শিবলী আহম্মেদ সুজন
হাম্মাম
হাম্মাম মোটা বুননীর কাপড় এবং শীতকালে চাদর রূপে ব্যবহৃত হত। ইহা দৈর্ঘ্যে ২০ গজ ও চওড়ায় ১ গজ ছিল।
গামছা
গা মোছা থেকেই গামছা শব্দের উৎপত্তি। হাত, মুখ বা শরীর ধোওয়ার পর গা মোছার জন্য অর্থাৎ বর্তমান কালের তোয়ালে রূপে গামছা ব্যবহৃত হত। বর্তমান কালেও গামছার প্রচলন আছে। এর দৈর্ঘ্য ৫ থেকে ৬ গজ এবং চওড়া পৌনে এক গজ থেকে দেড় গজ পর্যন্ত ছিল। সাধারণ লোকের টুপী এবং জামা, বিশেষ করে ছেলেমেয়েদের জামা তৈরীর জন্য গামছা ব্যবহৃত হত।
মোগল আমলে দেশী নিকৃষ্টতর সুতা এবং পাক-ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আমদানীকৃত তুলার দ্বারা উপরোক্ত মাঝারি কাপড় সমূহ তৈরী করা হত। কিন্তু উনিশ শতকের প্রথম দিকে বিদেশের সুতা আমদানীর পর থেকে বিদেশি সুতার সাহায্যে উক্ত কাপড় সমূহ তৈরী হতে থাকে। সাধারণতঃ ৩০ থেকে ৮০নং পর্যন্ত বিদেশি সুতা এর জন্য ব্যবহৃত হত। বিদেশি সুতা দেশী সুতার তুলনায় অপেক্ষাকৃত সস্তা হওয়ায় দেশী তাঁতিরা বিদেশি সুতার বহুল ব্যবহার শুরু করে।
ঢাকার তৈরী নিকৃষ্টতম কাপড় সিরঞ্জ বা ভোগা তুলার দ্বারা তৈরী করা হত। ভোগা তুলা গারো পাহাড় এবং ত্রিপুরার পাহাড়িয়া এলাকা থেকে এবং সিরঞ্জ তুলা উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে আমদানী করা হত। এসব তুলার কিছু অংশ ঢাকার তাঁতিরা ব্যবহার করত এবং বেশীর ভাগ ময়মনসিংহ, সিলেট, ত্রিপুরা ও নোয়াখালী জিলার তাঁতিরা ব্যবহার করত। এ জাতীয় কাপড়ের মধ্যে যেগুলি অপেক্ষাকৃত ভাল সেগুলিকে বাস্তা বা বুনী বলা হত। কিন্তু এর বেশীর ভাগই ছিল অত্যন্ত মোটা এবং নিকৃষ্ট এবং এদের বলা হত গারা বা গোজী। এসব কাপড় শুধু খুব গরীব লোকেরাই ব্যবহার করত। এর দ্বারা প্যাকিং-এর কাজ অর্থাৎ কিছু বাঁধা বা মোড়ার কাজও চালান হত। গরীব লোকদের মৃত লাশের কাফন দেওয়ার জন্যও এসব কাপড় ব্যবহৃত হত।
সুতা ও সিল্ক মিশ্রিত কাপড়ও ঢাকায় প্রচুর পরিমাণে তৈরী হত। এ জাতীয় কাপড় তৈরীর জন্য ঢাকা শহর এলাকা, ধামরাই ও আবদুল্লাপুর বিশেষ ভাবে বিখ্যাত ছিল। এতে ব্যবহৃত সিল্ক মুগা সিল্ক নামে পরিচিত ছিল এবং মুগা সিল্ক সিলেট ও আসাম থেকে আমদানী করা হত। মসলিনের সুতার ন্যায় সিঙ্কও তাঁতে ব্যবহারের আগে নানা প্রক্রিয়ায় তাঁতের উপযোগী করে নেওয়া হত। এর পদ্ধতি ছিল নিম্নরূপ। প্রথমে সিল্ককে হলুদ মিশ্রিত পানিতে ডুবিয়ে রাখা হত এবং পরে চুনার পানিতে রাখা হত। অতঃপর সিল্ক মুচড়ে নিয়ে শুকিয়ে তাতে পানি মিশ্রিত খৈ-এর মাড় লাগান হত। তারপর সুতা যে-ভাবে নাটাই-এ মোড়ান হয়, তেমনি সিল্কও নাটাইয়ে মোড়ান হত।
ঢাকায় বিভিন্ন প্রকারের সুতা ও সিল্ক মিশ্রিত কাপড় তৈরী হত। এর কতকগুলি ছিল শুধু সুতার তৈরী, শুধু পাড়টাই সিল্কের থাকত, অথবা কোনায় বা কাপড়ের গায়ে মাঝে মাঝে শুধু কয়েকটি সিঙ্কের ফুল বা নকশা তৈরী হত। এ ছাড়া ডোরাকাটা বা সারা কাপড়ের গায়ে সিস্কের নক্সা ও ফুলের কাজ করা অনেক রকমের কাপড়ও তৈরী হত। সুতা ও সিল্ক মিশ্রিত কাপড়ের সংখ্যা প্রায় ত্রিশ রকমেরও বেশী ছিল, তবে তাদের মধ্যে কয়েক রকমের কাপড় যেমন, নওবুটী ও আজিজুল্লাহ বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। এ জাতীয় কাপড়ে সুতার ফুল ও নকশা করা থাকলে তাকে কসিদা বলা হত। এদের দৈর্ঘ্য দেড় গজ থেকে ৬ গজ পর্যন্ত ছিল এবং চওড়া ১ গজ থেকে সোয়া গজ পর্যন্ত ছিল। এর মূল্যও কাপড়ের পরিমাণ মত ২ টাকা থেকে ২০ টাকা পর্যন্ত উঠানামা করত।
সুতা মিশ্রিত সিল্কের কাপড় ঢাকার বাইরে প্রদেশের অন্যান্য জেলায়ও তৈরী হত। এদের মধ্যে মালদহ জেলা এ জাতীয় কাপড় তৈরীর জন্য বিখ্যাত ছিল। মালদহে তৈরী কাপড় মালদিকী (বা মালদহী) নামে পরিচিত ছিল। মালদহে তৈরী কাপড় আবার এলাচী ও মোশরু নামে বিভক্ত ছিল। এদের মধ্যে পার্থক্য ছিল এই যে, এলাচীর রূপ সেরূপ ছিল না অর্থাৎ দুই পিঠেই একরূপ ছিল, কিন্তু মোশরুর দুই পিঠে দুই রকম বুননী বা ডিজাইন ছিল। সুতা মিশ্রিত সিল্ক কাপড় প্রধানতঃ আরব দেশে রপ্তানীর জন্য তৈরী হত।
বর্মা বা অন্যান্য প্রাচ্য. দেশে অল্প-বিস্তর রপ্তানী হলেও এর প্রধান বাজার ছিল আরব দেশে, বিশেষ করে জিদ্দা, মক্কা, বসরা এবং মীনাবাজারে এবং সেখান থেকে মিশর ও ইস্তাম্বুলেও চালান দেওয়া হত।
উপরে ঢাকাই মসলিনের যে বিবরণ দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা যায়, বেশীর ভাগ মসলিনের নাম ফার্সী ও আরবী শব্দ থেকে উদ্ভুত। এতে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, মুসলমান আমলে এসব মসলিনের নামকরণ করা হয়েছে। আগে বলা হয়েছে যে পূর্ব বঙ্গের মসলিন শিল্প বহু দিনের, মুসলমান আগমনের অনেক পূর্ব থেকেই বস্ত্র শিল্পের উৎপত্তি। কিন্তু মসলিন শিল্পের পূর্ণ বিকাশ লাভ করে মুসলমান আমলে এবং ঢাকাই মসলিনের স্বর্ণ যুগ আরম্ভ হয় মোগল আমলেই। শুধু যে মসলিন শিল্পের উন্নতি হয় তাই নয়, দেশ-বিদেশে মসলিনের চাহিদাও দিন দিন বেড়ে যায় এবং অনেক বিদেশী ব্যবসায়ী ঢাকার বাজারে ভীড় শুরু করে।
ইউরোপীয় বণিক কোম্পানীদের বাণিজ্য কেন্দ্র স্থাপনের পরে তাদের অনুরোধে এবং তাদের চাহিদা মিটানোর জন্য নূতন নূতন বিভিন্ন প্রকারের মসলিন তৈরী হতে থাকে, কিন্তু যেহেতু দেশের রাষ্ট্রভাষা তখন ফার্সী ছিল তাদের নামকরণেও ফার্সী প্রভাব পড়ে। ইউরোপীয়দের বাণিজ্যও আরম্ভ হয় মোগল আমলেই এবং মোগল শাসন ব্যবস্থা শিথিল হওয়ার সাথে সাথে মসলিন শিল্পেরও অবনতি ঘটতে থাকে। সুতরাং এক কথায় বলা যায়, মোগল আমলই, প্রধানতঃ সতর শতক, ঢাকার মসলিন শিল্পের স্বর্ণযুগ ছিল । .
Leave a Reply