হাসান আলী
কেউই চান না জীবনের শেষ দিনগুলো অসম্মান, অমর্যাদা, অনুগ্রহ, কৃপায় অতিবাহিত করতে। সবাই চায় পরিবার-পরিজনের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ ও স্বস্তিদায়ক প্রবীণজীবন। শুধু চাইলেই কি এমন জীবন পাওয়া যায়? অবশ্যই না। সম্মানজনক-স্বস্তিদায়ক প্রবীণজীবনযাপনে ব্যক্তি, সমাজ এবং রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। বার্ধক্য ব্যক্তির নিজস্ব বিষয়। তারপরও বার্ধক্য ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে। বার্ধক্যকে মোকাবেলা ব্যক্তিকে করতে হয়, বিধায় এটির চ্যালেঞ্জ গ্রহণও ব্যক্তির ওপর বর্তায়। ব্যক্তি সমাজ ও রাষ্ট্রের অংশ। ব্যক্তির সক্রিয় ভূমিকার কারণে সমাজ ও রাষ্ট্র ভাবনায় প্রবীণ বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব পায়।

যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতার কাছে মানুষ পরাস্ত হয়ে গেছে। মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ যখন ভয়ংকর প্রশ্নের সম্মুখীন, ঠিক সে সময় প্রবীণদের সন্তানের ওপর ভরসা করা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। আমাদের প্রত্যেকের শিক্ষা, কর্ম, দাম্পত্য, সামাজিক, রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে কমবেশি ভবিষ্যৎ ভাবনা থাকে। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কেমন হবে সে বিষয়ে নানা ধরনের স্বপ্ন থাকে প্রত্যেক পিতা-মাতার। শুধু প্রবীণজীবনকে নিয়তির কাছে সমর্পণ করে থাকি। ভাগ্যে যা আছে তাই হবে- এই নীতি মেনে চলার প্রবণতা রয়েছে।
শিক্ষা জীবনকে অর্থবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ করতে স্কুলে যাওয়ার বয়স না হতে, সেখানে পাঠানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায়। শিশুরা গৃহ শিক্ষক, কোচিং, স্কুলের পড়ার চাপ মোকাবেলা করে চাকরিজীবনে প্রবেশের সনদ জোগাড় করে। আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষা সমাপ্ত করতে ২৭-২৮ বছর পেরিয়ে যায়। চাকরি বা ব্যবসায় ঢুকতে অনেকেরই বয়স ৩০ বছর বা তারও বেশি হয়ে যায়। কেউ কেউ ২০ বছর বয়সে চাকরি বা ব্যবসায় যোগ দেয়ার সুযোগ পান। এ সংখ্যাটা অনেক কম। আবার পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায়, দেশে উচ্চশিক্ষিত বেকারের হার দিন দিন বাড়ছে।

পরিকল্পনাহীন উচ্চশিক্ষা যেমন সম্পদের অপচয়, একই সঙ্গে অদক্ষ, অযোগ্য উচ্চশিক্ষিত মানুষ সমাজের বোঝা। যারা চাকরি কিংবা ব্যবসার সুযোগ পান, তারা উল্কার গতিতে প্রবীণ হয়ে যান। স্বপ্নের মতো ৩০টা বছর পার করে দেন। আয়নায় পাকা চুল দেখে মন খারাপ হয়ে যায়। চুলে কলপ লাগিয়ে বার্ধক্যের চিহ্ন মুছে দেয়ার চেষ্টা করেন। পড়ে যাওয়া দাঁতের স্থানে নকল দাঁত লাগিয়ে হাসেন। মুখের বলিরেখা মুছে দেয়ার জন্য নানা ধরনের ক্রিম মাখেন। আসন্ন বার্ধক্যকে সহজ ও স্বাভাবিকভাবে গ্রহণের জন্য মানসিক এবং শারীরিক প্রস্তুতি যৎসামান্যই লক্ষ্য করা যায়। আয়-রোজগার করা এবং সক্ষম থাকার জন্য প্রায় ৩০ বছর পর্যন্ত প্রস্তুতি নিতে হয়।
লাখ লাখ ছেলেমেয়ে পড়াশোনা করছে, জ্ঞান অর্জন করছে। এর প্রধান কারণ দরিদ্রতা থেকে মুক্তি লাভ এবং তুলনামূলক উন্নত জীবনযাপন করার স্বপ্ন। চাকরি জীবনে মানুষ সর্বোচ্চ পদে আসীন হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। অনেকে নিজের পদ-পদবি আঁকড়ে থেকে চাকরিজীবন পার করার প্রাণান্তকর চেষ্টা চালিয়ে যান। নিজের আয় থেকে পরিবার-পরিজন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবকে সহযোগিতা করেন অনেকে। ব্যবসা-বাণিজ্যে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ব্যবসার উন্নতির জন্য দিন-রাত খেটে যান। কর্মজীবনকে অর্থবহ এবং শান্তিপূর্ণ করার জন্য মানুষ নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কর্মজীবনে একজন কর্মী যাতে কাঙ্ক্ষিত, প্রকৃত উন্নতি সাধন করতে পারে, সে জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। দাম্পত্য জীবনকে সুখী করার জন্য মানুষ সর্বোচ্চ ছাড় দেয়। স্বামী-স্ত্রী একে অপরকে সন্তুষ্ট রাখার জন্য আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। অনেক সময় মা-বাবা, ভাই-বোনকে পর্যন্ত ত্যাগ করতে দেখা যায়।
সামাজিক জীবন মানুষের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। দার্শনিকরা বলেন, মানুষ রাজনৈতিক জীব। রাজনীতি সমাজের চালিকাশক্তি। মানুষ যত কর্মকাণ্ড করেন, তার মধ্যে সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো রাজনীতি। রাজনীতির মাধ্যমেই মানুষ সমাজে শৃঙ্খলা আনে, সমাজের উন্নয়ন ঘটায়, পিছিয়ে পড়া মানুষকে সামনে এগিয়ে আনতে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখে। রাজনীতির মাধ্যমে মানুষ রাষ্ট্রের আমূল পরিবর্তন ঘটায়। এই রাজনীতির জন্য অনেক মানুষ সর্বস্ব হারায়। আবার রাজনীতির কারণে মানবিক বিপর্যয় ঘটে দেশে দেশে। দুঃসহ যন্ত্রণা, নিপীড়ন, অত্যাচার আর মৃত্যু মানুষকে হতবিহ্বল করে দেয়। মানুষ এসব বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক থাকে। ছেলেমেয়ের বিয়ে, বাড়িঘর তৈরি, নিশ্চিত ভবিষ্যৎ গড়তেই প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলে।

তবে মানুষের সব অনীহা শুধু প্রবীণজীবনকে নিয়ে। বার্ধক্য যে চলমান জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটি মনেপ্রাণে মানতে চান না। প্রবীণজীবন কেমন আনন্দের হবে, তা নিয়ে স্বপ্ন দেখতে নারাজ। সেই দুঃখ-কষ্টকে জয় করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ না করে বেশিরভাগ মানুষ নিয়তির ওপর ছেড়ে দেন। আবার কেউ কেউ ছেলেমেয়ের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সেবাযত্ন ও পরিচর্যা পাবেন সেই আশা করেন। ৬০ বছর বয়স হলেই উন্নয়নশীল দেশে যে কোনো নাগরিককে প্রবীণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আমাদের দেশেও ৬০ এবং ৬০-এর অধিক বয়স্ক ব্যক্তিরা প্রবীণ হিসেবে বিবেচিত হন।
বর্তমানে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয়ু প্রায় ৭২ বছর। যারা ৭০, ৮০ ও ৯০ বছর পর্যন্ত বাঁচবেন তারা বাকি ২০-৩০ বছরের প্রবীণজীবনকে নিয়ে কার্যকর কোনো ভাবনা এখনো ভাবেন না। যারা পেনশনভোগী তারা ভাবেন মাসে মাসে টাকা পাব, এতেই জীবন ভালোভাবে অতিবাহিত হবে, কারো মুখোমুখি হতে হবে না। ব্যবসায়ী ও অন্যান্য পেশায় সামর্থ্যবানরা ভাবছেন বাড়ি-গাড়ি, জমিজমা, ব্যাংক ব্যালান্স আছে, তেমন সমস্যা হওয়ার কথা না। বিপুলসংখ্যক মানুষ আছেন, যারা সহায়সম্বল ছাড়াই প্রবীণজীবনে পা দিয়েছেন কিংবা দিতে যাবেন। নিয়তি এবং সন্তানের ওপর ভরসা করে প্রবীণজীবনে প্রবেশ করা কতখানি যৌক্তিক, তা গভীরভাবে তলিয়ে দেখার সময় এসেছে। গবেষণায় দেখা গেছে, বর্তমানে শতকরা ৭৬ ভাগ তরুণ মা-বাবার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এ থেকেই বোঝা যায়, তরুণদের সঙ্গে মা-বাবার শিথিল সম্পর্ক বিদ্যমান অবস্থায় প্রবীণজীবনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে বাধ্য।

যৌথ পরিবার ভেঙে যাচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল। আত্মকেন্দ্রিকতা, স্বার্থপরতার কাছে মানুষ পরাস্ত হয়ে গেছে। মানবিকতা, নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ যখন ভয়ংকর প্রশ্নের সম্মুখীন, ঠিক সে সময় প্রবীণদের সন্তানের ওপর ভরসা করা অনেকটা ঝুঁকিপূর্ণ। আগে মানুষ প্রবীণজীবন তেমন একটা পেতেন না। যারা পেতেন তারা সমাজে অনেক বেশি সম্মান পেতেন। এখন ৮০ বছর পার করেছেন এমন লোকের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়ে গেছে। ভবিষ্যতে গড় আয়ু ৮০ বছর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যেসব প্রবীণ টাকার ওপর ভরসা করে প্রবীণ হয়েছেন, তারা নিজেদের সেবাযত্ন অনেক সময় টাকা দিয়ে পান না। টাকার বিনিময়ে একজন পেশাদার সেবাকর্মী পাওয়া সহজসাধ্য নয়। পরিবারের সদস্যরা সেবাকর্মী নিয়োগে কিংবা নিজেরা সেবা প্রদানে গড়িমসি একটা সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। কখনো কখনো সামর্থ্যবান প্রবীণরা লোভী সেবাকর্মীর হাতে নাজেহাল কিংবা মৃত্যুবরণ করেন। নিয়তি কিংবা সন্তাননির্ভরতার ভাবনা নিয়ে প্রবীণজীবনে প্রবেশ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার। যারা এখনো যৌবনে আছেন কিংবা প্রবীণ হননি, তারা বিষয়টি গভীরভাবে ভেবে দেখবেন।
পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থা বহাল থাকা অবস্থায় মানবিক অনেক বিষয় উপেক্ষিত হবে, এটি স্বাভাবিক একটি বিষয়। পুঁজিবাদী সমাজে উৎপাদন হয় মুনাফার জন্য। যেখানে মুনাফা নেই, সেখানে বিনিয়োগ হবে না। এরকম সমাজ ব্যবস্থায় সব ধরনের সেবা পণ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। প্রবীণ সেবাও একটি পণ্য, এটি কিনতে হবে। যার সামর্থ্য আছে তিনি কিনবেন আর যার সামর্থ্য নেই তাকে রাষ্ট্র কেনার জন্য সহযোগিতা করবে। পাড়ায়-মহল্লায়, গ্রামে-গঞ্জে প্রবীণ সেবাকেন্দ্র, প্রবীণ নিবাস, প্রবীণ নার্সিং হোম, প্রবীণ দিবাযত্ন কেন্দ্র, প্রবীণ ক্লাব গড়ে তুলতে হবে, যাতে প্রবীণরা প্রয়োজনীয় সেবা গ্রহণ করতে পারেন। সেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হবে, সেসবে আর্থিক প্রণোদনা পাওয়ার জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। কারণ নাগরিকের প্রবীণ জীবনের কর্তব্য পালন করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। কারও দয়া, অনুগ্রহ, কৃপার ওপর প্রবীণজীবন ছেড়ে দেয়া কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
লেখক: প্রবীণ বিষয়ে লেখক গবেষক ও সংগঠক
Leave a Reply