স্কেটস, বগলে ছেলেটা-৪
ছেলেটার নাম জিজ্ঞেস করে নি লোকটা, নিজের নামও বলে নি। আর নিজে থেকে জিজ্ঞেস করবে, সে সাহস হয় নি ছেলেটার।
অন্য ক্ষেত্র হলে অচেনা এক পরের বাড়িতে এভাবে থাকতে ছেলেটার ভারি বিচ্ছিরি লাগত। কিন্তু বেশি যন্ত্রণায় যেমন কম ব্যথাটা চাপা পড়ে যায়, তেমনি যে-উদ্বেগ তাকে ক্রমাগত চেপে ধরছিল তাতে অস্বস্তিটা আর টেকে নি। তাই বিশেষ দ্বিধা না করেই সে পাশের ঘরের দরজা খুললে।
হলুদ রোদের আভায় ঘরখানা ভরা। যেন সত্যিই একরকমের জলজলে হলুদ রঙ, যা মেঝেতে, দেয়ালে, বইয়ের তাকে, এমনকি গ্লোবটাতে কখনো শুকিয়ে উঠতে পারে নি। চোখ কোঁচকালে ছেলেটা রোদ-রঙ ছিটকে পড়েছিল তার চোখে- কানে এল টাইপ-রাইটারের ধাতব খট-খট শব্দ। আসলে জানলার ওপাশে টিপটিপিয়ে বরফ-গলা জল পড়ছিল জানলার লোহার কার্নিসে। জখম লোকটা এখন যে-ঘরে শুয়ে আছে, বসন্তের রোদ-ঢালা এ ঘরখানা মোটেই সেরকম নয়। গৃহস্বামীর কাঁ হয়েছে, ঘরখানা বোধ হয় এখনো তা জানে না, তাই দিলখুশ মেজাজ তার। জানে না ক্যালেন্ডারটাও; আজকের পাতাটায় এনগেজমেন্ট লেখা: ‘বেলা ৪টেয় পার্টি কমিটি’।
টেবিলের কাছে এল ছেলেটা। কিন্তু মাঝের দেরাজটা টানার আগে তার চোখে পড়ল দুটো খাতা আর একটা পাঠ্যপুস্তকে ষষ্ঠ শ্রেণীর ‘পদার্থবিদ্যা’। আর খাতায় তাদের মালিকের নাম লেখা: সেগেই বাতিউকন্ড, ৬ষ্ঠ ‘ক’। এই সেগেই তাহলে রিয়াজানের সাপোজক শহরে তার মায়ের সঙ্গে ছুড়িতে গেছে দিদিমার কাছে।
ছেলেটার চোখ জলে উঠল অসন্তোষের ছটায়। খাতা ঠেলে দিয়ে সন্তর্পণে সে খুললে মাঝের দেরাজটা।
কাগজপত্র, নক্সা, ফোটোগ্রাফ আর এমন সব রকমারি জিনিসে দেরাজটা আগাগোড়া ঠাসা, প্রথম দেখে যা মনে হবে একান্ত মূল্যহীন। যেমন, কী মানে হয় ওই প্রশ্নচিহ্নের মতো বাঁকা তামাকের পাইপটার, অথবা ঘড়ির একটা পুরনো চেন, কিংবা প্যাকেটে মোড়া রেডগুলোর?
প্রেসক্রিপশনটা খোঁজার সময় ছেলেটা পরের এই জিনিসগুলোয় নজর দিতে চাইছিল না, কিন্তু ওরা তাকে টানছিল চুম্বকের মতো। পাইপটা হাতে নিলে সে। পোড়া-পোড়া গন্ধ ছাড়ছিল তা থেকে। নিশ্চয় সৈন্যটি তার ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামানের কাছে দাঁড়িয়ে শেষ বারের মতো এই পাইপ টেনেছিল ফ্রন্টে। পাইপের গন্ধটা শুকে ছেলেটা তা আবার সাবধানে রেখে দিলে। তারপর গৃহস্বামীর ফোটোগ্রাফ চোখে পড়ল তার। গায়ে তার ফৌজী উর্দি’, দেখতে অনেক কমবয়সী আর রোগাটে। হয়ত লোকটা নয়, তার ছোটো ভাই নাকি? থুতনিতে টোল। উ’হা, ও-ই। নিশ্চয় যখন ফোটোটা তুলেছিল তখনো কোনো শেলের টুকরো তার বুকে ঠাঁই নেয় নি।
তারপর তার হাতে ঠেকল একটা রক্তিম বাক্স। নিজেরই লজ্জা হচ্ছিল তার, তাহলেও পারলে না, খুলে ফেললে। বাক্সে ছিল অর্ডার। আসল ‘লাল ঝাণ্ডা অর্ডার’। ছেলেটা সেটা হাতে নিয়ে দেখলে। ঠান্ডা, ভারি।
কফের বোতাম, পেনসিল-কাটা ছুরি, ‘নেভা’ মার্কা মারা দাড়ি কামাবার ব্লেড, সবই হাতে নিয়ে দেখল ছেলেটা। এই পরিমাণ পুরুষালী জিনিস সে কখনো দেখে নি। সত্যি, দেখবে কোত্থেকে, সেই তো নিজেদের বাড়ির একমাত্র পুরুষ। জিনিসগুলো তাকে টানছিল। ওগুলোকে ছায়ে ছ’য়ে প্রায় একটা দৈহিক পুলকই হচ্ছিল তার।
শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল প্রেসক্রিপশনটা। খুবই পুরনো। নিশ্চয় লোকটা তা আর ব্যবহার করে নি অনেকদিন। হলদে-হয়ে-আসা ছোট্ট কাগজটায় ছিল বেগুনী রঙের সীলমোহর: ‘স্যানিটারি ইউনিট, ফিল্ড ডাকঘর ৩১৪৯৭’: লেখাগুলো পাটকিলে কালিতে। মনে হয়, একসময় যেন জল-জ্বল করত হরফগুলো, তারপর কালক্রমে তাতে মরচে ধরেছে। শুধু প্রথম লাইনটা পড়তে পারল ছেলেটা ‘সাজে মেজর ল, বাখ্যাতিউকভের জন্যে’, তার পরের লেখাগুলো সবই দুর্বোধ্য লাতিনে।
সাবধানে প্রেসক্রিপশনটা হাতে নিয়ে ছেলেটা আপ্তে দেরাজ বন্ধ করলে। ৬৬ ‘ক’-এর ছায় সেগেই বাখতিউকভের খাতায় নজর পড়ল তার। কেন জানি না ঘুষি পাকিয়ে সে খাতাগুলোকে শাসালে।
বুকে টুকরো নিয়ে পাশের ঘরে যে-লোকটা শুয়ে আছে হঠাৎ তার জন্যে কেমন একটা টান অনুভব করল সে। বিশাল চেহারার নির্ভীক সেই পুরুষের জন্যে, যার আছে লাল বাক্সের মধ্যে ফৌজী অর্ডার, পোড়া-পোড়া গন্ধ ছাড়া পলটনী পাইপ আর ‘নেভা’ ব্লেড।
কেন এই দশাসই, শক্তিমান লোকটা অসহায়ের মতো পড়ে আছে সোফায় আর সে, ডানপিটে, কিন্তু আসলে মোটেই অমন বলবান নয়- সে কিনা ছোটাছুটি করে বেড়াতে পারে রাস্তায়, হাসতে পারে, টুপি খসিয়ে দিতে পারে সামনের স্কেটিং-করা ছেলেটির?
Leave a Reply