স্বদেশ রায়
২০১৯ এ পশ্চিমবঙ্গের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি অনেকটা বড় সাফল্য পেয়েছিলো। ওই ফলের ওপর ভিত্তি করে বিজেপি ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ক্ষমতা দখলের চেষ্টায় সর্বশক্তি নিয়ে নেমেছিলো। ক্ষমতা দখল করতে না পারলেও তারা রাজ্যর প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আবিভূর্ত হয়। যার ফলে তারা মনে করেছিলো এবার লোকসভায় ২০১৯ এর থেকে ভালো করবে।
ভারতের লোকসভা নির্বাচনের পরে ওইভাবে এখনও তাদের সার্বিক নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করে কোন লেখা লিখিনি। তবে সে দেশের নির্বাচনের তৃতীয় ফেজের পরেই ওই দেশের এবং আমাদের দেশের কিছু বন্ধু বান্ধব ও পরিচিত জনের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বলেছিলাম বিজেপি একক সংখাগরিষ্টতা পাবেনা। তাদের আসনের সংখ্যা ২৫০ এর নিচেই রেখেছিলাম।
তবে নানা নতুন ইস্যু সামনে আসায় ভারতের সার্বিক নির্বাচন নিয়ে এখনও লেখা হয়নি। তাছাড়া, দক্ষিন ভারতের এবারের ভোটের চরিত্র বোঝায় কিছু ঘাটতি রয়েছে। তা যথাসম্ভব পূরনের আগে সামগ্রিক ভারতের লোকসভা নিয়ে লেখাও সম্ভব নয়।
নির্বাচনের তৃতীয় ফেজে এসে পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছুটা সময় কাটাই। সে সময়েই যে পর্যবেক্ষণগুলো সামনে আসে তা থেকে একটা বিষয় অন্তত স্পষ্ট হয় বিজেপি বা তার সমর্থক যারা মিডিয়ায় আসেন তারা একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছেন না। তাদের কাঙ্খিত সাফল্য না পাবার জন্যে তারা যে বিষয়গুলো সামনে আনছেন সেগুলোর কিছু হয়তো সঠিক তবে তারা তাদের সংগঠনের ভেতরের অবস্থার দিকে চোখ দিচ্ছে্ন না। যা শুধু পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নয় অনেক রাজনৈতিক দলের জন্যে গুরুত্বপুর্ণ।
যে কোন রাজনৈতিক দল তাই তার আদর্শ যাই হোক না কেন, একদিনে দাঁড়ায় না। এবং সব কিছুর উর্ধ্বে তার পেছনে ও তার শারীরিক কাঠামোর মধ্যে অনেক শ্রম ও ত্যাগের একটা যোগ থাকে। তবে বিজেপি যদিও আর,এস,এস এর মতো ক্যাডার ভিত্তিক একটি সংগঠন দ্বারা শাসিত; তারপরেও দলটি তৃতীয় বিশ্বের। তার ওপরে ভারত উপমহাদেশের। যে উপমহাদেশটি আসলে গুরু বা কাল্ট পূঁজোর জন্যে বিখ্যাত । তাই এখানে কোন রাজনৈতিক দল ওই অর্থে কখনও ক্ষমতায় যেতে পারে না। দল ও রাজনৈতিক কর্মীরা ক্ষমতায় নিয়ে যায় ঠিকই- তবে শেষ অবধি ক্ষমতায় থাকে বিশেষ করে একজন ও কয়েকজন ব্যক্তি। যার ফলে মূল গুরু, কিছু বড় গুরু, কিছু ছোট ছোট গুরু ক্ষমতা ভোগ করে।
আর এ সময়ে সব থেকে যে বড় বিষয়টি ঘটে, কিছু রাজনৈতিক কর্মী তারা ওইসব গুরুদের প্রতি শুধু আনুগত্য প্রকাশ না করে- তাদের ত্যাগের প্রাপ্য সম্মান দাবী করে। যে কোন গুরুর কাছে অন্যকে সম্মান দেয়াটা বড়ই অসহনীয় বিষয়। আর যখনই কোন রাজনৈতিক দলের এ উপমহাদেশে ক্ষমতা যাবার ফলে এই মেটামরফিস ঘটতে থাকে তখনই সুযোগ নিয়ে নেয় সুবিধাবাদী কিছু কীট। যারা সহজেই তখন ওই পরিবর্তনের পঁচা জায়গাগুলোর পথে ঢুকে যায়। যে কারনে যদিও গত প্রায় একশ বছর ধরে এই উপমহাদেশে কয়েকটি রাজনৈতিক দলই নানা ভাবে আধিপত্য বিস্তার করছে- কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই প্রস্থানগুলো কখনও সম্মানজনক হয় না।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এই বড় আকারের উত্থানটি ঘটেছে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পরে। ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতির প্রভাব তার ওপর স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে। এখানেই পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির সব থেকে বড় দুর্বলতা। এই দুর্বলতার কারণেই ২০২১ এর বিধানসভা ও ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে যেমনটি তারা মনে করেছিলো ফলাফলে সেটা ঘটেনি।
যে কোন নির্বাচনে মানুষের সমর্থন আর ভোটের বাক্সে ভোট আনা এক বিষয় নয়। এ শুধু তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে নয়, উন্নত বিশ্বেও। যেমন আমেরিকায় আফ্রিকান আমেরিকান ভোটারদের একটি বড় অংশ ডেমোক্রেটদের সমর্থক। এমনকি এই সমর্থন ওবামার নির্বাচনের সময় আরো বেড়ে গিয়েছিলো । তারপরেও তাদের একটি অংশকে ভোট কেন্দ্রে নেয়ার জন্যে সংগঠন সঠিকভাবে কাজ করেনি। ওবামা জিতলেও হিলারি হেরে গিয়েছিলেন। তবে তারও ভোটের ব্যবধান কমানো যেতো যদি কেন্দ্রে আফ্রিকান আমেরিকান ও ল্যাটিনো ভোটারদের নেয়ার ব্যবস্থা করা হতো। ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচন পরবর্তী ও মূল্যায়নপত্র থেকে যা পত্র পত্রিকায় এসেছিলো সেখানে বিষয়টি স্পষ্ট ছিলো।
বাস্তবে কোন রাজনৈতিক দলের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্যে বেশিক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের কর্মীদের ত্যাগ ও আন্তরিকতা লাগে। সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন পড়ে সেই ধরনের রাজনৈতিক কর্মী ও নেতা যারা নির্বাচনের মাঠ চেনেন এবং প্রার্থী চেনেন। কারণ, নির্বাচনের মাঠ ও প্রার্থীর সঠিক স্থাপন না হলে কখনই সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রার্থী কেন্দ্রিক নির্বাচনে ভোটের সংখ্যাকে সঠিকভাবে প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ানোর কাজে সফল হওয়া যায় না।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির রাজনীতিতে বর্তমানে মূল সমস্যা এখানে। অর্থাৎ যারা প্রকৃত বিজেপির ত্যাগী কর্মী, তারা কোন এলাকায় মাত্র পাঁচ হাজার হোক, তারপরেও ওই এলাকায় তারাই মূলত সংগঠন গড়ে তুলেছে। সংগঠন গড়তে গিয়ে তারা এলাকার ও মানুষের ডিএনএ সম্পর্কে বিশদ জানে। এই কর্মী ও নেতাদের একটি বড় অংশ গত দশ বছরে মূলধারা থেকে ছিটকে পড়েছে- অর্থাভাবে ও সম্মান দাবী করায়।
এর বদলে অন্য দলে থাকা অর্থের মালিক এবং সুবিধাবাদী রঙবদলকারী গিরগিটিরা এসে দলের বড় অংশ দখল করে নিয়েছে। যার ফলে এখান থেকে তিরিশ বছর আগের থেকে যারা পশ্চিমবঙ্গে বিজেপিকে নিয়ে হাঁটতো, তাদের বেশিভাগই এবারের নির্বাচনে ঘরে বসে ছিলো। যার ফলে যে বিজেপির একজন কর্মীকে কোথাও চারটার সময় থাকার কথা থাকলে সে সাড়ে তিনটা থেকে দাঁড়িয়ে থাকে- সেই কালচার সবখানে এবার ছিলো না। তার বদলে পাঁচটা অবধি অপেক্ষা করেও এই ক্ষমতাসীনের ছাতার ছায়ার পার্টির অনেক কর্মীকে পাওয়া যায়নি। এ কারণে পশ্চিমবঙ্গে এ মুহূর্তে বিজেপি রাজনীতির অন্যতম ঘাটতি তাদের দলের দুর্দিনের ত্যাগী কর্মীদেরকে পেছনে ফেলে অর্থওয়ালা ও গিরিগিটিরা এগিয়ে গেছে অনেকখানি। এখানেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ভোটের রাজনীতিতে পিছিয়ে থাকার অন্যতম কারনটি নিহিত।
যদিও নির্বাচনে বিজেপির পশ্চিমবঙ্গে পরাজয়ের পরে অনেকে বিশ্লেষণ করেন, পশ্চিমবঙ্গ অনেক অগ্রসর একটি প্রদেশ। এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোন স্থান নেই। এমনি নানা কিছু। এ মূলত কোলকাতা কেন্দ্রিক একটি আত্মতৃপ্তি। যারা এ কথা বলেন, তাদের কথার কোন উত্তর না দিয়েই- জ্যেতি বসুর একটা কথা দিয়েই তো সব সমাধান হয়ে যায়। তিনি তাঁর নিজের কমিউনিজম নিয়ে বলতে গিয়ে বলেছিলেন, আমার স্ত্রী যান রোজ কালীঘাটে, আমি সে দেশে কী কমিউনিজম আনব? এটাই মূলত বাস্তবতা পশ্চিমবঙ্গের। তাদের নিজেরদেরকে সুপিরিয়র ভাবার কোন কারণ নেই।
একটা সময় আমরাও মনে করেছি, রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে এই উপমহাদেশে একটি আধুনিক সমাজ গড়া সম্ভব। আমাদের পূর্বসূরীরাও ভেবেছিলেন। কিন্তু এ উপমহাদেশের রাজনৈতিক দলের বাস্তবতা ভিন্ন।এখানে যে কোন নামেই হোক- ধর্মকে রাজনীতিতে ব্যবহার করা হয়। যিনি যে রূপেই থাকুন না কেন, দিন শেষে নানা নামে কালীঘাটে যান।
তাই এই উপমহাদেশের ভোটের রাজনীতিতে আধুনিকতা, ইহজাগতিকতা এসব ভাবার কোন স্থান নেই। আগামী কয়েক’শ বছরেও ভাবার কোন সুযোগ নেই। কারণ, আধুনিকতা, ইহজাগতিকতা একটা কালচার, একটা শিক্ষা ও বোধ এখানে পৌঁছাতে জ্ঞাননির্ভর জীবনাচারনের পথে হাঁটতে হয়। তা বশিষ্ট’র তপস্যার মতো। অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান বা জাগতিক সত্যকে উপলব্দি করার সংগ্রামে বিজয়ী হওয়া। অর্থাৎ নিজের জীবনকে আরেকটা বিবর্তনবাদের মাধ্যমে পরিবর্তন করা। সে এক অন্যজগত। রবীন্দ্রনাথের মতো, আমি কে? এই সত্য খোঁজার পথে চলা। এ জগতে এ উপমহাদেশের রাজনীতিকে ডেকে আনার কোন কারণ নেই।
এ কারণে পশ্চিমবঙ্গের বিজেপির নির্বাচনে কাঙ্খিত ফল না পাবার মূলে সেখানকার আধুনিক চিন্তা বা তথাকথিত কথাবার্তা কোন বিষয় নয়।মূলত দলের নিবেদিত কর্মীরা দূরে চলে গেছে। অন্যদিকে, “ক্ষমতার দল” নতুন করে সুবিধাবাদীর তুলনায় নিবেদিত কর্মী ও নেতা কম তৈরি করতে পারছে।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply