নাদিরা মজুমদার
দ্বিতীয় জোভিয়ান গ্রহ শনি সূর্য থেকে ষষ্ঠ এবং সৌর জগতের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রহ। শনির অলঙ্কার আভরণ হলো তাকে ঘিরে থাকা জমকালো প্রায় বৃত্তাকারের তুষারাবৃত হিমেল আংটি-সিস্টেমের চোখধাঁধানো রূপ সৌন্দর্য্য; গ্রহগুলোর মধ্যে শনি বাস্তবিকই অনন্য গ্রহ। তার সাতটি প্রধান আংটির প্রতিটি নিজেদের মধ্যে চমৎকার দূরত্ব বজায় রেখে তৈরি করেছে আংটির মনোরম ’সেট’। শনি একমাত্র আংটিধারি গ্রহ নয় বটে তবে বাকি সব গ্রহের রিং বা আংটিগুলো শনি’র আংটিগুলোর মতো এ-ম-ন সমারোহপূর্ণ নয় বা জটিল নয়। প্রায় সাতাশটি পৃথিবীকে পাশাপাশি রাখলে যে পরিমাণ চওড়া হবে – সেই পরিমাণ বিস্তার নিয়ে শনির আংটির সেট শনিকে ঘিরে রেখেছে। বাস্তবিকই শনি ’লর্ড অব দ্য রিংস’।
বৃহস্পতির মতো শনিও প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে গঠিত বি-শা-ল একটি বল, গ্যাস-দানব। তাই বৃহস্পতির মতো শনিরও রয়েছে শক্তিশালী চুম্বক ক্ষেত্র, তার গ্যাস বলের অভ্যন্তরে ধাতব হাইড্রোজেন নিরত সবেগে ঘুরছে বলে চুম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হয়েছে; তার বায়ুমণ্ডলের গ্যাস সমৃদ্ধ উপরাংশে নন-স্টপ ঝড়-ঝঞ্ঝা হয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই; আরো রয়েছে গ্রহ-সদৃশ চাঁদ বা প্রাকৃতিক উপগ্রহের সমাহার। চাঁদগুলোর আচরণও বৈচিত্রপূর্ণ; যেমন : ’এনসেলাডাস’ (ঊহপবষধফঁং) নামক শনির চাঁদটি কুয়াশা ও ধোঁয়ায় ঢাকা ’টাইটেন’ (ঞরঃধহ) চাঁদের মিথেনপূর্ণ হ্রদে দমকে দমকে জল স্প্রে করে যাচ্ছে।
প্রাচীন সভ্যতাগুলো বৃহস্পতি ও শনি গ্রহের সঙ্গে নিবিড়ভাবে পরিচিত ছিলো। আধুনিককালে, অনেক রবোটিক নভোযানই শনি দর্শণে গেছে; যেমন : পাইয়োনিয়ার, ক্যাসিনি অথবা ভয়েজার ১ ও ২। জেমস ওয়েব নভোটেলিস্কোপ তার অবলোহিত লেন্স দিয়ে ছবি তুলেছে। শনি সম্বন্ধে আমরা যেমন অনেক কিছু জানি, আবার তার আরো অনেক গোপন রহস্য আমাদের অজানা রয়ে গেছে। ছোট্ট সাদামাটা টেলিস্কোপে চোখ লাগিয়ে শনির আংটি এবং বড়ো মাপের চাঁদগুলো দেখা যায়।
এই শনি গ্রহে প্রাণ সঞ্চার কি সম্ভব? বর্তমানে শনির তাপমাত্রা, চাপ এবং যেসব ব¯তু দিয়ে গঠিত- সেগুলোর বৈশিষ্ট্য বিবেচনা করলে দেখা যাচ্ছে যে প্রাণ সঞ্চারের ও মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকার জন্য গ্রহটি যথেষ্ট চরম ও উদ্বায়ী। তবে স্বয়ং গ্রহটি প্রাণের বিকাশের উপযোগী না হলেও তার কোনো কোনো চাঁদ বন্ধুসুলভ হতে পারে হয়ত। যেমন : এনসেলাডাস ও টাইটেনে অভ্যন্তনীণ সমুদ্র বা মহাসাগর রয়েছে। সেখানে প্রাণ সঞ্চারের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া চলে না।
বিষুবরেখা বরাবর শনির ব্যাসের পরিমাণ প্রায় একশোবিশ হাজার পাঁচশো (১২০,৫০০) কিলোমিটার, অর্থাৎ পৃথিবীর তুলনায় শনি নয়গুণ চওড়া। সূর্য থেকে শনি গড়ে ১.৪৪৮৯ বিলিয়ন কিলোমিটার দূরে রয়েছে; অথবা অন্যভাবে আমরা বলতে পারি যে শনি গ্রহ সূর্য থেতে নয় দশমিক পাঁচ (৯.৫) ’অ্যাস্ট্রোনমিকেল ইউনিট’ দূরে রয়েছে। সূর্য-পৃথিবীর গড় দূরত্ব হলো প্রায় একশো উনপঞ্চাশ (১৪৯) মিলিয়ন কিলোমিটার; সূর্য-পৃথিবীর দূরত্বকে একক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, এবং এই দূরত্বটি হলো ’এক অ্যাস্ট্রোনমিকেল ইউনিট’ (অট)। সূর্য ওঠার পরে, পৃথিবীতে সূর্যের আলো আসতে প্রায় আট মিনিট সময় লাগে, শনিতে সূর্যের আলো পৌঁছায় আশি মিনিট পরে।
যাহোক, সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে, পৃথিবীর হিসেবমতো গ্রহটির উনত্রিশ দশমিক চার (২৯.৪) বছর বা দশ হাজার সাতশোছাপ্পান্ন (১০,৭৫৬) দিন সময় লেগে যায়। অর্থাৎ, শনি-বছরের মেয়াদ প্রায় ত্রিশ বছর। যে কক্ষপথে থেকে শনি সূর্যের চারদিকে পরিক্রমণ করছে সেই কক্ষপথের সাপেক্ষে তার অক্ষটি ছাব্বিশ দশমিক সাততিন (২৬.৭৩) ডিগ্রী হয়ে কাত হয়ে রয়েছে। আমাদের পৃথিবীর অক্ষও কক্ষপথের সাপেক্ষে কাত হয়ে আছে; তবে শেষ বরফ যুগ শেষ হওয়ার পরে তেইশ দশমিক পাঁচশূন্য (২৩.৫০) ডিগ্রী পরিমাণ কাত হয়ে রয়েছে। কাত হয়ে রয়েছে বলে পৃথিবীর মতো শনি গ্রহেও ঋতু ও ঋতু পরিবর্তন হয়ে থাকে। (শনির ঋতু ও ঋতু পরিবর্তন ঘটে এভাবে : শনি-বছরের অর্ধেকটা সময় ধরে, অনেকটা যেনো সূর্যকে শ্রদ্ধা নিবেদনের কায়দায় আংটি পড়া শনি সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে, এসময়ে আংটিগুলোর শীর্ষ ভাগ সূর্যালোকে ঝলমলে আলোকিত হয়ে ওঠে। বাকি অর্ধেকটা সময়, শনি সূর্য থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকা অবস্থায় চলে আসে, এই সুযোগে সূর্য তখন শনির দক্ষিণ গোলার্ধে ও আংটিগুলোর নিম্নভাগে আলোকিত হয়ে আলোর বন্যা বইয়ে দেয়। তবে, এভাবে সূর্যকে পরিক্রমণরত শনির কক্ষপথে দুইবার যে সংক্ষিপ্ত সময়সীমার অবতারণা হচ্ছে, তখন কিšতু আংটিগুলোর প্রান্ত সূর্যের দিগন্তে অথবা ওপরে চলে যায় না, বরং সরাসরি সূর্যমুখি উন্মুক্ত দৃশ্যমাণ থাকে। শনি গ্রহের সূর্যমুখি হওয়া ও সূর্যবিমুখ হওয়ার ঘটনাদুটোতে সূর্য শনির বিষুব বা নিরক্ষ রেখা অতিক্রম করে, দিনরাত্রি সমান সমান হয় (পৃথিবীর মহাবিষুব ও জলবিষুব-য়ের অনুরূপ)। উত্তর ও দক্ষিণ – শনির দুই গোলার্ধই সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য সমপরিমাণ সূর্যালোক পায়। সূর্যকে পরিক্রমণ করতে শনির প্রায় ত্রিশ বছর লাগে, সূর্য প্রায় প্রতি পনেরো বছরে একবার বিষুব বা নিরক্ষ রেখা অতিক্রম করে থাকে।)।
শরি গ্রহে ঋতু পরিবর্তন ঘটছে; সৌজন্যে : নাসা
শনি গ্রহে, দিনের দৈর্ঘ্য পৃথিবীর হিসেবে মাত্র দশ দশমিক সাত (১০.৭) ঘন্টা; অর্থাৎ নিজের চারদিকে ঘুরে আসতে (যার জন্য দিন-রাত্রি হয়) পৃথিবীর চেয়ে দ্রæততর স্পিডে ঘুরছে। এই হিসেবে সৌরমÐলে শনি দ্বিতীয় হ্রস্ব বা খাটো দিনের স্থান দখল করে আছে। বৃহস্পতি হলো হ্রস্বতম দিনের অধিকারি, নিজের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে পৃথিবীর হিসেব মতো প্রায় এগারো ঘন্টা সময় লাগে।
তাই, আপাতদৃষ্টে মনে হয় যে বৃহস্পতি ও শনি, এই দুই গ্রহে সময় দ্রুত চলে; অর্থাৎ গ্রহদুটোর ঘুরে আসার জন্য এ-তো তাড়াহুড়ো কেনো? এর জন্য তাদের বি-শা-ল সাইজ, গ্যাস ও তরল জাতীয় (তথা ফ্লুয়িডের) উপাদানসমূহ এবং তাদের গঠন প্রক্রিয়ার প্রভাব দায়ী। এখন থেকে সাড়ে চার (৪.৫) বিলিয়ন বছর পূর্বে সৌরমডেল যখন রূপ নেয়া শুরু করে সে সময়ে অভিকর্ষ ঘুরপাক খাওয়া বা ঘূর্ণায়মান গ্যাস এবং ধূলা ও ধূলিকণাকে প্রচণ্ডবেগে টেনে টেনে এমন অবস্থায় নিয়ে আসে যে তারা গ্যাস-দানবে পরিণত হয়। প্রায় চার বিলিয়ন বছর পূর্বে শনি তার বর্তমান অবস্থায় চলে আসে। অর্থাৎ সৌরমÐলের বা সূর্য থেকে ষষ্ঠ গ্রহের অবস্থানে ঠঁাঁই নেয়। বৃহস্পতিও একই প্রক্রিয়ায় বর্তমান অবস্থানে চলে আসে। সূর্যের মতোই বৃহস্পতি ও শনি গঠিত হয়েছে প্রধানত হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম দিয়ে।
শনির কেন্দ্রস্থলে রয়েছে ধাতুসদৃশ লোহা ও নিকেলের ঘন মর্মব¯তু (কোর), এটিকে চারদিক থেকে ঘিরে রেখেছে পাথুরে শিলাজ ব¯তু ও অন্যান্য উপাদান; প্রচণ্ড চাপ ও তাপের জন্য মর্মব¯তুটি তাই তরল অথবা বায়ুবীয় অবস্থায় না থেকে রয়েছে কঠিন অবস্থায়। এই কঠিন মর্মব¯তুটিকে, খামে ভরে রাখার কায়দায় তরল ধাতব হাইড্রোজেনের স্তর ঘিরে রেখেছে; বৃহস্পতির মর্মব¯তুতেও এরকম ব্যবস্থা রয়েছে, তবে শনির ক্ষেত্রে মর্মব¯তুটি যথেষ্ট ছোটো।
একইভাবে, আমাদের মেনে নিতে কেমন যেনো লাগতে পারে গোছের অনুভূতি হলেও হতে পারে যে আমাদের সৌর মন্ড্লে শনিই একমাত্র গ্রহ যার গড় ঘনত্ব জলের চেয়ে কম! যার অর্থ হলো যে এই দানব গ্রহটিকে জলভর্তি দানব-সাইজের টবে (বা বাথটবে) রাখালে সে ভেসে থাকবে।
আবার, শনি গ্রহ আগা-গোড়া গ্যাস দিয়ে তৈরি গ্যাস দানব হওয়াতে, তার কোনো সত্যিকারের উপরিভাগ বা পৃষ্ঠদেশ বলে কিছু নেই। বরং গভীর অভ্যন্তর পর্যন্ত ঘূর্ণায়মান গ্যাস ও তরল ছাড়া আর কিছু নয় সে। তাই শরীরদেহ অক্ষত রেখে শনির পৃষ্ঠদেশে কোনো নভোযানই যেমন অবতরণ করতে পারবে না, আবার সুরুৎ করে মাঝখান দিয়ে ঢুকে অন্যদিক দিয়ে বেরিয়ে আসাও সম্ভব নয়। গ্রহের অভ্যন্তরে যে প্র-চ-ণ্ড চাপ ও তাপমাত্রা রয়েছে – ফলে, মুহূর্তের মধ্যেই নভোযান ধ্বংস হবে ও গলে বাষ্পীভূত হয়ে হারিয়ে যাবে।
মেঘের কম্বল মুড়ে থাকা শনির শরীর হালকা ডোরাকাটা দেখি আমরা, হলুদ, বাদামি ও ধূসর ছাই রঙের হরেক ছায়া তার শরীরে
খেলে যায়; সদাই তরল প্রবাহের ফোয়ারা ও ঝড়ঝঞ্ঝারও ঘাটতি নেই। শনির বায়ু মন্ডলের বিষুব রেখা অঞ্চলে সেকন্ড প্রতি পাঁচশো (৫০০) মিটার বেগে বায়ু প্রবাহিত হচ্ছে; পৃথিবীতে, হ্যারিকেন বায়ুর সর্বোচ্চ বেগ সেকন্ড প্রতি একশোদশ (১১০) মিটার। শনিতে, চাপও এ-তো শক্তিশালী প্রবল যে চাপের প্রবল চাপে গ্যাস তরল হয়ে যায়।
শনির শরীর হালকা ডোরাকাটা দেখি আমরা, হলুদ, বাদামি ও ধূসর ছাই রঙের হরেক ছায়া তার শরীরে খেলে যায়;উত্তর গোলার্ধে ষড়ভুজের প্যাটার্ণটি দেখা যাচ্ছে, সৌজন্যে : নাসা, জেপিএল
শনির উত্তর গোলার্ধে -বায়ুমণ্ডলের আরেকটি চমকপ্রদ বৈশিষ্ট্য হলো যে সেখানে রয়েছে ছয়বাহুবেষ্টিত বা ষড়ভুজের দ্রæত সরু বায়ু প্রবাহ (জেট স্ট্রীম)। এই ষড়ভুজের প্যাটার্ণটির পরিসর প্রায় ত্রিশ হাজার (৩০, ০০০) কিলোমিটার, দেখতে তরঙ্গায়িত, এবং (ষড়ভুজের কেন্দ্রে) ঘন্টা প্রতি তিনশো বাইশ (৩২২) কিলোমিটার বেগে সাঁই সাঁই করে যে তীব্র ঝড় তোলে – এমনটি কিন্তু সৌরমন্ডলের কোথাও দেখা যায় না।
শনির ’ম্যাগনেটোস্ফিয়ার’ রয়েছে, এবং সেটির জোর বা তেজ বৃহস্পতিটির চেয়ে কম, তবে পৃথিবীরটির চেয়ে পাঁচশো আটাত্তর (৫৭৮) গুণ শক্তিশালী। কাজেই, স্বয়ং শনি গ্রহ, তার আংটিসমূহ এবং অনেকগুলো চাঁদ সম্পূর্ণভাবে সুবিশাল ম্যাগনেটোস্ফিয়ার এলাকার চৌহদ্দির মধ্যে অবস্থান করছে। মহাশূন্যে ম্যাগনেটোস্ফিয়ার এমন একটি এলাকা যেখানে চার্জযুক্ত বিদ্যুৎ কণিকাদের আচরণ সৌর বায়ুর চেয়ে বরং শনির চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বেশি প্রভাবিত হয়ে থাকে, যাকে মহাশূন্যীয় আবহাওয়া বলা হয় (দেখুন : মহাশূন্য প্রযুক্তি ও অনুসন্ধানের সন্ধানে, নাদিরা মজুমদার, বাংলা একাডেমি)।
চুম্বক ক্ষেত্রের চুম্বক রেখা বরাবর গ্রহের বায়ুমণ্ডলের চার্জযুক্ত কাণিকারা সর্পিল গতিতে গতিশীল হয়ে ঊষামেরু বা উত্তর মেরু (অঁৎড়ৎধ) সৃষ্টি করে। অবশ্য পৃথিবীতে, আমরা যে ঊষামেরু দেখি সেক্ষেত্রে চার্জযুক্ত কণিকারা আসে সৌর বায়ু থেকে। রবোট নভোযান ক্যাসিনির পর্যবেক্ষণ থেকে আমরা জানি যে শনির কিছু কিছু ঊষামেরু বৃহস্পতির ঊষামেরুর অনুরূপ এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা সৌর বায়ু দ্বারা প্রভাবিত হয় না। পরিবর্তে, বরং শনির চাঁদগুলোর ও চুম্বক ক্ষেত্রের দ্রুত গতিময়তার কারণে বিচ্যুত কণিকারা সম্মিলিত হয়ে ঊষামেরু সৃষ্টি করে। তবে, ’সূর্যের অনুপস্থিতিজনিত’ ঊষামেরু সম্বন্ধে আমাদের জ্ঞান এখনো অসম্পূর্ণ রয়েছে।
শনির চাঁদ
চিত্তাকর্ষক আংটি সিস্টেম নিয়ে গর্বিত শনি-র গর্ব করার মতো আরো রয়েছে বড়ো, মাঝারি, ছোটো ইত্যাদি নানা সাইজের অন্তত একশো ছেচল্লিশটি চাঁদ নিয়ে বি-শা-ল এক উপগ্রহীয় সংসার। এইসব চাঁদ বা উপগ্রহের মধ্যে যেগুলো খুব বড়ো সাইজের, সেগুলো সক্রিয়, তারা গ্রহ সদৃশ।
বৃহত্তম চাঁদ টাইটেন দিয়ে শুরু করা যাক। সাইজে টাইটেন (ঞরঃধহ) সৌর মÐলের প্রথম গ্রহ বুধের চেয়ে বড়ো। এর বায়ুমণ্ডলে কমলা রঙের ও কুয়াশাচ্ছন্ন; প্রায় সাড়ে তিন (৩.৫) বিলিয়ন বছর পূর্বে – তখনো যখন প্রাণের বিকাশ ঘটেনি আমাদের পৃথিবীর বায়ুমÐলও সম্ভবত টাইটেনের অনুরূপ ছিলো। রবোটিক নভোযান ক্যাসিনি’র কর্মকুশলতার কারণে জানি যে টাইটেনের বায়ুমণ্ডলে ও আকাশ থেকে নেমে আসা বৃষ্টির জলে জটিল, জৈব অণু (অর্গানিক মলিকিউল) রয়েছে, অর্থাৎ প্রাণ সঞ্চারের মূলসামগ্রী রয়েছে। টাইটেনকে পর্যবেক্ষণ করে আমরা পৃথিবীতে ও মহাজগতের অন্যত্র প্রাণ সঞ্চারের সম্ভাব্য উপকরণ সম্বন্ধে আমাদের উপলব্ধি ও জ্ঞানার্জনে সাহায্য করবে।
পৃথিবীর সঙ্গে টাইটেনের পৃষ্ঠদেশের চমকপ্রদ মিল রয়েছে বটে, তবে অ-মিলও রয়েছে। যেমন : টাইটেনের পর্বতমালা, বালিয়াড়ি ইত্যাদি প্রধানত বরফ দিয়ে তৈরি, পৃথিবীর মতো শিলা দিয়ে নয়, তার নদী-নালা, হ্রদ এবং সমুদ্র তরল জলের বদলে মিথেন ও ইথেন গ্যাসে ভর্তি। তবে তার পৃষ্ঠদেশের নিচেয় তরল জলের সাগর মহাসাগর থাকতে পারে কিšতু। আমরা অবশ্য এখনো জানি না যে – মিশ্রিত রসায়ন আদৌ প্রাণ সঞ্চারের সহায়ক হবে কি হবে না। অথবা পৃথিবীর মহাসাগরের মেঝেতে, যেখানে সূর্যালোক কখনো যায় না, চারদিকে শুমশাম অন্ধকার সেখানেও ’হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট’ যে শক্তি নিঃসরণ করে, ফলস্বরূপ সেখানে প্রাণের বিকাশ ঘটে, টাইটেনের ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা থাকলেও থাকতে পারে!
টাইটেনের হাইড্রোকার্বন সমুদ্র
এনসেলাডাস, যার রয়েছে গুপ্ত মহাসাগরের মজুত
এনসেলাডাস, শনির বৃহত্তম চাঁদ নয়, বৃহত্তম চাঁদের মর্যাদা টাইটেনের, এমনকি শনির নিকটতম চাঁদ হওয়ার গৌরবও তার নেই। বরং পাঁচশো (৫০০) কিলোমিটার চওড়া এনসেলাডাস-কে যুক্তরাষ্ট্রের ষষ্ঠ বৃহত্তম অঙ্গরাজ্য আরিজোনার ভেতরে অনায়াসে বসিয়ে দেয়া যাবে। তা সত্তে¡ও এনসেলাডাস কিšতু আমাদেরকে বিমুগ্ধ করার মতো চমৎকার একটি নিজস্ব জগত তৈরি করে নিয়েছে। সৌর সব কয়টি চাঁদের গর্ব করার মতো নিজস্ব ’গ্রহীয় আংটি’ নেই, কিšতু এনসেলাডাস-য়ের নিজের সৃষ্ট আংটি রয়েছে। তাছাড়াও, তার হিমশীতল উপরিভাগে বা পৃষ্ঠদেশে বি-শা-ল মাপের ফাটল/চিড় রয়েছে, যাকে বলা হয় ’টাইগার স্ট্রাইপস’। আ-রো চমৎকারিক বিষয় হলো যে ’টাইগার স্ট্রাইপস’-য়ের নিচে কোথাও গভীরে রয়েছে বি-শা-ল মহাসাগর। রবোটিক নভোযান ’ক্যাসিনি’ অনুসন্ধান করে বলে যে এখানে প্রাণ সঞ্চারে দরকারি সব উপকরণের সমারোহ রয়েছে। তার মানে, আমাদের পৃথিবী ছাড়িয়ে অন্যত্র তথা এনসেলাডাস-য়ে প্রাণ সঞ্চারের ভিত্তি-প্রস্তরের অনুসন্ধান করতে হলে পরতের পর পরত খুলে খুলে ’টাইগার স্ট্রাইপস’-য়ে অনুসন্ধানপর্ব অব্যাহত রাখতে হবে।
এনসেলাডাসের ’টাইগার স্ট্রাইপস’ ফাটলের বিভিন্ন বিন্দু থেকে বি-শা-ল পরিমাণ জলীয় বাষ্প তীব্র বেগে দমকে দমকে বেরিয়ে আসছে ও মহাশূন্যে স্প্রে করে ছড়িয়ে দিচ্ছে। টাইটেনের মিথেন ও ইথেন গ্যাসে ভর্তি হ্রদে গিয়েও পড়ছে।
এনসেলাডাসের পুচ্ছসদৃশ গেইজারের বিস্তৃত অবাধ দৃশ্যপট, চিত্র : নভোযান ক্যাসিনি, ২১ নভেম্বর ২০০৯,
সৌজন্যে : উইকিপিডিয়া CC BY 2.0
২০১৫ সালে, চাঁদের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে আসা প্র¯্রবণ/ ফোয়ারার একটিকে ভেদ করে ক্যাসিনি ভেতরে ঢুকে পড়েছিলো। নভোযানটি সেখানে ’হাইড্রোজেনের অণু’ সনাক্ত করে, এই গ্যাসকে ’মাইক্রোবের চকোলেট বা ক্যাÐি’ বলা হয়। ক্যাসিনি অবশ্য প্রাণসত্ত¡া সনাক্ত করেনি, তবে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রতিপন্ন করে যে প্রাণসত্ত¡ার জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ : জল, ’হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট’ থেকে প্রাপ্ত শক্তির উৎস, এবং নির্দিষ্ট রসায়ন – যেমন কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন ও অক্সিজেন রয়েছে। কাজেই, মহাশূন্যে প্রাণের সন্ধানে শনি গ্রহের এনসেলাডাসের ফাটলে আমাদেরকে যেতে হবে। (হয়ত আমরা তখন জানব যে পৃথিবীর প্রারম্ভে যে ধরণের ’হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট’ প্রাণ সঞ্চারে ভ’মিকা নিয়েছিলো – এনসেলাডাসের ’হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট’গুলোরও একই ধরণের ভ’মিকা নেয়ার সামর্থ্য রয়েছে।
মাইমাস
শনির চাঁদ মাইমাস (গরসধং) যদি বাহাদুরি দেখাতে চায় তো সে তার ভয়ঙ্কর দর্শণ বি-শা-ল মাপের আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখগুলো দেখিয়ে আমাদের ভীতসন্ত্রস্ত করে দিতে পারে; ’স্টার ওয়ার্স’ মুভিতে ডেথ স্টারের কথা মনে করিয়ে দেবে। তবে তাসত্তে¡ও হয়ত মাইমাসের উপরিভাগের নিচে মহাসাগর থাকতে পারে কিন্তু !
শনির ফটোজেনিক চাঁদগুলো
শনির যে কয়টি চাঁদকে সবচেয়ে ফটোজেনিক বলে প্রচার করা হয় তারা সবাই কিšতু ছোটো সাইজের। যেমন: ডায়োনী (উরড়হব) ও রীয়া (জযবধ); অজ¯্র জ্বালামুখে সমৃদ্ধ এই দুই তুষার সর্বস্ব চাঁদের রয়েছে শিলাজ বা পাথুরে ’মর্মস্থল’ (কোর); সাইজের দিক দিয়ে তারা টাইটেনের চেয়ে ছোটো বটে তবে এনসেলাডাস ও মাইমাসের চেয়ে বড়ো। আবার, হাইপেরিয়ান (ঐুঢ়বৎরড়হ) দেখতে অদ্ভুদ দানব-স্পঞ্জের মতো বা প্রবালপ্রাচীরও হতে পারে।
হাইপেরিয়ান
অথচ, সৌর মÐলের অন্যসব ব¯তুরা যাচ্ছেতাইভাবে অজ¯্র জ্বালামুখ নিয়ে বিদ্যমান! কেমন নাটকীয় বৈপরীত্য, তাই না! লেইপেটাস (ওধঢ়বঃঁং) নামক চঁদটিও কম যায় না কিšতু। সে আসলে দুই মুখো চাঁদ, তার অর্ধেকটা হিমেল শীতল, তুষারাবৃত, বাকি অর্ধেকটা গাঢ় রঙের; ফীবী (চযড়বনব) নামক ধূমকেতু-সদৃশ চাঁদের ব¯তু বা পদার্থ লেইপেটাস-য়ের অর্ধেকটা ঢেকে বা আবৃত করে গাঢ় রঙ করে রেখেছে। আবার, প্যান (চধহ) নামক চাঁদটিও ’শোউম্যানশিপ’-য়ে কম যায় না কিšতু! অভিকর্ষ বলের তেজ দেখিয়ে ’প্যান’ শনির আংটিগুলোর ব¯তু কেড়ে ছিনিয়ে নিয়ে নিজস্ব একটি চেহারা তৈরি করেছে, – দেখতে কারো কারো বা মনে হবে ’ফ্লাইং সসার’ যেনো, কারো বা মনে হবে প্রিয় খাদ্য ’ডাম্পলিং’-য়ের মতো।
প্যান
যাহোক, আপাতদৃষ্টে মনে হয় যেনো যে এইসব ক্ষুদে সাইজের চাঁদ নিজেদেরকে আলোকচিত্র গ্রহণের উপযোগী করে সুন্দর আকর্ষণীয় ও সুদৃশ্য দেখাতে সচেতন!
শনি-র আংটি
শনি-কে ঘিরে আংটি, রিং, যা-ই বলি না কেনো – সে রকম কিছু নেই, ভাবতে পারবেন? কেমন যেনো সম্পূর্ণ নয়, সব অসম্পূর্ণ মনে হবে না কি? যেনো বা চাঁদ ছাড়া জোয়ারভাটা বা রবিবার ছাড়া শনিবার এমনকি লবণ ছাড়া মাছের ঝোল! অথচ কি আশ্চর্য্য যে একটা সময়ে, আর সব আংটিবিহীন গ্রহের মতো শনিও মহাজগতের দুয়ারে একা একা ঘুরে বেড়িয়েছে, তরুণ সৌর মÐলের অসংখ্য বরফকৃত মার্বেলের মধ্যে সে-ও ছিলো তাদেরই একটি।
শনির আংটি কবে কখন কিভাবে আকার নিলো, তৈরি হলো বলা সহজ নয়। অনুমাণ করা হয় যে মাত্র দশ (১০) মিলিয়ন থেকে একশো (১০০) মিলিয়ন বছর পূর্বে তাদের জন্ম হয়; সম্ভবত কাছাকাছি গতিশীল ধূমকেতু, গ্রহাণু, গ্রহাণুপুঞ্জ এবং এমনকি চাঁদ বা চাঁদগুলোকে পর্যন্ত শনির শক্তিশালী অভিকর্ষ পাকড়াও করে ও টুকরো টুকরো খণ্ড-বিখণ্ড করে দেয়। এই সব ছিন্নাংশ বিরামহীনভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়, বরফের টুকরো, বরফ কুচি, শিলা ও ধূলাবালি দিয়ে সৃষ্টি হয় আংটিগুলোর। আবার, কারো কারো ধারণা যে যখন স্বয়ং শনি গ্রহ বর্তমান আকার অবয়ব ধারণ করে সেসময়ে তারই অব্যবহৃত ব¯তু (লেফটওভার) থেকে আংটিগুলোর জন্ম হয়। কিšতু আংটিগুলোর জন্ম প্রক্রিয়াকালীন সময়ে যে মহাজগতীয় শোচনীয় নৈরাজ্যের অবতারণা ঘটে তাকে অতিক্রম করে কেমন করে যে এমন অসাধারণ, তুলনাহীন রূপ লাবণ্য প্রকাশিত হলো সেটি একটি দিব্য রহস্য হয়ে রয়েছে। আমরা কখনোই হয়ত সম্পূর্ণভাবে তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হবো না, পারব না।
অসংখ্য আংটিতে ঘিরে থাকা শনি, সৌজন্যে : হাবল হেরিটেজ
আমাদের সৌর মণ্ডল, একমাত্র শনির আংটিগুলোই সবচেয়ে ব্যাপক, বিস্তৃত; যেমন : এ-তোই বিস্তৃত যে পৃথিবী ও পৃথিবীর চাঁদের মাঝখানের জায়গাটুকুতে আংটিগুলোকে বসাতে চাইলে জায়গার কুলান হবে না এবং তার আংটি সিস্টেমও জটিল। অসংখ্য ছোট্টো ছোট্টো কণিকা, সাইজে মাইক্রো মিটার থেকে কয়েকমিটার বড়ো, শনিকে পরিক্রমণ করছে। আংটির কণিকারা প্রায় সম্পূর্ণভাবে জলজ বরফ ও সামান্য শিলাজ বা পাথুরে উপাদান দিয়ে তৈরি হয়েছে।
শনির আংটি, ক্যাসিনির তোলা প্রতিচ্ছবি
সরকারিভাবে স্বীকৃত একশো ছেচল্লিশটি আংটির মধ্যে শনি থেকে শুরু করে প্রথম সাতটি আংটিকে প্রধান আংটির মর্যাদা দেয়া হয়েছে। আংটিগুলোকে – তারা কখন আবিষ্কৃত হয়েছে সেই ক্রম অনুসারে ইংরেজি অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে এভাবে : গ্রহের বহির্গামিতা অনুযায়ী ডি, সি, বি, এ, এফ, জি, এবং ই (উ, ঈ, ই, অ, ঋ, এ ্ ঊ)। আবার এই সব আংটির অনেকেরই রয়েছে নিজস্ব ডিভিশন বা শাখা, সাবডিভিশন বা উপশাখা, ফাঁকা বা শূন্যস্থান – যার মধ্যে বিদ্যমাণ রয়েছে বিবিধ কাঠামো ও ছোট্টো ক্ষুদে চাঁদের (মুনলেটস) সমারোহ। যেমন, ক্যাসিনি ডিভিশন হলো ফাঁকা বা শূন্যস্থান – প্রায় চার হাজার সাতশো (৪,৭০০) কিলোমিটার চওড়া; এই ফাঁকা শূন্যস্থানের একদিকে ’আংটি বি’ অন্য দিকে ’আংটি এ’ অবস্থান করছে।
অভ্যন্তর থেকে সর্বোচ্চ বহির্মুখী আংটিগুলো হলো : ডি, সি এবং বি আংটি তিনটি। ডি আংটিটি শনির সবচেয়ে নিকটতম, এবং অত্যন্ত ক্ষীণ, মলিন, ফ্যাকাশে; এবং সাইজে এ-তো-টা-ই বি-শা-ল যে অনায়াসে এক বিলিয়ন পৃথিবীকে ভরে দেয়া যাবে। এ, বি এবং সি (অ, ই ্ ঈ) মূলত প্রধান আংটি।
আংটিগুলোর শ্রেণিবিন্যাস, সৌজন্যে : উইকিপিডিয়া
বাকি তিন দানব গ্রহ – বৃহস্পতি, ইউরেনাস ও নেপচুন, তাদের প্রতিটিরই নিজস্ব আংটি সিস্টেম রয়েছে বটে তবে তাদের কারোরই কিন্তু শনির আংটি সিস্টেমের মহিমা বিশালতার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সামর্থ্য নেই। বিজ্ঞানীদের কারো কারো মতে, শনি গ্রহের অভিকর্ষ আংটিগুলোকে নিজের ভেতরের দিকে টানছে, এবং চুম্বক ক্ষেত্র রয়েছে বলে আংটিগুলো একদিন শনির বায়ুমণ্ডলে ধূলাময় ’আংটি বৃষ্টি’ হয়ে পড়তে থাকবে। শনির আংটি সৌন্দর্য্য হারিয়ে যাবে একদিন, শুনতে খারাপ লাগছে? লাগবেই তো; অবশ্য বড়ো সান্তনা হলো যে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে যাবে তিনশো (৩০০) মিলিয়ন বছরের মধ্যে, আমরা তখন থাকবো না।
ক্যাসিনি আত্মহত্যা করে : ২০১৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর নভোযান ক্যাসিনি দানব গ্রহ শনির কাছ থেকে শেষ বিদায় নেয়। তারপর সে শনির ঘন বায়ুমণ্ডলে ঝাপিয়ে পড়ে, তার অতি দরকারি অ্যান্টেনা যতোক্ষণ পর্যন্ত পৃথিবীমুখি ছিলো ততোক্ষণ পর্যন্ত গভীর কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্গে ক্যাসিনি বৈজ্ঞানিক উপাত্ত পাঠানো অব্যাহত রেখেছিলো। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই ক্যাসিনি শনির আকাশে জ্বলে পুড়ে ছাড়খার হয়ে উল্কাপিণ্ডের মতো নিঃশেষ হয়ে যায়।
Leave a Reply