“এটি একটি অলৌকিক ঘটনা।”
সত্তর বছর বয়সী সাফিনা নামুকওয়ায়ার আইভিএফ প্রযুক্তির সাহায্যে যমজ সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর তার মুখ থেকে এই কথাটি বেরিয়ে আসে।
এর আগে ২০২২ সালের ২৯শে নভেম্বর উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় ওই সন্তানদের প্রসব করেন তিনি।
আফ্রিকার ওই দেশটিতে সন্তান প্রসব করা সবচেয়ে বয়স্ক নারীদের একজন সাফিনা।
ওমেন্স হসপিটাল ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড ফার্টিলিটি সেন্টারে অস্ত্রপচারের মাধ্যমে তিনি একটি মেয়ে ও একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেন।
ওই হাসপাতালের ফার্টিলিটি বিশেষজ্ঞ ড. এডওয়ার্ড তামালে সালি বিবিসিকে বলেছেন, সাফিনা একজন ডোনারের (দাতা) ডিম্বাণু এবং তার স্বামীর শুক্রাণুর সাহায্যে এই শিশুদের জন্ম দেন।
সাফিনা নামুকওয়ায়া তিন বছর আগে ২০২০ সালে একইভাবে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছিলেন।
এত বয়সে মা হওয়ার একমাত্র কারণ ছিল নিঃসন্তান হওয়ায় মানুষের কটূক্তি তিনি আর নিতে পারছিলেন না।
সাফিনার মতো, ভারতের গুজরাট রাজ্যের বানাসকাঁথা জেলার বাসিন্দা গীতা বেনকেও (ছদ্মনাম) সন্তান না হওয়ায় সমাজের কাছ থেকে ব্যাপক কটূক্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল।
অবশেষে, তিনি আইভিএফ পদ্ধতি বেছে নেন এবং ২০১৬ সালে এক সন্তানের মা হন।
(অনেক নিঃসন্তান দম্পতিকে মা বাবা হওয়ার আনন্দ দিয়েছে এই আইভিএফ পদ্ধতি)
গীতা বেন বিবিসির সংবাদদাতা আর দ্বিভেদিকে জানান, বিয়ের ২৫ বছর পর যখন তিনি মা হয়েছেন, তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৪২ বছর।
এখন তিনি ও তার স্বামী মনোজ কুমার (ছদ্মনাম) তাদের সাত বছরের ছেলেকে নিয়ে খুব খুশি।
মনোজ কুমার জানান, বিয়ের এত বছর পরেও সন্তান না হওয়ায় বহুবার মানুষের কটূক্তি শুনেছেন তিনি।
এতে বিরক্ত হয়ে তারা পরিচিতজন ও আত্মীয়দের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেন, এমনকি তাদের বিয়ের দাওয়াতে যাওয়াও বন্ধ করে দেন।
ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন (আইভিএফ) হচ্ছে প্রজনন সমস্যায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সন্তান জন্মদানে সহায়তা করার জন্য প্রচলিত বেশ কয়েকটি কৌশলের মধ্যে একটি।
আইভিএফ পদ্ধতিতে, নারীদের ডিম্বাশয় থেকে একটি ডিম্বাণু অপসারণ করা হয় এবং পরীক্ষাগারে সেটি শুক্রাণু দিয়ে নিষিক্ত করা হয়।
নিষিক্ত ডিম্বাণু, যাকে ভ্রূণ বলা হয়, সেটিকে নারীর গর্ভে প্রবেশ করানো হয়, যেন সেটি মায়ের গর্ভে বৃদ্ধি ও বিকাশ লাভ করতে পারে।
এই পদ্ধতিতে দম্পতিরা নিজেদের ডিম্বাণু ও শুত্রাণু ব্যবহার করতে পারে কিংবা ডোনারের ডিম্বাণু ও শুক্রাণু ব্যবহার করতে পারে।
(ফেলোপিয়ান টিউব বা গর্ভনালী)
আইভিএফ পদ্ধতিতে বাচ্চা ধারণ শুরু হয়েছিল ১৯৭৮ সাল থেকে। সেসময় লেসলি ব্রাউন নামে একজন নারী বিশ্বে প্রথমবারের মতো টেস্টটিউব শিশুর জন্ম দেন।
গুজরাট রাজ্যের আনান্দ জেলার আকাঙ্ক্ষা হাসপাতাল ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের মেডিকেল পরিচালক, ডা. নেয়না প্যাটেল, বিবিসিকে বলেছেন, “আইভিএফ পদ্ধতি মূলত নারীদের উপর প্রয়োগ করা হয়। বিশেষ করে, যেসব নারীর ফেলোপিয়ান টিউব (গর্ভনালী) সংক্রমণ বা অন্য কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যায়।”
তিনি আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, “এই পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা ল্যাবে ডিম্বাণু ও শুক্রাণু নিষিক্ত করি। এরপর ভ্রূণ প্রস্তুত হলে, সেটি নারীর জরায়ুতে ঢোকানো হয়।”
“এই প্রযুক্তি অনেক দম্পতিকে বাবা-মা হওয়ার সুখ দিয়েছে এবং নারীদের বন্ধ্যাত্ব দূর করেছে,” তিনি বলেন।
তিনি ১৯৯১ সালে প্রবর্তিত ইন্ট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকশন (আইসিএসআই) কৌশলকে এই বিপ্লবের দ্বিতীয় পর্যায় হিসাবে বর্ণনা করেন।
তার মতে, “আইসিএসআই সেইসব দম্পতিকে বাবা-মা হতে সাহায্য করেছে, যেখানে পুরুষের শুক্রাণুর মান খুব দুর্বল ছিল এবং এ কারণে যারা সন্তান নিতে পারছিলেন না।”
“এই পদ্ধতি ডোনারের শুক্রাণুর প্রয়োজনীয়তাও দূর করেছে।” এ কারণেই মানুষ এখন বিনা দ্বিধায় একে গ্রহণ করছে।
(নিষিক্ত ভ্রূণ গর্ভে স্থাপন)
এই পদ্ধতি ছয়টি ধাপে সম্পন্ন হয়।
সবার আগে নারীর প্রাকৃতিক মাসিক চক্র ওষুধ দিয়ে বন্ধ করা হয়।
এরপর নারীর ডিম্বাশয়ে যেন একাধিক ডিম উৎপাদন হতে পারে, এজন্য ওষুধ দেওয়া হয়।
এই প্রক্রিয়া কতটা কাজ করছে অর্থাৎ ডিম পরিপক্ক হচ্ছে কিনা, সেটা আল্ট্রাসাউন্ড স্ক্যান করে পর্যবেক্ষণ করা হয়। চিকিৎসকরা প্রয়োজনীয়তা বুঝে ডিম পরিপক্ক হতে ওষুধ দিতে পারে।
নারীর যোনিপথ দিয়ে ডিম্বাশয়ের মধ্যে একটি সুই ঢুকিয়ে ডিম সংগ্রহ করা হয়।
ওই ডিমগুলোকে কয়েক দিনের জন্য শুক্রাণুর সাথে মেশানো হয় যাতে সেগুলো নিষিক্ত হতে পারে।
এরপর একটি বা দু’টি নিষিক্ত ডিম (ভ্রূণ) নারীর গর্ভে স্থাপন করা হয়।
একবার ভ্রূণ ওই নারীর গর্ভে স্থানান্তর হয়ে গেলে, দুই সপ্তাহ পর্যবেক্ষণ করা হয় যে, এই পদ্ধতি কাজ করেছে কী-না।
তারপর নিয়মিত গর্ভাবস্থা পরীক্ষা করা হয়।
(আইভিএফ পদ্ধতি কতোটা সফলভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করে নারীর বয়সের উপর)
আইভিএফ পদ্ধতি কতটা সফলভাবে কাজ করবে তা নির্ভর করে নারীর বয়স ও তার বন্ধ্যাত্বের কারণের উপর।
অল্পবয়সী নারীদের সফল গর্ভধারণের সম্ভাবনা বেশি। আইভিএফ পদ্ধতি সাধারণত ৪৩ বছরের বেশি বয়সী নারীদের জন্য সুপারিশ করা হয় না।
কারণ ওই বয়সের পরে সফল গর্ভাবস্থার সম্ভাবনা খুব কম থাকে বলে মনে করা হয়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর হেলথ অ্যান্ড কেয়ার এক্সিলেন্সের (এনআইসিই) ফার্টিলিটি নির্দেশিকা অনুযায়ী ৪৩ বছরের কম বয়সী নারীদের আইভিএফ দেয়া উচিত।
বিশেষ করে যারা দুই বছর ধরে নিয়মিত অরক্ষিত যৌন মিলনের মাধ্যমে গর্ভ ধারণের চেষ্টা করছেন।
অথবা যারা কৃত্রিমভাবে গর্ভধারণের জন্য ইন্ট্রাইউটেরাইন ইনসেমিনাইজেশন বা আইইউআই পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন।
যেখানে কিনা বিশেষভাবে প্রস্তুত শুক্রাণু সরাসরি জরায়ুতে স্থাপন করা হয়।
কেউ যদি একাধিকবার এই পদ্ধতি প্রয়োগ করেও সন্তান ধারণ করতে না পারেন তারা আইভিএফ পদ্ধতি বেছে নিতে পারেন।
২০১৯ সালে ব্রিটেনে আইভিএফ পদ্ধতি সফল হওয়া অর্থাৎ জীবিত সন্তান প্রসবের শতকরা হার হল:
মূলত যেসব নারী তাদের নিজস্ব ডিম এবং তাদের সঙ্গীর শুক্রাণু ব্যবহার করেছে, তাদের প্রতিটি ভ্রূণ স্থানান্তরের হার পরিমাপ করে এই পরিসংখ্যান করা হয়েছে।
সেইসাথে স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখা এবং চিকিৎসা চলাকালীন মদ, ধূমপান এবং ক্যাফেইন এড়িয়ে চলা আইভিএফ-এর মাধ্যমে সন্তান প্রসবের সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিতে পারে।
(আইভিএফ পদ্ধতিতে যমজ বা তিনটি শিশু প্রসব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে)
আইভিএফ সবসময় কাজ নাও করতে পারে। অর্থাৎ গর্ভাবস্থায় ভ্রূণ পরিণত নাও হতে পারে।
এক্ষেত্রে মায়ের শারীরিক সুস্থতা যেমন জরুরি, তেমনি মানসিকভাবে সজীব থাকা সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
এ কারণে যাদের আইভিএফ দেওয়া হয়, তাদের এই প্রক্রিয়া চলাকালীন কাউন্সেলিং করা হয়ে থাকে।
আইভিএফ পদ্ধতি চলার সময় যেসব ওষুধ দেওয়া হয়, সেগুলোর কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে, যেমন – হটফ্লাশ হতে পারে অর্থাৎ নারীর শরীরে গরম হলকা বয়ে যেতে পারে। সেইসাথে মাথাব্যথা হতে পারে।
আবার এই পদ্ধতিতে যারা সন্তান নেন তাদের অনেক সময় একাধিক বাচ্চা অর্থাৎ যমজ বা তিনটি শিশু প্রসব হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। যা মা ও সন্তান উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক হতে পারে।
একটি অ্যাক্টোপিক গর্ভাবস্থার সৃষ্টি হতে পারে, যেখানে ভ্রূণ গর্ভের পরিবর্তে ফেলোপিয়ান টিউব অর্থাৎ গর্ভনালীতে রোপণ হয়ে যেতে পারে।
এছাড়া ওভারিয়ান হাইপারস্টিমুলেশন সিন্ড্রোম (ওএইচএসএস) দেখা দিতে পারে, যেখানে আইভিএফ চলার সময় ব্যবহৃত ওষুধের প্রতি ডিম্বাশয় অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখায়।
বিবিসি নিউজ বাংলা
Leave a Reply