মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০২ পূর্বাহ্ন

মুর্শিদাবাদ-কাহিনী (পর্ব-১০৭)

  • Update Time : সোমবার, ৮ জুলাই, ২০২৪, ১১.০০ পিএম

শ্রী নিখিলনাথ রায়

লুৎফ উন্নেসা

সংসার-মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকারাশির প্রচণ্ড তাপে মানবজীবন অভিভূত হইয়া পড়িলে, একমাত্র স্নেহময়ী রমণীর সজীব সুস্নিগ্ধ করুণা- ধারাই তাহাকে শীতল করিয়া তুলে। ফল্গুনদীর ন্যায় সে ধারা এই ভীষণ মরুভূমির তলে তলে নীরবে প্রবাহিত হয়, কেহ তাহাকে সহজে দেখিতে পায় না। কিন্তু যখনই দুর্ভাগ্যের প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবাত দুঃখ ও নিরাশার অগ্নিময় ধূলিরাশি উড়াইয়া জীবনকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করিতে • থাকে, তখনই সেই স্বর্গীয় ধারা শত মন্দাকিনীর ন্যায় ছুটিতে আরম্ভ করে এবং অধঃপতিত মানবের আত্মাকে, কারুণ্য-সলিলে স্নিগ্ধ করিয়া শান্তির সুমধুর আবেশময় মোহন ক্রোড়ে নিদ্রিত করিয়া রাখে।

তাহার বন্দুপাতে কত কত বিশুদ্ধ জীবন সজীবতা লাভ করিয়াছে,-কত শত ভগ্ন হৃদয় সন্তাপাগ্নির বিভীষিকাময়ী শিখা হইতে নিস্তার পাইয়াছে, তাহাদের সংখ্যা করা দুঃসাধ্য। যে স্থানে একবার সে ধারা বহিয়াছে, সেই স্থান কোমলতার পবিত্র বারিধারায় সিক্ত হইয়া গিয়াছে এবং তথায় প্রীতির চিরশ্যামল কুসুম-লতিকা অঙ্কুরিত হইয়া, ত্রিদিবসৌরভে দিগন্ত আমোদিত করিয়াছে। যে স্থানে তাহার বিন্দুক্ষরণ হয় নাই, সে স্থান চিরমরুভূমি-চিরশ্মশান। শোকতাপ চিরদিনের জন্য তাহা অধিকার করিয়া বসিয়া আছে। সংসারের ধূলিমাখা দপ্তজীবনকে স্নিগ্ধ করিতে হইলে, এই মন্দাকিনীধারায় অবগাহন ব্যতীত অন্য উপায় নাই।

বাস্তবিক নারীহৃদয়ের স্নেহরাশিই ক্ষতবিক্ষত মানবহৃদয়ের একমাত্র মহৌষধ। যখন মনুষ্য দুর্ভাগ্যের ভীষণ আবর্তে নিপতিত হইয়া ঊর্দ্ধ- ক্ষিপ্ত ও অধঃপতিত হইতে থাকে, তখন করুণাময়ী রমণীই বাহু প্রসারিত করিয়া তাহাকে ক্রোড়ে টানিয়া লয় এবং দুর্ভেদ্য কবচের ন্যায় আচ্ছাদন করিয়া স্বয়ং সমস্ত আঘাত সহ্য করে। যেখানে পুঞ্জীভূত বিপদ অভ্রভেদী পর্ব্বত হইতে শ্লথ পাষাণরাজির ন্যায় অবিরত বিচ্যুত হইতে আরম্ভ হয়, সেই খানে রমণী অগ্রসর হইয়া আপনার হৃদয় পাতিয়া দেয়; শিরীষ- সুকুমার সে হৃদয় দলিত ও নিষ্পেষিত হইলেও, তাহার বিন্দুমাত্র ক্লান্তির অনুভব হয় না। রমণীহৃদয়ের এইরূপ বিস্ময়করী দৃঢ়তা, সংসা- রের অগ্নিপরীক্ষা ব্যতীত অন্য সময়ে বুঝিতে পারা যায় না।

বাহারা চিরদিন সৌভাগ্যের মোহিনী দোলায় অঙ্গ ঢালিয়া সুখের স্বপনে দিন -যাপন করিয়াছে, তাহারা রমণীহৃদয়ের গভীরতা বুঝিতে পারে না; কিন্তু যাহারা বিপদকে চির-সহচর করিয়া জগতীতলে অবতীর্ণ হইয়াছে, তাহা- রাই ইহা বিশিষ্টরূপে উপলব্ধি করিতে সমর্থ। যে হৃদয় সৌভাগ্যসময়ে নবনীতকোমল বলিয়া বোধ হয় এবং অত্যন্ন উত্তাপেই দ্রবীভূত হইবার সম্ভাবনা, দুর্ভাগ্যের কঠোর অগ্নিপরীক্ষায় না জানি কি শক্তিবলে তাহা পাষাণ অপেক্ষাও দৃঢ় হইয়া উঠে এবং তরঙ্গের পর তরঙ্গের ন্যায় অগ- ণিত বিপদরাশির অসহনীয় আঘাত প্রতিহত করিয়া দূর দূরান্তরে নিক্ষেপ করিয়া দেয়। যত বার কেন সে পরীক্ষা হউক না, প্রত্যেক পরীক্ষায় তাহার দৃঢ়তা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাইতেই থাকে। নারীহৃদয়ের এরূপ রহস্য যে বিস্ময়কর, তাহাতে সন্দেহ নাই।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024