বর্তমানে সুন্দরবনে বাঘ তেমন একটা দেখা যায় না। সুন্দরবনের বাঘ প্রায় বিলুপ্তির পথে। কিন্তু একটি সময় ছিল যখন সুন্দরবনে প্রচুর পরিমাণে বাঘ ছিল। ঐ সময় বাঘের পরিমাণ বেশি থাকায় কিছু কিছু বাঘ গবাদি পশু এমনকি মানুষও খেয়ে ফেলত। আর তখন এই বাঘগুলোর নাম দেওয়া হয়েছিল মানুষ খেকো বাঘ। সেই সব বাঘ শিকারের কাহিনী গুলো আজও রোমাঞ্চকর। বাংলাদেশে মানুষ খেকো বাঘ শিকার করে যিনি সবচেয়ে বিখ্যাত হয়ে ছিলেন তার নাম পচাব্দী গাজী। তারা কয়েক পুরুষ ধরেই ছিলেন এ ধরনের বাঘ শিকারি। পচাব্দী গাজী নিজেই বলেছিলেন তার এবং তার পিতা মেহের গাজীর ভয়ংকর সব বাঘ শিকারের কাহিনী । এমনই কিছু ভয়ংকর বাঘ শিকারের কাহিনী সারাক্ষণে প্রকাশ করা হলো।
হুমায়ুন খান
তালপাটি নদী বিশাল রায়মঙ্গল থেকে বের হয়ে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। দুই নদীর মাঝখানে গঠিত হয়েছে তালপাটি দ্বীপ। সম্পূর্ণ দ্বীপই গভীর জঙ্গলে ঢাকা। কোথাও কোথাও শুধু নদীর ধারে কিছুটা ফাঁকা চর দেখা যায়। বুড়ী গোয়ালিনী রেঞ্জ অফিস থেকে দ্বীপটি অনেক দক্ষিণে, বন বিভাগের যে বোট এখানকার সম্পদ আহরণের কাজ তদারক করে ও প্রয়োজনবোধে জেলে-বাওয়ালী-মৌয়ালীদের জীবনের নিরাপত্তা বিধান করে তাও এই দ্বীপ থেকে অন্ততঃ দশ মাইল উজানে থাকে। দ্বীপের দক্ষিণেই বঙ্গোপসাগর।
খুলনা থেকে রোজ এখানে বরফের নৌকা ও ট্রলার আসে। জেলেদের ধরা মাছ নৌকা বোঝাই করে, বরফ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় খুলনা শহরে। মৌয়ালরা চাকের মধু কেটে তাদের নৌকায় বড় মটকীতে জমা করে, তারপর এক মাসের সঞ্চয় বুড়ী গোয়ালিনী অফিসে নিয়ে যায়, সেখান থেকে মধু যায় ঢাকাতে, বাংলাদেশের অন্যান্য যায়গাতে। ইংরাজী ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে এই তালপাটিতে যখন এক মানুষখেকো বাঘের উপদ্রব হয়, একজনের পর একজন মানুষ বাঘের মুখে যেতে থাকে, তখন দ্বীপটিতে প্রায় তিন শ জন জেলে-বাওয়ালী-মৌয়াল কর্মরত ছিল।
মানুষখেকো বাঘ তার প্রথম শিকার মৌয়ালকে নিয়ে যেতে পারেনি, কিন্তু ফেলে যাওয়া শিকার আবার গিয়ে আনার জন্যে এক অবিশ্বাস্যরকম চেষ্টা করেছিল।
দুপুরের আগে চারজন মৌয়াল খালের নৌকা থেকে প্রায় চারশ হাত দূরে, গভীর জঙ্গলে মধুর চাক কাটছিল। বাইন গাছের অল্প উপরের ডালে ছিল মৌচাক, দুইজন মাটিতে দাঁড়িয়েই একটি ডালের আগায় বেনা বেঁধে ধোঁয়া দিয়ে চাক থেকে মৌমাছি সরিয়ে দিলে তখন একজন গাছ বেয়ে উঠল চাক কাটতে, একজন আড়ি হাতি দাঁড়িয়ে রইল, সে আড়ি উপরে তুলে দিবে এবং উপরের জন কাটা চাকসহ আড়ি রশি বেঁধে আবার নামিয়ে দিলে তখন ধরবে। নীচের তিনজন একত্রেই ছিল, হঠাৎ একেবারে নিকট থেকে বাঘ যার হাতে আড়ি ছিল তার উপর লাফিয়ে পড়ল।
ধোঁয়া দিচ্ছিল যে দুইজন তারা ছিটকে পড়ে গেল, কিন্তু পরমুহূর্তেই উঠে দাঁড়িয়ে যে অবিশ্বাস্য অবিশ্ব কাজ করল তা দুনিয়ার আর কোনখানে কোন মানুষ করেছে কি না জানি না। বাঘ সঙ্গীকে মুখে করে দাঁড়ালে তারা দুইজনে হাতের ডালের চোখা মাথা দিয়ে বাঘকে জোরে খোঁচা মারতে লাগল। বাঘ মৌয়ালকে মুখে নিয়েই গাঁ-গাঁ করে ভয় দেখাতে লাগল আর মৌয়ালরা মাত্র তিন-চার হাত দূরে থেকে বাঘকে ক্রমাগত আঘাত করতে লাগল। বাঘ গাঁ-গাঁ করলেও এত কাছে থেকে লাফ দিবার সুযোগ পেল না। কিছুক্ষণ ধরে এই অবিশ্বাস্য আক্রমণ ও প্রতিরোধ চলতে থাকলে তখন বাঘ মুখের শিকার ফেলে চলে গেল।
এই দলে মৌয়ালরা ছিল মোট সাতজন, তিনজন গিয়েছিল, আরেক দিকে। সঙ্গীদের ডাকাডাকিতে সেই তিনজনও ছুটে ঘটনাস্থলে এল, হতভাগ্য মৌয়াল তখনো মরেনি, গোঙাচ্ছিল আর তার মাথা ও ঘাড় থেকে তীরবেগে রক্ত ছুটছিল। সবাই ধরাধরি করে তাকে পিছনে নৌকায় এনে তুলল। নৌকা ভাসাতে যাবে তখন একজন একটু দেরী করল-পায়ের কাদা ধোবে বলে। হঠাৎ সে চীৎকার দিল, ‘বাঘ! বাঘ।’ মাত্র কয়েক হাত দূরেই জঙ্গলে শুয়ে বাঘ লেজ আছড়াচ্ছে, ফেলে যাওয়া শিকার নিয়ে যাবার জন্যে আবার এসেছে এবং লাফ দিল বলে। মৌয়ালরা একত্রে চীৎকার করতে করতে লগি, বৈঠা, কাঠ, হাতে নিয়ে বাঘকে প্রতিরোধ করতে লাগল, বাঘ কয়েক হাত সরে গিয়ে আবার গাঁ-গাঁ করতে থাকলে তারা কোনক্রমে নৌকা ভাসিয়ে দিতে সক্ষম হল। কিন্তু যে ভাইয়ের জন্যে তারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করল তাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারল না, সে নৌকাতেই মারা গেল।
এই ঘটনার সাত দিন পরে আরেক দল মৌয়াল সেই এলাকার কাছাকাছি যায়। তারা মানুষখেকো বাঘের কথা জানতে পারেনি সম্ভবতঃ এ কারণে যে, তাড়াহুড়া করে সেখানে পৌছেই তারা কাজে নেমে গিয়েছিল, অন্যান্য, মৌয়ালদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি, সুন্দরবনে সে রকম যোগাযোগ করা সব সময়ে সম্ভবও হয় না। পূর্বরাত্রে পৌঁছে পরদিন সকালেই ছয়জনে ছৈওয়ালা নৌকা নিয়ে মধু আহরণে বের হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ‘ছাটা কেটে কেটে’ অর্থাৎ মৌচাকের সন্ধান করতে করতে এগুতে থাকে। দুপুর পর্যন্ত নির্বিবাদে মধু সংগ্রহ করে, তারপর ডিঙিতে ফিরে গোসল করে, খেয়ে, তামাক খেয়ে, বিকালে আবার বের হয় এবং পর পর দুই-তিনটি বড় চাক কাটে। বিকাল চারটার সময়ে একজন মৌয়াল একটি চাক কেটে গাছের উপর থেকে নীচে আড়ি নামিয়ে দেয়, চারজন গাছের তলায়ই অপেক্ষা করতে থাকে এবং একজন আড়ি মাথায় একাকী জঙ্গলের মধ্য দিয়ে নৌকার দিকে অগ্রসর হয়, নৌকাতে বড় মটকীতে মধু ঢেলে রেখে আবার আসবে, কেন না একবারে চাকের সব মধু আঁটেনি। নৌকা ছিল প্রায় তিনশ হাত দূরে, খালে; সে আড়ি মাথায় কিছুদূর গিয়ে ‘কু’ দিতে থাকে। পুরা পথটাই গভীর জঙ্গল। নৌকা আর মাত্র হাত পঞ্চাশেক দূরে, এমন সময়ে বাঘ গর্জন করে তার উপরে লাফিয়ে পড়ে। গাছতলার লোকেরা বাঘের গর্জন শুনেই প্রথমে কয়েকবার ‘কু’ দেয় ও পরে ‘হোসেন আলী! হোসেন আলী।’
বলে মৌয়ালের নাম ধরে ডাকতে থাকে, কিন্তু হোসেন আলীর কোন জবাব নেই। তখন তারা পাঁচজন হৈ-চৈ করে এগুতে থাকে, ঘটনাস্থলে এসে দেখে যে মধুর আড়ি মাটিতে পড়া, গাছের গোড়ায়, মাটিতে রক্ত আর বাঘের পারা। সেই মুহূর্তেই অগ্রসর না হয়ে তারা তাড়াতাড়ি গিয়ে আরো একদল মৌয়ালকে ডেকে আনে এবং সবাই মিলে সেই মৌয়ালকে উদ্ধার করতে রওনা হয়। কিছুদূর গিয়েই মৌয়ালের কোমরের গামছা এবং আরো কিছুদূর গিয়ে লুঙ্গি পায়। কিন্তু তারপরে আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি; সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে বনে অন্ধকার নেমে আসছিল। মৌয়ালের দল সুদূর বুড়ী গোয়ালিনী রেঞ্জ অফিসে এসে এই মৃত্যুসংবাদ রেকর্ড করায়। বন কর্মকর্তা তালপাটিতে শিকারী পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। সেখানে মৌয়ালরা মধু সংগ্রহ করছিল, জেলেরা মাছ ধরছিল এবং কিছু কিছু বাওয়ালী অসময়ে লাকড়িও কাটছিল, মধু সংগ্রহ পূর্ণ উদ্যমে চলছিল। কিন্তু বন বিভাগের কর্মকর্তা ও ভাড়াটে শিকারীরা গিয়ে তালপাটিতে পৌছানোর আগেই মানুষখেকো বাঘ দ্বীপটি থেকে আরো দুইজনকে নিয়ে যায়।
শিকারীগণ তালপাটিতে পৌঁছে ঘুরে ঘুরে সকলকে সাবধান করে দেন যে কেউ কোনখানে বাঘ দেখামাত্র বা কোথাও কোন দুর্ঘটনা ঘটামাত্র যেন তৎক্ষণাৎ বোটে খবর দেওয়া হয়। কিন্তু শত অভয়দান ও দক্ষ শিকারীদের উপস্থিতির কথা বলা সত্ত্বেও জেলে-বাওয়ালী ও মৌয়ালরা তালপাটি ছেড়ে চলে যেতে শুরু করে। শিকারীরা সেখানে যাওয়ার পরেও বাঘ আরো দুইজনকে নিয়ে যায়; একজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল।
ঘটনাগুলোর দ্রুততাহেতু সমগ্র দ্বীপে মারাত্মক ভয়ের সৃস্টি হয়ে যায়। বাঘ একের পরে এক মানুষ নিয়ে যেতে থাকে। নীচের প্রায়-অবিশ্বাস্য ঘটনাটি থেকে এই বাঘের ধুর্তামি ও ভয়ঙ্করতার কিছু পরিচয় পাওয়া যাবেঃ
তালপাটীর জঙ্গলে বঘের মুখ থেকে বেঁচে আসা মানুষ, মৌয়াল আনোয়ার গাজী। বাথ ওর ডান কানের উপরে দাঁত বিধিয়েছিল, পরে ওর মুখ বাঁকা হয়ে যায়।
সকালবেলা খালে মাছ ধরতে গিয়ে দুইজন জেলে-দুই ভাই-খালের পাড়ে পশুর গাছে এক মৌচাক দেখতে পায়, মাটি থেকে সামান্য উপরেই। বেশ বড় চাকটি দেখে তাদের শ্লোভ হয়’। তখন একজন কাছেই নৌকা থেকে হাঁড়ি আর দা আনতে যায়, দা দিয়ে ডাল কেটে তার আগায় লতাপাতা বেঁধে চাকে ধোঁয়া দিবে এবং তারপর গাছে উঠে হাঁড়িতে করে মৌচাক কেটে আনবে। আর আরেকজন গিয়ে হাত চারেক উপরে এক মাটি-সমান্তরাল ডালের উভয় দিকে দুই পা ঝুলিয়ে বসে চাক দেখে দেখে ভাইকে ডাকছিল এবং ভাইয়ের ফিরতি ডাক শুনতে শুনতে একটা বিড়ি খাচ্ছিল। হঠাৎ বাঘ তার ডান পায়ে থাবা মারে। সে যখন উপরে চাক দেখায় ব্যস্ত ছিল তখন মানুষখেকো বাঘ নিঃশব্দে তার ঝুলানো পায়ের তলায় চলে আসে এবং ডালের বাধাহেতু লাফ দিতে না পেরে থাবা মেরে মাটিতে ফেলে দিতে চেষ্টা করে। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের যুবক জেলে ডাল থেকে পড়ে যায়নি, বরং দুঃসাহসিকতার সঙ্গে ‘বাঘ। বাঘ!’ বলে চীৎকার করে মাথার উপরের ডাল ধরে বাঘের নাগালের বাইরে গিয়ে একহাতে ডাল এবং আরেক হাতে হাঁটুর নীচ থেকে আলগা হয়ে যাওয়া গোস্ত চেপে ধরে রাখে।
একাকী জঙ্গলে এমন কি দূরেও বাঘ দেখলে মানুষের হৃৎকম্পন শুরু হয়ে যায়, গায়ের রক্ত জমে যাওয়ার অবস্থা হয়, আর মানুষখেকো বাঘ ঠিক নীচে এসে থাল্লা মেরে পায়ের গোস্ত আলগা করে ফেলার পরেও বুদ্ধি ঠিক রাখা এবং ডাল বেয়ে উপরে।
উঠতে পারার মধ্যে যে কি পরিমাণ সাহসের প্রয়োজন তা একবার সুন্দরবনে গিয়ে চিন্তা না করলে বুঝা যাবে না।
বাঘ। বাঘ। চীৎকার শুনে তার ভাই হাতের লম্বা ডাল ও হাঁড়ি ফেলে দিয়ে দা হাতে এক গাছে উঠে পড়ে। এদিকে বাঘও শিকার ধরতে ব্যর্থ হয়ে কিছুটা সামনে গিয়ে মাটিতে হামাগুড়ি দিয়ে বসে থাকে- জেলে গাছ থেকে মাটিতে নামলেই ধরবে। জেলের পা থেকে রক্ত করছিল, সেই অবস্থায় গামছা দিয়ে একটা ডালের সঙ্গে নিজের কোমর বেঁধে ফেলে এবং চীৎকার করে ভাই-এর উদ্দেশ্যে বলতে থাকে, ‘বাঘ আমাকে নিতে পারেনি, আমি গাছে উঠে আছি, তুই একা আসিস না, আছে।’ লোক নিয়ে আয়, খালে লোক এ এক অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টা। ভয়াবহ মানুষখেকো বাঘ মাত্র কয়েক হাত সামনে বসে ‘হঃ। হঃ।’ করছে তাকে খাওয়ার জন্যে, আর সাক্ষাৎ মৃত্যুর মুখ থেকে একবার বেঁচে সেই মৃত্যুরই আক্রমণের মুখে সে ছোট ভাইকে ডেকে বলছে, ‘খালে লোক আছে, লোক নিয়ে আয়,’ এবং ভাই-এর নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে এ-ও বলছে যে, ‘একা আসিস না।’
ঘটনার এতদিন পরেও আমি এই দুই ভাইকে আঅরিক শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারি না। বড় ভাইকে শ্রদ্ধা জানাই তার আশ্চর্য মনোবলের জন্যে তার ছোট ভাইকে এ জন্যে যে, ভাই বেঁচে আছে শুনে সে মাত্র শ খানেক হাত এলাকার মধ্যেই দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জন্তুর উপস্থিতি উপেক্ষা করে গাছ থেকে নেমে ভাইয়ের টানে জঙ্গলের ভিতর দিয়ে ছুটে গিয়েছিল।
ছোট ভাই খালে গিয়ে সেখান থেকে জেলে-বাওয়ালীদের একত্র করে এনে প্রায় চল্লিশ মিনিট পরে তার ভাইকে বাঁচায়। পায়ের গোছা আলগা অবস্থায় এই জেলেকে দ্রুত সুদূর বুড়ী গোয়ালিনীতে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে চিকিৎসার পরে সে সম্পূর্ণ সেরে উঠে এবং আজও বেঁচে আছে, কেবলমাত্র পা একটু টেনে টেনে হাঁটে।
এই ঘটনার পরদিনই বাঘ আরেক জন লোককে খায়, চারদিন পরে আরও একজন বাওয়ালীকে নিয়ে যায়। দেড়মাস সময়ের মধ্যে তালপাটির দশজন লোক বাঘের মুখে যায়। বন প্রায় জনশূন্য হয়ে যেতে থাকে। একশ-এর বেশী জেলে-বাওয়ালী-মৌয়াল বুড়ী গোয়ালিনী বন দফতরে গিয়ে রেঞ্জার সাহেবের নিকটে আবেদন করে যে, বাঘ না মারলে কেউ আর বনে কাজ করবে না। পাঁচজন শিকারী তালপাটিতে বাঘের সন্ধানে থাকা সত্ত্বেও তখন রেঞ্জার সাঁহেব বুড়ী গোয়ালিনী অফিসে আমাকে বিশেষ জরুরীভাবে যেতে খবর পাঠালেন; আমি তখন বন বিভাগের অধীনে চাকরী নিয়ে অন্য এক ফরেস্ট অফিসে ছিলাম।
সংবাদ পাওয়ামাত্র আমি রওনা হয়ে গেলাম। প্রথমে অস্থায়ী ‘রূপ’ অফিসে, সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তবে তালপাটিতে যেতে হবে। রেঞ্জার সাহেব তাঁর চিঠিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, বোট, লোকজন, জিনিসপত্র, খাবার, ইত্যাদি যা কিছু দরকার সবই যেন আমাকে যথেষ্ট পরিমাণে দেওয়া হয়। বোটে করে সবকিছুই নিয়ে আমরা কূপ অফিস থেকে রওনা হলাম এবং জোর বেয়ে দুই দিন দুই রাত পরে তালপাটিতে গিয়ে পৌঁছলাম।
দ্বীপ তখন প্রায় জনশূন্য। প্রাণভয়ে অধিকাংশ লোকেই চলে গেছে, কেবল ছিটাফোঁটা কয়েক দল মৌয়াল-বাওয়ালী ও জেলে, অচেতন প্রকৃতির লোক বলেই হোক কি নিতান্ত পেটের দায়েই হোক, তখনো কাজ করছিল। আমার অছিলায় আল্লাহ তাদের ভয়ঙ্কর; মানুষখেকোর কবল থেকে রক্ষা করবেন কি না জানতাম না, কিন্তু শক্তি- সাধ্যমত চেষ্টা করার সংকল্প নিয়ে আমি রায়মঙ্গল নদী ও তালপাটির বড় খালের সঙ্গমস্থলে বোট লাগাতে বললাম।
লাগাতেৰে আমি বাঘের সন্ধান করতে থাকলাম আর তিনটি ডিঙি করে পরবর্তী সারকেরা অতি বিছিন্নভাবে কর্ম করতে সঙ্গে বোটে পৌঁছে দেয়। করে দিল বনবিভাগের কোন খবর পেলে তা যেন তারা সঙ্গেখনো বোরের আছে দেয়। কিন্তু এই সতর্ক করতে থাকা-সময়ের মধ্যেই আরো দুইটি দুর্ঘটনার খবুর এল, একজন মৌয়াল চজন বাওয়ালীর সময়ে ছাটা কেটে যাওয়ার সময়ে হতভাগ্য মৌয়ালকে বাঘে ধরে, একজন দলে বেলার দরকজন হাত তিরিশেক দূরে ছিল, সে সেই ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখতে পায়। মূল্যে জীকেও সকালবেলা আটটা সাড়ে আটটার সময়ে ইয়েলার নবে শাখান থেকে নিয়ে স্বাওয়ালীকটি থেকে অপর ঘটনাস্থলের দূরত্ব আধ মাইলের বেশী হবে না। এদের কোনজনকে উদ্ধার করা হয়নি।
নক্সামান্যই লাভ হবে জেনেও আমি এই উভয় ঘটনার স্থান দেখতে গেলাম এবং বাঘের পারা ও রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে গিয়ে মৌয়াল এবং বাওযালী উভয়েরই হাড় মাথা উদ্ধার করে এনে চরে দাফনের ব্যবস্থা করলাম। পারা মেপে আন্দাজ করলাম এই মানুষখেকোটি সাড়ে দশ থেকে এগারো ফুট লম্বা বড় বাঘ হবে এবং বাঘা।
সেখানে যাওয়ার চতুর্থ দিনে আমরা তালপাটির বাঘের সর্বশেষ লোক্লক্ষয়টিরও সংবাদ পেলাম, কিন্তু দুঃখের বিষয় তা ছিল বেশী বিলম্বিত। তবুও আরেকজন বনবিভাগের শিকারীকে সঙ্গে নিশ্চয় ডিঙি করে রওনা হলাম এবং প্রায় আড়াই ঘন্টা জোর বেয়ে বেলা চারটার সময়ে খালপাড়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছলাম।
অছয়জন মৌয়ালের মধ্যে একজন নৌকাতে ছিল আর পাঁচজন গিয়েছিল জঙ্গলে, খালের পাড় থেকে অল্প ভিতরে, কিন্তু গভীর জঙ্গল। একজন মৌয়াল মধুর প্রথম আড়িটি বয়ে এনে নৌকার মটকীতে ঢেলে রেখে খালি আড়ি নিয়ে আবার রওনা হয়েছে, এমন সময় পিছন থেকে বাঘ তার উপরে পড়ে।
এই ঘটনাস্থল থেকে প্রায় দুই শ হাত দূরের একটা খলশে গাছের তলা থেকে আমরা মৌয়ালের হাড় উদ্ধার করলাম এবং তা খালের পাড়েই দাফন করে সন্ধ্যার পরে বোটে ফিরলাম। পঞ্চম দিনে তালপাটির খালের প্রায় দুই মাইল ভাটিতে আমি বাঘের বাসি পারা পেলাম, অন্ততঃ তিন দিনের বাসি, মৌয়ালকে যেদিন খেয়েছে সেদিনেরও হতে পারে। জঙ্গলে বালুর উপরে পরিষ্কার দাগ, বাঘ ওপার থেকে খাল পার হয়ে এপারে এসে জঙ্গলে ঢুকে গেছে। ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম আগের দিন যেখান থেকে আমরা মৌয়ালের হাড় উদ্ধার করেছি এখান থেকে বাঘের পারা ঠিক সেদিকেই গেছে। সেই মুহূর্তে আমার ইচ্ছা হচ্ছিল যে, সেই বাসি পারা ধরেই খুঁজতে যাই, যদিই বা বাঘের দেখা পাওয়া যায়, যদি একটা গুলি করার সুযোগ পাওয়া যায়! কিন্তু এগুই এগুই করেও শেষ পর্যন্ত আবার আমি ডিঙিতেই ফিরে এলাম। সুন্দরবনের ভয়াবহতায় মানুষখেকো বাঘের অতি নিশ্চিত উপস্থিতিতে বেহিসাবী হবার কিছুমাত্রও অবকাশ নেই-তাতে মূল্যবান সময় নষ্ট হবে, হয়ত একটা সম্ভাব্য সুযোগও হারাতে হতে পারে। সেই সন্ধ্যায়ও নিতান্ত ব্যর্থ মনে আমি বোটে ফিরলাম।
ষষ্ঠ দিনও ব্যর্থতার মধ্যেই কাটল। এই দিনও আমরা বাঘের বাসি পারা আবিষ্কার করলাম, তাও অন্ততঃ দুই দিনের বাসি।
Leave a Reply