স্কেটস, বগলে ছেলেটা-৫
ভেজা, গলন্ত তুষারে ব্যাঙের ছাতার গন্ধ। সুড়-সুড় করে তা পায়ের তলে। এখন আর ঘরের ছাদ, রাস্তা, পথচারীদের ওভারকোটের কলার শাদা করে তোলার কাজ তার নেই। মাসের পর মাস এখন তা কুল-কুল করে যাবে নদীতে, গান গাইবে জলের পাইপে, বন্ধুত্ব পাতাবে জাহাজের সঙ্গে। কেবল ডিসেম্বর মাসেই তা আবার ফিরবে শাদা, ধবধবে, নিষ্কলঙ্ক। এখনকার এই যে ধূসর, পদদলিত, গলন্ত বরফ তার ঐন্দ্রজালিক ভোলবদলের আগটায় লোকের পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে সে বরফের কতই না তফাৎ!
ব্যাঙের ছাতার গন্ধ পাচ্ছে না ছেলে। ছুটছে সে। হোঁচট খাচ্ছে, ডিঙিয়ে যাচ্ছে বরফ-গলা জলগুলো, ফুটপাথ থেকে নামছে রাস্তায়। টেংরি পর্যন্ত নামা তার কি করার ট্রাউজারে লেগেছে কাদা জলের ছিটে। মাফলার একেবারে খুলে এসেছে, উলটিয়ে আসছে খাটো ওভারকোটটার ধার: একটা বোতাম তো নেই।
মনে হবে যেন ট্রাউজার আর ওভারকোট আর টুপিটাই শুধু ওর পক্ষে খাটো তাই নয়। ফুটপাথ, রাস্তা, চকও তার মাপে ছোটো। গোটা শহরটাই আঁটো লাগছে তার গায়ে। হঠাৎ যে উদ্বেগ তাকে পেয়ে বসেছে তাতে নিজের শহরেই সে আঁটছে না।
ছুটতে গিয়ে তার ধাক্কা লাগছে লোকের সঙ্গে, হুমড়ি খাচ্ছে ল্যাম্প-পোস্টে। বড়ো ঘিঞ্জি। সামনে এসে পড়ছে মোটরগাড়ি। ওগুলোর জন্যে এ শহরে কি আর অন্য রাস্তা ছিল না!..
জমে গেল বাঁ কানটা: টুপিটা পরা ডান কানে। লটপট-করা জুতোর ফিতেয় জমে বসেছে বরফ। কিন্তু হিম-হয়ে-যাওয়া হাতে তার আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো এক শিশি ওষুধ।
হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢোকে সে, আস্তে দরজা বন্ধ করে। চোখ বুজে শুয়ে আছে লোকটা।
ছেলেটা ভাবে, ‘ঘুমিয়ে পড়েছে যখন, তখন সেরে গেছে। ভালোই হল।’ ওষুধের শিশিটা সে রাখে টেবিলের ওপর, হিমে ঝড়ে রুক্ষ হাতটা দিয়ে আনাড়ীর মতো মাফলার জড়ায় গলায়। এবার ওর ছুটি। যাওয়া যেতে পারে।
ঘুমন্ত লোকটাকে সে দেখে প্রায় ভালোবাসা নিয়েই। দুর্বোধ্য এই হৃদয়াবেগটার জন্যে নিজের কাছেই কেমন বিব্রত লাগে তার। নিজেকেই চিনতে পারে না সে…
এমন এক এক জন লোক থাকে, যে-কোনো ছেলের কাছেই যে হয়ে ওঠে তার আপন বাবার মতো। এমনকি নিজেকে যারা বেশ বড়ো, স্বাধীন বলে মনে করে, তাদের ওপরেও এসব লোকের পিতৃত্ব ছড়িয়ে যায় অলক্ষ্যে।
এমনি একজন লোককে পেয়েছে ছেলেটা, আর এবার তাকে বিদায় নিতে লোকটা কিন্তু চোখ মেলে না। বোঝা যায়, নিজের ওই টুকরোটা সে সামলে উঠেছে, অঘোরে ঘুমচ্ছে এবার। তাই নীরবে বিদায় জানিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া ছেলেটার গতি নেই। পা টিপে টিপে হাঁটে সে, মেঝেয় যাতে শব্দ না হয়, দরজা পর্যন্ত গিয়ে হড়কোর দিকে হাত বাড়ালে। হড়কো কিন্তু তার বশ মানতে চাইল না, সে শুধু তার আপন লোকদেরই চেনে।
কে’পে ওঠে ছেলেটা। কানে আসে তার একটা মৃদু দূর শব্দ ‘খোকা রে’। লোকটা ডাকছে নাকি? কান পেতে শোনে ছেলেটা। নিস্তব্ধ ফ্ল্যাট। শুধু বরফ-গলা জল ফোঁটায় ফোঁটায় পড়ে শব্দ তুলছে কার্নিসে। কেউ ওকে ডাকে নি। ওটা ওর মনের ভুল।
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ছেলেটা ভাবে এইবার সে চলে যাবে, আর কখনো লোকটার সঙ্গে দেখা হবে না। ‘লাল ঝাণ্ডা অর্ডারটার’ ঠান্ডা জয়-জয়ন্তী ভার সে আর কখনো অনুভব করবে না তার হাতের তালুতে। পুরনো পাইপের রহস্যময় গন্ধ টেনে নেবে না বুক ভরে। ধাঁরে ধাঁরে সে আবার ফিরে আসে ঘরখানায়। সবকিছু এখানে নিশ্চল, যেন ঘুমের রাজ্য। দরজা, বাতি, মেঝে, সবই ঘুমচ্ছে। সেই সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়েছে গৃহস্বামীও। হাত মেলে পায়ের বুড়ো আঙুলে ভর দিয়ে এগিয়ে যায় ছেলেটা: ভয় হয়, ঘুম ভেঙে ক্যাঁচকে চিয়ে উঠবে মেঝে।
সোফার কাছে আসে সে। আগের মতোই লোকটা চোখ বুজে নিশ্চল হয়ে পড়ে আছে, ঘুমচ্ছে।
আর যদি মরে গিয়ে থাকে?!
ভাবতেই আড়ষ্ট হয়ে যায় ছেলেটা। সাবধানতা ভুলে গিয়ে সে ঝাঁকে পড়ে লোকটার ওপর। কাঁধে হাত দিয়ে আস্তে নাড়া দিতে থাকে। জখম যোদ্ধার চোখ খুলল না। ডাকবে নাকি? পুরনো ফৌজী প্রেসক্রিপশনটায় যা লেখা আছে, সেই উপাধি ধরে? ডাকে ছেলেটা:
‘বাতিউকভ… বাতিউকভ কাকু!’
কোপে উঠে চোখ মেলে লোকটা। বে’চে আছে তাহলে। কিন্তু চুপ করে আছে কেন? ওষুধের কথা জিজ্ঞেস করছে না যে? চোখ অমন অস্বাভাবিকভাবে ঘুরছে, মাথা এলিয়ে পড়ছে কাঁধে?
বে’চে আছে, কিন্তু মরেও যেতে পারে। কী করা যায় এখন? কাছেই দাঁড়িয়ে আছে ছেলেটা। চোখ ওর বিস্ফারিত। চুপ করে বসে থাকা যে চলে না! নিজে না পারলে কাউকে সাহায্যের জন্যে ডাকো!
দরজার দিকে ছুটে যায় ছেলেটা। মেঝের সবকটা কাঠকে সে জাগিয়ে তোলে, যে যার সূরে তান ধরে তারা। কিন্তু কিছুই তার কানে যায় না। ছুটছে সে। জানে না কোথায়।
দু’দুটো করে ধাপ ডিঙিয়ে সে নামে। খটখটিয়ে ওঠে জুতোর হিলে ঠোকা লোহার নাল। জলদি! জলদি! ফুলকি ছোটে নাল দিয়ে। ছেলেটা জানে কী তাকে করতে হবে: অ্যাম্বুলেন্স ডাকা দরকার।
Leave a Reply