নিজস্ব প্রতিবেদক
বায়োব্যাংক হল এক ধরণের বায়োরিপোজিটরি যা গবেষণায় ব্যবহারের জন্য জৈবিক নমুনা সংগ্রহ করে। বায়োব্যাংক চিকিৎসা গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। একটি বায়োব্যাংকে বিভিন্ন ধরণের নমুনা সংগ্রহ করে রাখা হয় যেমন রক্ত, প্রস্রাব, ত্বকের কোষ অঙ্গ টিস্যু ও অন্যান্য উপাদান। বায়োব্যাংক এই নমুনাগুলোকে ভালো অবস্থায় রাখে যতক্ষণ না পর্যন্ত একজন গবেষক তাদের একটি পরীক্ষা পরিচালনা করতে বা একটি বিশ্লেষণ সম্পাদন করতে চান। প্রকৃতপক্ষে, অনুবাদমূলক ওষুধ পদ্ধতি এগিয়ে নেয়াসহ চিকিৎসা গবেষণা ও সেবায় বায়োব্যাংকের গুরুত্ব অপরিসীম। এই গুরুত্বকে অনুধাবন করে আজ বৃহস্পতিবার ৪ জুলাই ২০২৪ইং তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ ডা. মিল্টন হলে অনুষ্ঠিত হলো অনুবাদমূলক ওষুধ পদ্ধতি, সংস্থান ও দক্ষতা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনের গবেষণা এবং উন্নয়নে বায়োব্যাংকের ভূমিকা শীর্ষক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভা।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোঃ নূরুল হক (Prof. Dr. Deen Mohd. Noorul Huq) বলেছেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা যে সকল ঘোষণা দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন হয়েছে অথবা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন আর তা বাস্তবায়ন হয় নাই এমন দৃষ্টান্ত একটিও নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেহেতু চেয়েছেন বাংলাদেশে অবশ্যই বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান প্রশাসন বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠায় সর্বদা প্রস্তুত ও অঙ্গীকারাবদ্ধ। মাননীয় উপাচার্য বলেন, গ্রামের লোকেরা বলে থাকেন শরীরে বাতাস লেগেছে, তারপর জ্বর হয়েছে, বমি হয়েছে মানুষটা মরে গেলো।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এই বর্তমান যুগে এসব কথার দিন শেষ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী বাতাস লাগার কারণে মানুষ মারা যায় প্রকৃত বিষয় তো আর তা নয়। একজন মানুষ বাতাস লাগার পরে কেন মৃত্যুবরণ করলো এর সঠিক কারণ গবেষণার মাধ্যমেই খুঁজে বের করা সম্ভব। বর্তমান বিশ্বে ‘ওয়ান হেলথ এপ্রোচ’ অত্যন্ত একটি আলোচিত বিষয়। আর এটা বাস্তবায়ন করতে হলে বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নাই। চিকিৎসা গবেষণা ও সেবার উন্নয়নে বায়োব্যাংক একটি অমূল্য সম্পদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সমৃদ্ধশালী বিশ্বমানের বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হবে। যেখানে পর্যাপ্ত ডাটা ও নমুনা সংরক্ষণ করা হবে, যা যুগে যুগে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাসেবা, গবেষণা, রোগ নির্ণয় ও রোগ প্রতিরোধে বিরাট অবদান রাখতে সক্ষম হবে। বিভিন্ন সময়ে মহামারী, ক্যান্সারের মতো রোগের গবেষণা ও চিকিৎসায় বায়োব্যাংকের অবদান অনস্বীকার্য।
অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা হিসেবে আয়ারল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিন এর সহকারী অধ্যাপক ডা. আরমান রহমান ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনের গুরুত্ব এবং ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনকে বাংলাদেশের চিকিৎসাক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রয়োগের লক্ষ্যে ট্রান্সলেশনাল গবেষণার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরার পাশাপাশি এ গবেষণায় বাংলাদেশে বায়োব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতা তুলে ধরেন। আলোচনা সভায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দিক নির্দেশনা মতো শিক্ষা ও গবেষণা এবং দেশের সার্বিক স্বাস্থ্যখাত এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায় বাংলাদেশে অবস্থান জোরদার করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল এবং সমন্বয়কারী ডা. আরমান রহমান বায়োব্যাংক স্থাপনের পরবর্তী ধাপ আরো দ্রুত ফলপ্রসূভাবে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে একত্রে কাজ করার কর্মপরিকল্পা করেন।
আজকের অনুষ্ঠানে এক্সপার্ট প্যানেল-এ ইউজিসির অধ্যাপক ডা. সজল কৃষ্ণ ব্যানার্জী এবং ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোঃ সায়েদুর রহমান এ ব্যাপারে তাদের মূল্যবান বক্তব্য রাখেন। আলোচনা অনুষ্ঠানে অনুষ্ঠানে অত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ ছয়েফ উদ্দিন আহমদ, উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান (Prof. Dr. Mohammed Atiqur Rahman), উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডা. মনিরুজ্জামান খান, রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল হান্নান, প্রক্টর অধ্যাপক ডা. মোঃ হাবিবুর রহমান দুলাল, ডিন অধ্যাপক ডা. দেবব্রত বনিক প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ এই আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের এনাটমি ও জেনেটিক্স ও মলিকুলার বায়োলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. লায়লা আঞ্জুমান বানু। সঞ্চালনা করেন এনাটমি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. শারমিন আক্তার সুমি।
সভায় অন্য বক্তারা জানান, বাংলাদেশের জন্য বিশ্বমানের বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি ধারণ করার সামর্থ্য রয়েছে বাংলাদেশের, যা চিকিৎসা গবেষণায় নতুন দিগন্ত উম্মোচন করবে। বায়োব্যাংক একাডেমিক-বৈজ্ঞানিক গবেষণাকে শক্তিশালী করতে ভূমিকা রাখতে পারে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের মতে, টিউমারের মধ্যকার সেলুলার ও আণবিক ভিন্নতা, বিভিন্ন হোস্ট ইমিউন প্রতিক্রিয়া, খাদ্য, পরিবেশগত প্রভাব, জীবনধারা এবং রোগী জনমিতিসহ বিভিন্ন কারণ ক্যান্সারের ওষুধ বা বায়োমার্কার এর কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে। সুতরাং ক্যান্সারের মতো রোগের ক্ষেত্রে সকলের জন্য একই পদ্ধতি বা সকলকে একই পাল্লায় বিবেচনা করার ধারণাটি বর্তমানে অপ্রচলিত।
পৃথকভাবে ক্যান্সার-যতেœর নীতিগুলি প্রয়োগ করে কার্যকর ওষুধ বায়োমার্কারসমূহ তৈরির কৌশল ডিজাইন করা অত্যন্ত প্রয়োজন। ড্রাগ বায়োমার্কার টেস্টিং এবং ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল তালিকাভুক্তিতে জাতিগত ভিন্নতা বিদ্যমান। বেশিরভাগ অনুমোদিত ক্যান্সারের ওষুধ বায়োমার্কার বাস্তবতার কারণেই ককেশীয় জনগোষ্ঠীর উপর পরীক্ষা করা হয়েছে। ক্লিনিক্যাল ডেটাসহ নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত বায়োম্যাটেরিয়ালের অভাব একটি বড় কারণ। যার ফলে অনেক এশিয়ান দেশগুলি বায়োমার্কার স্টাডিতে কম প্রতিনিধিত্ব করছে। তাই বাংলাদেশে অনুবাদমূলক গবেষণা বিকাশের জন্য একটি বিশ্বমানের বায়োব্যাংক তৈরি করা সময়েরই দাবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োব্যাংকের মতো বিষয়গুলো ধারণ করার জন্য সক্ষমতা রয়েছে। বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা করওেত পারলে স্থানীয় অনুবাদমূলক গবেষণাকে ত্বরান্বিত করতে সহায়তা করবে বলে তারা জানান।
ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন সম্পর্কে জানানো হয়, ট্রান্সলেশনাল মেডিসিন যাকে অনুবাদমূলক বিজ্ঞানও বলা হয়। বায়োমেডিকেল এবং জনস্বাস্থ্য গবেষণার মধ্যে একটি শৃঙ্খলা যার লক্ষ্য ডায়গনিস্টিক টুল, ওষুধ, পদ্ধতি, নীতি এবং শিক্ষার ফলাফলগুলিকে অনুবাদ করে ব্যক্তি এবং সম্প্রদায়ের স্বাস্থ্যের উন্নতি করা। ট্রান্সলেশনাল মেডিসিনকে ট্রান্সলেশনাল সায়েন্সও বলা হয়। এটি এমন একটি ফর্ম যা বায়োমেডিকেল সায়েন্সের মৌলিক বিজ্ঞানের দিকগুলির ক্লিনিকাল অনুশীলন অ্যাপ্লিকেশন বিকাশ করে অর্থাৎ এটি চিকিৎসা অনুশীলনে মৌলিক বিজ্ঞানকে ফলিত বিজ্ঞানে অনুবাদ করে। অনুবাদমূলক ওষুধের লক্ষ্য হল শৃঙ্খলা, সংস্থান, দক্ষতা এবং কৌশলগুলিকে একত্রিত করা যাতে প্রতিরোধ, রোগ নির্ণয় এবং থেরাপিতে উন্নতি করা যায়।
তদনুসারে, অনুবাদমূলক ওষুধ একটি অত্যন্ত আন্তঃবিভাগীয় ক্ষেত্র, যার প্রাথমিক লক্ষ্য হল বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাকে উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করার জন্য পৃথক স্তম্ভের মধ্যে বিভিন্ন প্রকৃতির সম্পদ একত্রিত করা। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে, উন্নত ক্লিনিকাল ফলাফলগুলিতে গবেষণাকে সফলভাবে অনুবাদ করার জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতাগুলিতে পেশাদার প্রশিক্ষণ প্রদানের জন্য বেশ কয়েকটি শিক্ষামূলক প্রোগ্রামও আবির্ভূত হয়েছে। যার প্রধান উদ্দেশ্য হল অনুবাদমূলক ওষুধ পদ্ধতি, সংস্থান এবং দক্ষতা ব্যবহার করে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা। বায়োমার্কার, ওমিক্স সায়েন্স, সেলুলার এবং মলিকুলার বায়োলজি, ডেটা মাইনিং এবং ম্যানেজমেন্ট, প্রিসিশন মেডিসিন এবং কম্প্যানিয়ন ডায়াগনস্টিকস, ডিজিজ মডেলিং, ভ্যাকসিন এবং কমিউনিটি হেলথ কেয়ার হল অনুবাদমূলক মেডিসিন ক্ষেত্র।
গত ৩ জুন বাংলাদেশের বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা শীর্ষক একটি উচ্চপর্যায়ের অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য অধ্যাপক ডা. দীন মোঃ নূরুল হক মহোদয় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মত বাংলাদেশে বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠা এবং এই বায়োব্যাংকে একটি রিজিওনাল গবেষণার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গড়ে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেন এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠার বিষয়ে সার্বিক সহযোগিতার অঙ্গীকার করেন। আরো উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে একটি বিশ্বমানের বায়োব্যাংক প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ ২০২২ সালে জাতিসংঘ সাইন্স সামিট থেকে এই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। দেশ এবং বিদেশে বিভিন্ন বৈঠকের ধারাবাহিকতায় অংশ হিসেবে আজকের এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
Leave a Reply