মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল
ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা ও রাশিয়ান রসকোসমস সংস্থার মধ্যে একটি সহযোগিতামূলক প্রকল্প এক্সোমার্স ট্রেস গ্যাস অরবিটার (টিজিও বা এক্সোমার্স অরবিটার) এবং ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার মার্স এক্সপ্রেস অরবিটার মঙ্গল গ্রহের বিষুবরেখার কাছে অলিম্পাস মন্স আগ্নেয়গিরিতে প্রথমবারের মতো হিম বা তুষার দেখেছে, যেখানে হিমের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব বলে মনে করা হয়েছিল । সত্যিই, এক বিস্ময়কর ঘটনা! অলিম্পাস মন্স শুধুমাত্র মঙ্গলেরই নয়, সৌরজগতের সর্ববৃহৎ-সর্বোচ্চ পর্বত ও আগ্নেয়গিরি যেখানে থার্সিস অঞ্চলে এ হিম আবিষ্কৃত হয়েছে ।
বিশাল ঢাল আগ্নেয়গিরিটি সর্বশেষ বিস্ফোরিত হয়েছিল ২৫ মিলিয়ন বছর আগে । নেতৃত্বদানকারী উদ্ভাবক এডোমাস ভ্যালানটিনাস যিনি সুইজারল্যান্ডের বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি ছাত্র হিসেবে এটি আবিষ্কার করেছিলেন এবং বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল ফেলো ও গ্রহবিজ্ঞানী তিনি বলেছেন: আমরা ভেবেছিলাম মঙ্গল গ্রহে বিষুবরেখার চারপাশে হিম হওয়া অসম্ভব । কারণ, এখানে সূর্যালোক ও পাতলা বায়ুমণ্ডলের মিশ্রণ ভূপৃষ্ঠ এবং পর্বতচূড়া উভয় স্থানেই তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত বেশি বজায় রাখে ।
আমরা পৃথিবীতে যা দেখি তার থেকে ভিন্ন যেখানে আপনি হিমশীতল শিখর দেখার আশা করতে পারেন । এখানে হিমের অস্তিত্ব উত্তেজনাপূর্ণ এবং ইঙ্গিত দেয় যে খেলার মধ্যে ব্যতিক্রমী প্রক্রিয়া রয়েছে যা হিম গঠনের অনুমতি দিচ্ছে । আমরা যা দেখছি তা অতীতের মঙ্গল জলবায়ুর একটি চিহ্ন হতে পারে । হয়তো এটি বায়ুমণ্ডলীয় জলবায়ু প্রক্রিয়াগুলোর সাথে সম্পর্কিত যা মঙ্গল গ্রহের ইতিহাসে আগে কাজ করেছিল, সম্ভবত লক্ষ লক্ষ বছর আগে । থার্সিস হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের পশ্চিম গোলার্ধে বিষুবরেখার কাছে কেন্দ্রীভূত একটি বিশাল আগ্নেয় মালভূমি । এ অঞ্চলটি সৌরজগতের বৃহত্তম আগ্নেয়গিরির আবাসস্থল, যার মধ্যে কয়েকটি বৃহদাকার ঢাল আগ্নেয়গিরি আর্সিয়া মন্স, পেভোনিস মন্স এবং অ্যাসক্রেয়াস মন্স যেগুলো সম্মিলিতভাবে থার্সিস মন্টেস নামে পরিচিত । এখানে অলিম্পাস মন্স আগ্নেয়গিরিসহ প্রায় এক ডজন আগ্নেয়গিরির বসতি । এ আগ্নেয়গিরিগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই দৈত্যাকার, যা পৃথিবীর মাউন্ট এভারেস্টের চেয়ে এক থেকে তিন গুণ পর্যন্ত উচ্চতায় আশেপাশের সমভূমির উপরে বিস্তৃত ।
মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে উঁচু আগ্নেয়গিরি হচ্ছে অলিম্পাস মন্স যেটি থার্সিস অঞ্চলের সাথে যুক্ত কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মালভূমির পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত । থার্সিস থেকে পূর্ব দিকে প্রসারিত ক্যানিয়ন ব্যবস্থা হচ্ছে ভেলেস মেরিনেরিস । উত্তরে ডিম্বাকৃতির বৈশিষ্ট্য আলবা মন্স । থার্সিস অঞ্চল মঙ্গল গ্রহের পশ্চিম গোলার্ধে আধিপত্য বিস্তার করে । থার্সিস নামটি হচ্ছে বাইবেলের থার্শিশ এর গ্রিকো-ল্যাটিন প্রতিবর্ণীকরণ বা বর্ণান্তরণ, যা পরিচিত জগতের পশ্চিম প্রান্তের ভূমি । আগ্নেয়গিরিগুলোর চূড়ায় জ্বালামুখ বা গর্ত (ক্যালডেরা) এবং বিশাল ফাঁপা (হোলো) রয়েছে যা অতীতে অগ্ন্যুৎপাতের সময় ম্যাগমা প্রকোষ্ঠ খালি হওয়ার কারণে ঘটেছিল ।
গবেষকরা অনুমান করেন যে, থার্সিসের উপরে একটি অদ্ভুত উপায়ে বাতাস সঞ্চালিত হয় এবং এটি সেখানে আগ্নেয়গিরির জ্বালামুখের মধ্যে এক অনন্য ছোট জলবায়ু (ইউনিক মাইক্রোক্লাইমেট) গঠন করে যেটি হিমের প্যাচ বা টুকরো বা তাপ্পি তৈরি করতে সাহায্য করে । মানুষের চুলের চেয়ে পাতলা (সম্ভবত এক মিলিমিটারের মাত্র একশতাংশ পুরু) বরফের সূক্ষ্ম কণা আগ্নেয়গিরির চূড়ার জ্বালামুখ এবং তার চক্রবেড়ের (রিম) অংশগুলোতে রাতারাতি তৈরি হতে দেখা যায় । সূর্যালোকে বাষ্পীভূত হওয়ার আগ পর্যন্ত সূর্যোদয়ের সময় চারপাশে হিম টুকরো বা সূক্ষ্ম বরফ কণা বা তাপ্পিগুলো (দি প্যাচেস অফ ফ্রস্ট) কয়েক ঘন্টার জন্য উপস্থিত থাকে । হিমশীতল স্তরটি ব্যতিক্রমভাবে পাতলা হওয়া সত্ত্বেও এটি একটি বিশাল এলাকা জুড়ে আবরণ করে । হিমের পরিমাণ ঠাণ্ডা ঋতুতে প্রতিদিন প্রায় ১৫০০০০ টন জল পৃষ্ঠতল ও বায়ুমণ্ডলের মধ্যে অদলবদল হয়, যা প্রায় ৬০টি অলিম্পিক সুইমিং পুলের সমতুল্য এবং উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় প্রতিদিন ঘনীভূত হয় ।
টিজিও অরবিটারের কালার এন্ড স্টেরিও সারফেস ইমেজিং সিস্টেমের (সিএএসএসআইএস) প্রধান তদন্তকারী, বার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের এডোমাস এর পিএইচডি সুপারভাইজার এবং সহ-উদ্ভাবক নিকোলাস থোমাস বলেছেন: বাতাস পাহাড়ের ঢালে ভ্রমণ করে, তুলনামূলকভাবে আর্দ্র বাতাস ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থেকে উচ্চ-উচ্চতায় নিয়ে আসে যেখানে এটি ঘনীভূত হয় এবং বছরের নির্দিষ্ট সময়ে হিমের মতো স্থায়ী হয় । আমরা আসলে পৃথিবী এবং মঙ্গল গ্রহের অন্যান্য অংশে এটি ঘটতে দেখি, একই ঘটনা ঘটাচ্ছে মৌসুমী মঙ্গলের আর্সিয়া মন্স এলংগাটেড ক্লাউড । আমরা মঙ্গল গ্রহের আগ্নেয়গিরির শিখরে যে হিম দেখতে পাই তা বিশেষ করে জ্বালামুখের ছায়াযুক্ত অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে বলে মনে হয়, যেখানে তাপমাত্রা বেশি ঠাণ্ডা । মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণকারী মহাকাশযানগুলো এর আগে মঙ্গলে হিমায়িত এবং তরল জলের প্রমাণ দিয়েছে । এ গ্রহের উত্তর ও দক্ষিণ মেরুতে যথেষ্ট পরিমাণে বরফ দেখা গেছে । ভূদৃশ্যের নিদর্শনগুলো থেকে বোঝা যায় যে রক্তিম গ্রহটি একসময় অনেক বেশি আর্দ্র, ছড়িয়ে পড়া দৈত্যাকার হ্রদ, চঞ্চল বা আঁকিয়া বাঁকিয়া যাচ্ছে এমন নদী এবং সম্ভবত বাসযোগ্যও ছিল ।
মঙ্গল গ্রহের বর্তমান জলচক্রটি বাসযোগ্যতা এবং ভবিষ্যৎ মানুষের অনুসন্ধানের জন্য প্রভাব ফেলছে । যেমন থার্সিস আগ্নেয়গিরি অঞ্চলের উপরে জলের বরফ মেঘ এবং জলীয় বাষ্প সনাক্ত করা হয়েছে, যা রেগোলিথ এবং বায়ুমণ্ডলের মধ্যে জলের সক্রিয় বিনিময়কে অনুমান করা হয় । আনন্দের বিষয় হচ্ছে গ্রহ বিজ্ঞানী এডোমাস ভ্যালানটিনাস, নিকোলাস থোমাস এবং তাদের সহকর্মীরা অলিম্পাস মন্স, আর্সিয়া মন্স, অ্যাসক্রেয়াস মন্স এবং সেরাউনিয়াস থোলাস এর থার্সিস আগ্নেয়গিরিতে হিম আবিষ্কার করেছেন । এ হিমগুলো কিভাবে তৈরি হয় তার মডেলিং বিজ্ঞানীদের মঙ্গল গ্রহের অবশিষ্ট গোপন রহস্যগুলোকে প্রকাশ করার অনুমতি দিতে পারে যেখানে জলের অস্তিত্ব রয়েছে ও কিভাবে এটি জলাধারগুলোর মধ্যে চলে যায় এবং গ্রহের জটিল বায়ুমণ্ডলীয় গতিবিদ্যা বোঝার ক্ষেত্রে । মঙ্গল গ্রহের ভবিষ্যৎ অনুসন্ধান এবং পৃথিবীর বাইরে প্রাণের সম্ভাব্য লক্ষণগুলো অনুসন্ধানের জন্য এ ধরণের জ্ঞান অপরিহার্য । এডোমাস ভ্যালানটিনাস আরো বলেন: এ আবিষ্কারটি মঙ্গল গ্রহের বিষুবরেখায় প্রথমবারের মতো হিম পাওয়া গেছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে । কিন্তু আগে কেন দেখা গেল না? কয়েকটি কারণ রয়েছে: প্রথমত, আমাদের একটি কক্ষপথ দরকার যা ভোরবেলা একটি অবস্থান পর্যবেক্ষণ করতে হয় । যদিও ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করার ক্ষেত্রে টিজিও অরবিটার এবং মার্স এক্সপ্রেস অরবিটারে এ ধরনের কক্ষপথ রয়েছে যা দিনের সব সময় পর্যবেক্ষণ করতে পারে ।
এছাড়া অন্যান্য সংস্থা থেকে অনেকগুলো সূর্যের সাথে সমলয় (সিনক্রোনাইজড) করা হয় যা শুধুমাত্র বিকেলে পর্যবেক্ষণ করতে পারে । দ্বিতীয়ত, জমাট শীতল মঙ্গল ঋতুর সাথে যুক্ত থাকে হিম যা জানালাটিকে আরো সংকীর্ণ করে দেয় । আমাদের জানতে হবে কোথায় এবং কখন ক্ষণস্থায়ী নীলাভ হিম খুঁজতে হবে । বিষুবরেখার কাছে গবেষণার জন্য আমরা অন্য কিছু খুঁজছিলাম, কিন্তু মঙ্গলের আগ্নেয়গিরির শীর্ষে এটি দেখার আশা করিনি! ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার টিজিও অরবিটার এবং মার্স এক্সপ্রেস অরবিটারের প্রকল্প বিজ্ঞানী কলিন উইলসন বলেছেন: মঙ্গল গ্রহের উপরিভাগে জল খোঁজার বিষয়টি সবসময়ই উত্তেজনাপূর্ণ, বৈজ্ঞানিক স্বার্থ এবং এর প্রভাবের জন্য মানব ও রোবোটিক উভয় অনুসন্ধানই গুরুত্ব বহন করে । এমনকি এ আবিষ্কারটি বিশেষভাবে আকর্ষণীয় । মঙ্গল গ্রহের নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় চাপ একটি অপরিচিত পরিস্থিতি তৈরি করে যেখানে গ্রহের পাহাড় চূড়াগুলো সাধারণত তার সমভূমির চেয়ে বেশি ঠাণ্ডা হয় না, কিন্তু মনে হচ্ছে আর্দ্র বাতাস পাহাড়ের ঢালে প্রবাহিত হয়ে এখনো হিমে পরিণত বা ঘনীভূত হতে পারে, এটি নিশ্চিতভাবে পৃথিবীর মতো একটি ঘটনা ৷
আশ্চর্যজনক আবিষ্কারটি ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা এবং রাশিয়ান রসকোসমস সংস্থার প্রদক্ষিণকারী দুই মঙ্গল অভিযাত্রী টিজিও অরবিটার এবং মার্স এক্সপ্রেস অরবিটারের কৃতিত্ব । তারা মঙ্গল গ্রহে দুর্দান্তভাবে হিম আবিষ্কার করেছে । টিজিও অরবিটার ২০১৬ খ্রিস্টাব্দে মঙ্গলে পৌঁছেছিল এবং ২০১৮ খ্রিস্টাব্দে সম্পূর্ণ বিজ্ঞান মিশন শুরু হওয়ার পর থেকে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ, বায়ুমণ্ডল এবং জলের ছবি ও মানচিত্রকরণ করেছে । ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে মার্স এক্সপ্রেস অরবিটার মঙ্গল গ্রহকে প্রদক্ষিণ করার মধ্য দিয়ে মঙ্গল গ্রহের পৃষ্ঠ, উপ পৃষ্ঠ, খনিজ পদার্থ, বায়ুমণ্ডল এবং নানা ঘটনা অন্বেষণে দুই দশক অতিবাহিত করছে । গবেষণা দলটি প্রথমে টিজিও অরবিটারের সিএএসএসআইএস যন্ত্রের সাহায্যে হিম দেখেছে । তারপর তারা টিজিও অরবিটারের নাদির এন্ড অককালটেশন ফর মার্স ডিসকভারি (এনওএমএডি) স্পেকট্রোমিটার এবং মার্স এক্সপ্রেস অরবিটারের হাই রেজ্যুলিউশন স্টেরিও ক্যামেরা (এইচআরএসসি) ব্যবহার করে এলাকাটি পুনরায় দেখে তাদের অনুসন্ধান নিশ্চিত করেছে ।
লেখক: মুহাম্মদ আস্রাফুল আলম সোহেল ফার্মাসিস্ট
তথ্যসূত্র: ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থা, দি গার্ডিয়ান ।
ছবি: ইউরোপীয় মহাকাশ সংস্থার
Leave a Reply