপাশি আর্থিক খাত ম্যানেজমেন্টকে দুর্বল হবার অনেক পথ তৈরি করা দেয়া হয়েছে। অর্থনৈতিক দীর্ঘ পরিকল্পনা থেকে তিনি কেন সরে এসে এসেছিলেন সেটা সহজে বোঝা যায় না। তবে অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্ট দুর্বল করার পথগুলো তৈরি করার কারণ সকলেই বোঝে। একজন হঠাৎ ফেঁপে ওঠা ব্যবসায়ী হিসেবে তিনি তার ও তার সহযাত্রীদের নিজস্ব স্বার্থগুলোকেই গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এবারের বাজেটে তার অবসান ঘটে সংকটাপন্ন অর্থনীতিকে আগের জায়গায় নিয়ে যাবার একটি পরিকল্পনা থাকবে- এমন আশা কিছু মানুষ অন্তত করেছিলো।

বাজেট পেশের পরে দেখা যায়  এ বাজেট অনেকটা আগের বাজেটের পুনরাবৃত্তি। এরপরেও অতি ক্ষীন একটা আশা ছিলো, সংসদে অন্তত কিছু সদস্য এখানে কিছু পরিবর্তন আনার জন্যে কিছু কথা বলবেন। কিন্তু যারা এ সম্পর্কে কিছু কথা বলতে পারেন, তারা এর নিকট দিয়েই যাননি। আর বাদবাকী যারা লোকাল গর্ভমেন্টে থাকার যোগ্যতা নিয়ে পার্লামেন্টে এসেছেন তারা তাদের এলাকার উন্নয়ন অর্থাৎ তাদের অবস্থানে থেকেই কথা বলে গেছেন। যা জাতীয় সংসদ ও জাতীয় বাজেটের সঙ্গে যায় না।

কিন্তু এখন দেশের মানুষের জন্যে সব থেকে বড় বিষয় সামনে এসেছে যে, দেশের অর্থনীতি ধাক্কা খেয়ে যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সেখান থেকে বের করে আনার একটা বাস্তব সম্পন্ন পদক্ষেপ নেয়া। একদিনে এটা বের করে আনা যাবেনা। এক বছরেও এটা বের করে আনা যাবেনা। যারা বলবেন, দ্রুতই এখান থেকে উত্তরণ ঘটানো যাবে সেটা হবে মূলত একটা ভুল বা সন্তুষ্টির জন্য বলা।

 

দেশের ও দেশের বাইরের যারা বাংলাদেশের অর্থনীতির দিকে নজর রাখে, তাছাড়া আর্ন্তজাতিক অর্থ সংস্থাগুলো যে ধরনের কথা বলছে, তার লাইন বিটুইন পড়লে এটা পরিস্কার যে অন্তত বছর তিনেকের একটি বাস্তব সম্মত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এখন প্রয়োজন।

এবং এই পরিকল্পনা করার আগে প্রথমে একেবারে নিরেট সত্য’র ওপর দাঁড়িয়ে সরকারকে প্রকৃত ডাটা ও গবেষণার মাধ্যমে পরিস্কার করতে হবে, বাস্তবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনীতি কতটুকু ধাক্কা খেয়েছে- আর অভ্যন্তরীন অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টের কারণে কতটুকু ধাক্কা খেয়েছে।

এই বাস্তবতার ওপরে না দাঁড়ালে সরকার যদি বর্তমান সমস্যা থেকে বের হবার জন্যে একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করে তাহলে সে পরিকল্পনাও বাস্তবভিত্তিক হবে না।

যেমন এ মুহূর্তে জনগনের জন্যে সব থেকে বড় সমস্যা মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতির ফলে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা সাধারণ মানুষ বা নির্ধারিত আয়ের মানুষের জন্যে কষ্টকর শুধু নয়- তার থেকেও বেশি হিসেবে দেখা দিয়েছে। এই নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি’র কারণ হিসেবে এখন আর কোন মতেই চাঁদাবাজীর ওপর দোষ দেয়ার সুযোগ নেই।কারণ সারা দেশে এখন আর ওইভাবে ফেরি নেই। এখন গোটা দেশই মূলত সেতুদ্বারা সংযুক্ত। তাই ট্রাক থামিয়ে চাঁদাবাজির সে দিন চলে গেছে। এখন বাস্তবে স্পেসভাড়া বাড়া, জ্বালানী মূল্য বাড়া, শ্রমিকের মূল্য বাড়া সহ ভিন্ন অনেক কারণ যোগ হয়েছে সাধারণভাবে। এরসঙ্গে আছে উৎপাদন খরচ, অপরিকল্পিত সরবরাহ, উৎপাদনের সঠিক সমন্বয় না করা। এর বিপরীতে আমদানী পন্য’র ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের কার্টেল তৈরি হওয়া- যাকে সিন্ডিকেট বলছে। এই সব সমস্যারই অর্থনৈতিক রীতি নীতির ভেতর দিয়েই সমাধান করার পরিকল্পনা ও সে পথে এগুনো প্রয়োজন। এর কোনটাই শক্তি প্রয়োগ করে সমাধান করা যাবে না।

অন্যদিকে বিদেশী বন্ধু রাষ্ট্রগুলো এখন বাংলাদেশকে অনেক বেশি অবকাঠামোতে ঋণ দিতে আগ্রহী। বাংলাদেশ যে এ ঋণ নেবে না তা নয়। তবে বর্তমান বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে কোন কোন অবকাঠামো আশু প্রয়োজন; আর কোন কোন অবকাঠামোর জন্যে অপেক্ষা করা যায়- সেগুলো নির্ধারণ এখন একান্ত প্রয়োজন। কারণ, দেশের অর্থনীতির মূল শক্তির সঙ্গে বৈদেশিক ঋনের একটা সামঞ্জস্য থাকতে হবে। কোন এক দিকে যদি পাল্লাটা উঁচু বা নিঁচু হয়ে যায় তার শেষ দায় দেশ ও দেশের মানুষকেই নিতে হবে শেষ অবধি।

 

তাছাড়া দেশের অর্থ কতটা কর্মসংস্থানে আর কতটা অবকাঠামোতে ব্যয় করতে হবে তার স্পষ্ট পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই দাবী রাখে। ভোটের রাজনীতি বিবেচনায় এই অবকাঠামো তৈরির কোন প্রয়োজন নেই। আর তাতে যে প্রকৃত ভোট হলে ক্ষমতাসীনদের কোন লাভ হয় না তা এবার ভারতের উত্তর প্রদেশের ভোট একটি উজ্জল দৃষ্টান্ত।  সেখানে মানুষের ছোট ছোট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ভেঙ্গে আট লাইনের হাইওয়ে করা হয়েছিলো। ক্ষমতাসীনদের আসা ছিলো এই হাইওয়ে দেখে মানুষ তাদেরকে ভোট দেবে। মানুষ কিন্তু তা করেনি। মানুষ তার নিজের রুজির দিকে তাকিয়েছে।

আমাদের অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি কিন্তু এখনও সেই আশির দশকের চিন্তা চেতনায় আছেন। তারা মনে করেন, এলাকার রাস্তা ঘাটের মতো অবকাঠামো হলে মানুষ তাদের ভোট দেবে। কিন্তু এই ২০২৪, ২৬, বা ২৮ এ যদি তারা প্রকৃত অর্থে জনগনের কাছে যায় তারা দেখবে জনগন সেই আশির দশকের অবকাঠামোর চাহিদাতে এখন আর নেই। এখন তাদের জীবনের জটিলতা বেড়েছে, তাদের নানা ধরনের খরচ বেড়েছে- এমনকি মানুষ এখন স্বাস্থ্য সচেতন হবার ফলে তার চিকিৎসা খরচও বেড়েছে। যে কারণে তাদের চাহিদা এখন রোজগার বাড়ানো। সরকারকে তারা তাদের এই চাহিদা পূরণের সহায়ক হিসেবে চায়।

এছাড়া বর্তমানে বাংলাদেশে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, দেশের জনগোষ্ঠির সব থেকে বড় অংশ তরুণ। এই তরুণদের জন্য কাজ সৃষ্টি  ছাড়া অন্য কোন বিকল্প নেই। অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে বিদেশের বাজারে পাঠানোর বিপরীতে এদের দক্ষ করা একান্ত প্রয়োজন। এ সপ্তাহে ব্যাংককে অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর যে কনফারেন্স হয়েছে সেখানে দেখা গেছে বিদেশে শ্রমিক পাঠানোতে ফিলিপিন্সের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। তবে বাস্তবতা হলো, ফিলিপিন্স পাঠায় গৃহ পরিচারিকা আর বাংলাদেশ পাঠায় নির্মাণ শ্রমিক। এর বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতই পৃথিবীতে সব থেকে বেশি সফটওয়ার ওয়ার্কার পাঠায়। এর একমাত্র কারণ, সে দেশের সফটওয়ার কর্মীদের ইংরেজি ভাষার ওপর দক্ষতা।

 

ভাষা সব সময়ই একটি প্রযুক্তিগত অবকাঠামো। কম্পিউটার নির্ভর পৃথিবী হবার পরে এই প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর ভেতর ইংরেজিতে দক্ষতা সব থেকে বড় অবকাঠামো হিসেবে দেখা দিয়েছে। আমাদের পার্লামেন্টে খুব কম সদস্য’র পক্ষ থেকে এই অবকাঠামো গড়ে তোলার পক্ষে কথা বলতে শুনেছি। অধিকাংশ লোকাল গর্ভেমেন্টের প্রতিনিধির মতো কালভার্ট, ব্রিজ ও রাস্তা নিয়ে আছেন। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে বা প্রকৃত অর্থে ডিজিটালাইজেশানের মাধ্যমে অগ্রগতি করতে হলে যে মূল অবকাঠামো ইংরেজি ভাষাতে গুরুত্ব দিতে হবে এ বিষয়টির দিকে নজর নেই। এমনকি বছরের পর বছর ডিজিটাল পার্কগুলো কেন ফাঁকা পড়ে আছে,  ফ্রিল্যান্স প্রোগামার বা অনান্য তথ্য প্রযুক্তিগত কাজে যে বাংলাদেশের তরুণরা ওইভাবে কোন স্থান নিতে পারছে না কেন- এর মূলে যে ভাষাগত সমস্যা, সেদিকটি জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি সীমায় নেই।

তাই এখন শুধু ভূমিতে নয়, নদীর ওপরে নয়, অবকাঠামো মানবসম্পদের কোন কোন ক্ষেত্রে এবং কীভাবে গড়ে তুলতে হবে সেটাই সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। কারন, পৃথিবীর তরুণ জনগোষ্টির দেশগুলোর জন্যে এখন সব থেকে বড় সম্পদ এই তরুণ মানবসম্পদ। যেহেতু এ মুহূর্তে উন্নত দেশগুলোতে তরুণ জনগোষ্ঠি  কমে যাচ্ছে তাই তরুণ জনগোষ্টির দেশগুলোকে এখন মূল অবকাঠামো হিসেবে তরুণ মানবসম্পদকেই ধরতে হবে। এবং সেই সব দেশ বা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে, যারা বর্তমানের বাস্তবতায় এই অবকাঠামো অর্থাৎ মানবসম্পদ অবকাঠামো গড়তে সহায়তা করবে। আর এই সম্পদ গড়তে পারলে তখনই শুধুমাত্র বর্তমান বাস্তবতায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক যোগসূত্র তৈরি করা যাবে।

 

অন্যদিকে আর্থিক খাতের বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের ম্যানেজমেন্ট সংকট কমাতে এক দিকে যেমন টপ টু বটম যোগ্যতাকে মূল্য দিতে হবে পাশাপাশি নীতি নিয়েও গভীর পর্যালোচনার দাবী রাখে। যেমন দেশীয় ব্যাংকের অর্থ দেশের কাঠামোগত অবকাঠামোতে যাবে নাকি নতুন কর্মসংস্থানমূলক শিল্প ও মানবসম্পদে ব্যয় হবে তার মূল্যায়ন ও পরিকল্পনা জরুরী। কারণ, কাঠামোগত অবকাঠামোতে বেশি চলে গেলে শিল্পখাতে তার খারাপ প্রভাব পড়বে, শিল্পখাত ঋণ পাবে না। এর একটা বিপরীতমূখী ধাক্কা অর্থনীতিতে স্বাভাবিকই এসে পড়বে।

এছাড়া অর্থনীতির অবস্থা খারাপ বলে এক ধরনের কঠোরতা বা কৃচ্ছতার নীতি নেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অতীতে বহুদেশ বড় বড় যুদ্ধ শেষে শতভাগ কৃচ্ছ্রতার নীতি না নিয়েই সফল হয়েছিলো সেগুলো পর্যালোচনা করেই বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে বেরিয়ে আসার রোডম্যাপ তৈরির দাবী রাখে। বেশি কৃচ্ছ্রতা উৎপাদন কমিয়ে দেয়। বেশিক্ষেত্রে সেটা দীর্ঘস্থায়ী সংকটে ঠেলে দেয়।

সর্বোপরি, এই অতি সাধারণ মানের বাজেটের পরে এ মহূর্তে দেশের অর্থনীতিকে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার ট্রেনে তোলার জন্যে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতার সঙ্গে মিল রেখে, কোন ঋণ দাতার অর্থে প্রলুব্ধ না হয়ে, অন্তত তিন বছরের একটি অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এখন সময়ের দাবী বলেই মনে হয়। কারণ, মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কষ্ট থেকে মুক্তি এবং তরুণ জনগোষ্ঠিকে এই জনভার থেকে জনসম্পদে পরিনত করা ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবার সুযোগ নেই।

 

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024