স্বদেশ রায়
দেশভাগের থেকে বড় ট্রাজেডি এই উপমহাদেশের কয়েক হাজার বছরের ইতিহাসে নেই। একজন পাঞ্জাবি বন্ধু একবার হাত ধরে বলেছিলো, তুমি আমার হাতের তাপ বুঝতে পারবে, কারণ তুমি বাঙালি।
প্রথমে তাঁর কথা বুঝতে পারেনি। কয়েক মিনিট সে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে, বাঙালি যতই শিখদেরকে বা পাঞ্জাবিদের ব্রেইন নিয়ে ঠাট্টা করুক না কেন, গোল্ড ফিসের মতো ক্ষুদ্র ব্রেইন বাঙালিরই। আর আমার নীরবতা দেখে সে হেসে বলে, ফ্রেন্ড ভারত উপমহাদেশ তো ভাগ হয়নি। ভাগ হয়েছে বাংলা আর পাঞ্জাব। তাই আমার হাতের তাপমাত্রা তোমারই বোঝার কথা।
নিঃশব্দে অনেকক্ষন তাঁর হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। এবং তখন চোখের সামনে কেবলই ভেসে উঠছিলো ঋত্বিক ঘটকের ছবি মেঘে ঢাকা তারার সেই দৃশ্যটি, যখন মুদি দোকানি বলে, মেয়েটি (নীতা) এমনি স্যান্ডেলের ফট ফট শব্দ তুলে চলে যেতো। আর মেঘে ঢাকা তারার মূল চরিত্র নীতার মতো শাদা শাড়ি পরে তেমনি রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাওয়া রিফিউজি মেয়ে স্যান্ডালের ছেঁড়া ফিতে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে অথচ কোন শব্দ শোনা যায় না।
ওই নিঃশব্দতার মতোই একটা নিঃশব্দতা আমার মধ্যে নেমে আসে। তার পরে আর বেশি কথা তার সঙ্গে এগোয়নি। তবে সে বলে, ইংরেজি সাবটাইটেল না থাকলেও সে বহুবার মেঘে ঢাকা তারা ছবিটি দেখেছে। আর কোলকাতার সঙ্গে তার একটা যোগ থাকায় বাংলা পড়তে বা বলতে না পারলেও কিছুটা বুঝতে পারে।
বাস্তবে একজন মানুষ যখন রিফিউজি হয় তখন তার যে পরিবর্তন হয়- অস্তিত্বের স্বার্থে আর অস্তিত্ব হারানোর কারণে -এই পরিবর্তন মনে হয় অনেক সময় পৃথিবীর স্বাভাবিক বিবর্তনবাদকেও হার মানিয়ে দেয়।
মেঘে ঢাকায় তারায় নীতা যেমন একদিকে একটি তরুণী থেকে সর্বংসহা শুধু নয় কোন কিছু না পেয়েও শুধু বহন করে যাবার মতো ধরিত্রী মাতার অবস্থানে চলে যাচ্ছে- আর তখন তার মা যেন একটা জোঁক হয়ে যাচ্ছে। যে মা রক্ত থেকে দুধ তৈরি করে সন্তানকে দেয়- সেই মা যেন সন্তানের রক্ত খেয়ে বেঁচে থাকতে চাচ্ছে।
নীতার শিক্ষক পিতার শিক্ষা ও তার জৈবিক মানুষটি তখন দুটো সত্তা হয়ে গেছে। কখনও জৈবিক সত্তাটি জোঁক হয়ে রক্ত চুষতে চায় আবার কখনও তার শিক্ষা এসে অদৃশ্য এক সত্য শক্তির মতো জোঁকটির সামনে দাঁড়ায়। বাধা দিতে চায় তাকে।
শত শত বছর ধরে একটা সভ্যতা ও সংস্কৃতজাত মানুষকে জোর পূর্বক রিফিউজিতে পরিনত করলে সে ধীরে ধীরে কীভাবে অসংস্কৃত হয়ে যায় -এ যেন তারই একটা খেলা চলছে সেখানে। মুর্তি বা দেয়াল ভেঙ্গে যেতে লাগলে তা সংস্কারের পথ থাকে। কিন্তু রিফিউজি হয়ে মানুষ যখন তার সংস্কৃতজাত জীবন হারিয়ে ফেলে তখন সেখানে সিমেন্ট লাগানো বা চুনকামের কোন পথ থাকে না।
ফোর্স মাইগ্রেশানের মাধ্যমে যাদেরকে রিফিউজি করা হয় তাদের জীবনের এই যে ভয়ংকর দিক বাস্তবে পৃথিবীর কোন মূর্ত বা বিমূর্ত আর্ট দিয়ে এখানে ঢোকা যায় না। এই ভয়াবহ আর্ট উঠে এসেছে ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারায় বা শক্তিপদ রাজগুরুর গল্পে।
নীতার ছোট বোন অবলীলায় যৌবনের বিনিময়ে তার দিদির প্রেমিকাকে ছিনিয়ে নেয়। গোটা পরিবার তা মেনে নেয়। অর্থাৎ নষ্ট হয়ে যাওয়া, ছিনিয়ে নেয়া এমন বর্বর যুগের বিষয়গুলো যে আবার সভ্য সংস্কৃতজাত পরিবারে ফিরে আসছে। হাজার বছরের একটি সভ্যতা ধ্বংস হয়ে আবার মানুষগুলো সেই বর্বর যুগে ফিরে যাচ্ছে- এই বিভিষিকার দৃশ্য একের পর এক সৃষ্টি হয়েছিলো বাংলা ভাগ হবার ফলে।
আর কেন ছোট বোনটি এই বর্বর যুগের কাজটি করতে পারছে? তারও উত্তর অতি সহজ। কারণ সে বেড়ে উঠেছে অসংস্কৃত পরিবেশে। পরিবেশ কত দ্রুত হাজার বছরের সভ্যতাকে শেষ করে দিতে পারে ভেতর থেকে- মেঘে ঢাকা তারায় নীতার ছোট বোনের এই বারবারিক আচরণের মধ্য দিয়ে যে শিল্পকলা পৃথিবীতে তৈরি হয়েছে- এতো পিকাসোর গুয়েনিকার ঘোড়ার মুখের থেকেও ভয়ংকর। কিন্তু আজো বাঙালি মেঘে ঢাকা তারা ছায়াছবির ভেতর দিয়ে তা দেখতে পেরেছে বলে মনে হয় না।
আর দেখা সম্ভব তখনও যেমন পুরোপুরি হয়নি খুব শীঘ্রই তা হওয়ার নয়। কারণ দেশভাগের সঙ্গে, ফোর্স মাইগ্রেশানের সঙ্গে সঙ্গে যারা রিফিউজি হয় শুধু তারা নয়, যারা রিফিউজি না হয়েও নিজ ভূমিতে থাকে- তারাও কিন্তু তাদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা ধরে রাখতে পারে না। কারণ, সভ্যতা ও সংস্কৃতি একটি বাগান। সেখানে এক অংশে আগুন লাগলে আরেক অংশ আগুনের বাইরে থাকলেও তার পাতা থেকে অনেক ক্লোরোফিল চলে যায়।
ঋত্বিক মেঘে ঢাকা তারা ছায়াছবিতে সেই ক্লোরোফিলহীন পাতা দেখাতে ভুল করেননি।
নীতার ভাই ওস্তাদ গাইয়ে হয়ে এলেও তার গানের কদরের থেকে সকলে তার কাছে জানতে চায়, সে কত টাকা পায়। সে গাড়ি চড়ে কিনা? আর ওই যে অসংস্কৃত পরিবারে বেড়ে ওঠা ছোট বোন নিজের বড় বোনের প্রেমিককে কেড়ে নিচ্ছে অর্থাৎ সম্পদ কেড়ে নেওয়াতে আর কোন আপন পর নেই। সম্পদের প্রতি লোভ আর কেড়ে নেবার বা দখল করার সেই আদিম বর্বর মানসিকতা ততদিনে জেঁকে বসেছে। এই অসংস্কৃত মানসিকতা কিন্তু এখনও গোটা বাংলা জুড়ে। বাংলার দুই খন্ডেই মূল মানসিকতা এই নদী দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে। লোভের দখল আর কেড়ে নেয়া এখন বাংলার সবখানে। সবাই এখনও ওই নদীর স্রোতে ভাসছে।
শক্তিপদ রাজগুরুর কলম আর ঋত্বিকের ছায়াছবি মিলে এই যে নদী চোখের সামনে এনে দিয়ে গেছে- বাঙালি এখনও সেই নদীতেই আছে। সেখান থেকে উঠতে পারেনি। বরং নদীটি দিন দিন বড় হচ্ছে।
তাই মেঘে ঢাকা তারা ছায়াছবির প্রতিটি মুহূর্তের মধ্য দিয়ে শুধু দেশভাগ নয়, সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাঙালির ভবিষ্যতও কখনও মূর্ত হয়ে আবার কখনও বিমূর্ততার ভেতর দিয়ে আরো বেশি সামনে এসেছে।
বাংলা চলচ্চিত্র আর বাঙালির সভ্যতা ধ্বংসের চিত্র বলে হয়তো পৃথিবীর পর্দায় মেঘে ঢাকা তারা স্থান পায়নি। কিন্তু বাঙালি যদি কোনদিন আবার সভ্যতাজাত সন্তান হতে পারে তখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারবে, শিল্প কত বড় মাধ্যম আর শিল্পী ঈশ্বরের থেকেও দীর্ঘদেহী।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply