শ্রী নিখিলনাথ রায়
প্রারম্ভে সাধারণতঃ ঐশ্বর্য্যশালী লোকের সন্তানগণ যেরূপ বিকৃত হয়, সিরাজেরও ‘সেই রূপ বিকৃতি ঘটিয়াছিল; কিন্তু ইহা জানা আবশ্যক যে, নবাব আলিবর্দ্দদী খাঁর সে বিষয়ে সবিশেষ দৃষ্টি ছিল। যাঁহারা সিরাজকে আলিবর্দ্দদীর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বলিয়া নির্দেশ করিতে চেষ্টা পান, তাঁহারা অনেক সময়ে ভ্রমে পতিত হন। আমরা স্থানান্তরে ইহা সপ্রমাণ করিতে চেষ্টা পাইব। একটা কথা বলিয়া রাখি, বাঙ্গলার ইতিহাসে সিরাজকে সিংহাসনারোহণের পরেও যে ঘোরতর মদ্যপায়ী বলিয়া বর্ণনা করা হয়, ইহা সম্পূর্ণ অমূলক।
যৌবনারন্তে সিরাজ মদ্যপান করিতেন বটে কিন্তু আলিবর্দ্দদী মৃত্যুশয্যায় সিরাজকে কোরান স্পর্শ করিয়া ভবিষ্যতে মদ্যপান না করিতে প্রতিজ্ঞা করাইয়া লন এবং সিরাজ যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন মাতামহের সেই হিতকর অনুরোধ রক্ষা করিতে ত্রুট করেন নাই। যাহা হউক, এ বিষন্ন লইয়া এক্ষণে অধিক আন্দোলনের প্রয়োজন নাই। সিরাজ আলিবর্দীর সবিশেষ দৃষ্টিসত্ত্বেও যে যৌবনলালসার হস্ত হইতে নিষ্কৃতি পান নাই, একথা একেবারে অস্বীকার করা যায় না। বিলাসের তুরঙ্গ যখন তাঁহাকে ভাসাইতে আরম্ভ করে, সেই সময়ে তিনি লুৎফ উন্নেসার পবিত্র মূর্তি নিল হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করেন।
লুৎফ উন্নেসাকে প্রণয়িনী- রূপে স্বীকার করিয়া, যখন তিনি তদীয় অপার্থিব প্রেমরসের আস্বাদ পাইতে লাগিলেন, তখন বুঝিতে পারিলেন যে, রমণী বিলাসের সামগ্রী নহে, – ভালবাসার সামগ্রী; তাই তাঁহার প্রেমের স্রোত লুৎফ উন্নেসার দিকে প্রবাহিত হইয়াছিল। মধ্যে মধ্যে বিলাসমুগ্ধ হইয়া সিরাজ লুৎফ উন্নেসাকে বুঝিতে পারিতেন না; কিন্তু শেষ জীবনে যে বুঝিতে পারিয়া- ছিলেন, তাহা আমরা পূর্ব্বেই উল্লেখ করিয়াছি। লুৎফ উন্নেসার অগ্রাধ মেহ ও পবিত্র স্বভাব অন্যান্য সকল বিষয় হইতে সিরাজের মনকে প্রতি- নিবৃত্ত করিয়াছিল। লুৎফ উন্নেসার ভালবাসায় তিনি এতই মুগ্ধ হইয়াছিলেন যে, তাঁহাকে ক্ষণমাত্র ছাড়িয়া থাকিতে পারেন নাই।
বিপদে সম্পদে, সকল সময়ে লুৎফ উন্নেসাকে না পাইলে, তাঁহার হৃদয় শান্ত হইত না। বাস্তবিক যদি কেহ সৌভাগ্যবশতঃ রমণীর পবিত্র প্রণয়ের অধিকারী হয়, তাহা হইলে তাহার হৃদয় যেরূপই হউক না কেন, তাহা স্নেহপ্রবণ হইয়া উঠে। লুৎফ উন্নেসার প্রতি সিরাজের অধিকতর ভালবাসার আর একটি কারণ ছিল। সিরাজ কোন একটি রমণীর সৌন্দর্য্যতরঙ্গে এক বার আপনাকে ভাসাইয়াছিলেন। রূপে পাগল হইয়া যাহাকে তিনি হৃদয়ে স্থান দান করেন, সে কিন্তু ঘোর বিশ্বাসঘাতকতায় তাঁহার হৃদয় ভাঙ্গিয়া দেয়। এই রমণীর নাম ফৈজী বা ফয়জান। ফৈজী দিল্লীতে নর্তকীর ব্যবসায়ে জীবন অতিবাহিত করিত।
Leave a Reply