মাহমুদুল হককে বাদ দিয়ে বাংলা উপন্যাসকে ভাবা ভুল হবে। বাংলাদেশে কেন মাহমুদুল হক বহু পঠিত নয় বা তাঁকে নিয়ে কম আলোচনা হয় এ সত্যিই এক প্রশ্ন।
মাহমুদুল হকের সাহিত্য নিসন্দেহে স্থান নিয়েছে চিরায়ত সাহিত্যের সারিতে।
তার উপন্যাস জীবন আমার বোন শুধু সময়ের চিত্র নয়, ইতিহাসকে গল্পের মধ্যে দিয়ে আনা নয় সেখানে রয়ে গেছে আরো অনেক কিছু।
তরুণ প্রজম্মের পাঠকের কাজে তাই তুলে দেয়া হলো মাহমুদুল হকের এই অনবদ্য উপন্যাস জীবন আমার বোন। আর আগের প্রজম্ম নিশ্চয়ই নতুন করে আরেকবার গ্রহন করুক এক অমৃত সাহিত্য। – সম্পাদক
বিড়াল দেখিয়ে দিলো রুরুরুরু নীলাভাবীকে। নীলাভাবী দেখিয়ে দিলো রুরুরুরু বিড়ালকে। রুরুরুরু পরস্পর পরস্পরকে। আমি দেখিয়ে দিলাম রুরুরুরু গোলাপগুচ্ছকে, গোলাপগুচ্ছ রুরুরুরু আমাকে, রুরুরুরু পরস্পর পরস্পরকে। বিড়াল বললে রুরুরুরু গোলাপ একদিন শুকিয়ে যায়; আমি পিঠ দেবো। নীলাভাবী বললে রুরুরুরু বিড়াল কখনো মিথ্যে বলে না, দ্যাখো না চোখ নেই ওর পিছনে, বিড়াল কখনো রুরুরুরু গোলাপকে ভয় পায় না–থাকুক কাঁটা, দংশন, বিড়াল জানে চার চারটি তার থাবা: একে যোনী, দুয়ে স্তন, তিনে দংশন, চারে বন্ধন,–গোলাপের কাঁটার চেয়েও বেশি নখ সেই চার থাবায়। শেষে সরোবর ভেঙে ডোম্বী মৃণাল খায়, ডোম্বী তোমাকে আমি মারবো ব’লে রুরুরুরু থোকাকাহ্নপাদ বিড়ালের পিঠে সওয়ার হলাম। আমি জানি না কে আমাকে বারুণী দিলো, আমি জানি না কে আমাকে ডমরু শোনালো, আমি মদকলকরী খোকাকাহ্নপাদ বিড়ালের পিঠে সওয়ার হলাম। আমি জানি নাকে আমাকে বারুণী দিলো, আমি জানি না কে আমাকে ডমরু শোনালো, আমি মদকলকরী খোকাকাহ্নপাদ প্রবেশ করলাম নলিনীবনে–
রুরুরুরু
কীটদষ্ট ঠাকুমার ঝুলির কতোগুলো পাতা বাতাসের ফেনার মতো ফরফর ক’রে ঘুরপাক খায় চতুর্দিকে। দৃশ্য পরম্পরায় কতোগুলো ছবি অলীক ছায়ানৃত্যে মূর্ত হ’য়ে ওঠে; এইভাবে আমার জীবনের একটি অধ্যায় অভাবনীয় আকস্মিকতায় সমাপ্তির রেখা টেনেছিলো, তীক্ষ্ণ ঘৃণায় এফোঁড়-ওফোঁড় হ’য়ে যায় খোকা। একটা রিকশা ধ’রে পাগলের মতো ঘুরেছিলো সে। একবার সেকেন্ড ক্যাপিটালের দিকে, একবার নীলখেতের দিকে, এদিকে-ওদিকে চতুর্দিকে ঘুরেছিলো কেবল, কোনো হুঁশজ্ঞান ছিলো না, এবং গভীর রাত মাথায় ক’রে ঘরে ফিরেছিলো।
আমি একটা লোচ্চা, তার এইসব মনে হয়েছে, আমার কোনো বাছবিচার নেই, আমি একটা লম্পট, কামুক; আজ আমি নীলাভাবীকে বিছানায় কাত করেছি, সবে শুরু আমার, হয়তো কালই আবার হন্যে হ’য়ে উঠবো, আবার কাউকে চিত করবো। পরপর কয়েকটা দিন এইভাবে সে নিজের মনের সঙ্গে ক্রমাগত যুদ্ধ করেছে। ভিতরের গরল ভুড় ভুড় ক’রে গেঁজে উঠেছে। পরিত্রাণ চাই! পরিত্রাণ! পাগলের মতো বেরিয়েছে ঘর থেকে, মুরাদকে চাই, সারা শহর খুঁড়ে বের করতে হবে মুরাদকে; শেষ পর্যন্ত সালামারে নিয়ে গিয়েছিলো মুরাদ, এপ্রিলের একটি আস্ত রাত বমি ক’রে সে ভাসিয়ে দিয়েছিলো। সেই একবারই তার মনে হয়েছিলো মদ কি কুচ্ছিত জিনিশ; অস্থিরতার দাপটে চূড়ান্তভাবে পর্যুদস্ত হয়েছিলো সে। অঞ্জু আর মঞ্জু হারিয়ে গিয়েছিলো কিভাবে?
বাথরুমের আয়নার মতো সেই পারদ ওঠা ঝাপসা ছবিটি ঝাড়পৌঁছ করে খোকা; মামাবাড়ির পুকুরের শ্যাওলা ধরা শানে পা হড়কে পানিতে ছিটকে পড়লো অঞ্জু, আর দু’হাত বাড়িয়ে তাকে ধরতে গেল মঞ্জু, তারপর অঞ্জু মঞ্জুকে টেনে নিয়ে গেল আরো গভীরে, শেষে অঞ্জু আর মঞ্জু, মঞ্জু আর অজু, অজু মঞ্জু মঞ্জু অঞ্জু গলা জড়াজড়ি ক’রে ডুবে মরলো।
Leave a Reply