সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:৪৬ পূর্বাহ্ন

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-২)

  • Update Time : শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪, ২.৩৭ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

বীজ বপনের প্রণালীও মোটামুটি ভাবে নির্দিষ্ট ছিল। জমি বেশ গভীর ভাবে চাষ করার পর জমিতে প্রায় দেড় ফুট অন্তর আড়াআড়িভাবে রেখা টানা হত এবং ঐ রেখায় প্রতি ফুটে ২/৩ টি করে বীজ বপন করা হত। বপনের আগে বীজগুলি পানিতে ভিজিয়ে আর্দ্র করে নেওয়া হত। কোন কোন এলাকায় প্রথমে কার্পাস বীজের চারা উৎপাদন করে আগের নিয়মে জমিতে চারা লাগানো হত।

চারাগুলি একটু বড় হলেই জমি ভাল করে আগাছামুক্ত করা হত এবং চারার গোড়ার মাটি নরম করে দেওয়া হত। সময় সময় কার্পাস গাছ অনাবৃষ্টি, পোকা, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদির ফলে নষ্ট হয়ে যেত। বসন্ত কাল আসতেই কার্পাস সংগ্রহ করা হত। কোন কোন সময় একই জমিতে ২/৩ বছর কার্পাস উৎপাদনের পর এক বছরের মত সময় জমি ফেলে রাখা হত, কিন্তু সাধারণতঃ একই জমিতে একের পর এক  বিভিন্ন রকমের ফসল বোনা হত, যেমন, তিল, সরিষা, ধান ইত্যাদি, যাতে জমির উৎপাদন শক্তি হ্রাস না পায়।

এক বিঘা জমি বপন করার জন্য প্রায় ২ কিলোগ্রাম বীজ লাগত এবং সাধারণ ভাবে এক বিঘা জমিতে দুই মণ কার্পাস জন্মাত। প্রতি কিলোগ্রাম কার্পাসের চার ভাগের তিন ভাগেরও বেশী পরিমাণ থাকত বীজ, বাকী এক ভাগেরও কম পরিমাণ থাকত তুলা। তুলার অংশেও মাত্র একতৃতীয়াংশ পরিমাণ, যা বীজের নিকটতম থাকত, খুব ভালো মসলিন তৈরীর উপযুক্ত ছিল। বাকী তুলার মধ্যে একতৃতীয়াংশের দ্বারা মাঝারি রকমের কাপড় তৈরী করা সম্ভব ছিল।

আগেই বলা হয়েছে, শরৎকালের ফসলের সুতা, বসন্তকালের তুলা অপেক্ষা খারাপ ছিল; এর দ্বারা ভালো মানের কাপড় প্রস্তুত করা সম্ভব ছিলনা। শরৎকালের তুলা দামেও সস্তা ছিল। ঢাকার বস্ত্র শিল্প যেভাবে উন্নতি লাভ করেছিল, তাতে ঢাকার উৎপাদিত তুলা দ্বারা ঢাকার বস্ত্র শিল্পের চাহিদা মিটত না। তাছাড়া ঢাকার ফুটী কার্পাস শুধু সরু মসলিনের জন্যই নির্ধারিত ছিল। তাই বৃদ্ধিশীল বস্ত্র শিল্পের জন্য পাক-ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকেও কার্পাস আমদানী করা হত।

এই সব তুলা প্রধানতঃ গুজরাট থেকেই আমদানী করা হত। এবং একে সিরঞ্জ বলা হত। এইসব তুলার সাহায্যে মাঝারি রকমের সস্তা কাপড় তৈরী হত। আসাম, ত্রিপুরা, চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকা এবং আরাকান থেকেও তুলা আমদানী করা হত। এই সব তুলা সাধারণতঃ ভোগা কার্পাস জাতীয় ছিল এবং এর দ্বারা শুধু মোটা কাপড় তৈরী হত। আসাম, গারো পাহাড় ইত্যাদি এলাকা থেকে আমদানীকৃত মুগা সিল্কও ঢাকার তাঁতে ব্যবহৃত হত এবং মুগা সিল্ক মিশ্রিত সুতী কাপড় রপ্তানী করে ঢাকার তাঁতিরা বেশ কিছু উপার্জন করে নিত।

সুতা কাটা (Spinning)

কার্পাস উৎপাদনের পরের স্তর সুতা কাটা। বীজসহ কার্পাসকে প্রথমে পরিষ্কার করে পরে তুলা বের করে নেওয়া হত। কার্পাস পরিষ্কার করায়ও দক্ষতার দরকার ছিল এবং এর জন্য বোয়াল মাছের চোয়ালির দাঁত ব্যবহার করার নিয়ম ছিল। বোয়াল মাছের দাঁত ছোট এবং ঘন সন্নিবেশিত বলে একে অতি সরু  চিরুণী রূপে ব্যবহার করা সম্ভব। কার্পাসের উপর বোয়াল মাছের চোয়ালের দাঁত খুব আস্তে আস্তে চালিয়ে এমন ভাবে পরিষ্কার করা হত যাতে তুলা নষ্ট না হয়, আবার সঙ্গে সঙ্গে তুলার সঙ্গে মিশ্রিত পাতা, ডাঁটা এবং মাটি ইত্যাদি নানা আবর্জনা বের করে ফেলাও সম্ভব।

এ কাজ এমন ধৈর্য সহকারে করার প্রয়োজন ছিল যে, জেমস টেলর প্রমুখ ইংরেজ লেখকেরা এতে  আশ্চর্যান্বিত হয়ে এর জন্য ঢাকার তাঁতিদের অনেক প্রশংসা করেছেন।  কার্পাস পরিস্কার হওয়ার পর বীজ থেকে তুলাগুলি বের করে নেওয়ার পালা। এই কাজও বেশ দক্ষতার সাথে করার প্রয়োজন ছিল। চিরুণীকরা কার্পাস একটা কাঠের তক্তার উপর রেখে তার উপর আস্তে আস্তে একটি সরু লোহার কাঠি এমন ভাবে এদিক ওদিক চালান হত যাতে তুলা বের হয়ে যায় অথচ বীজ নষ্ট হয় না। তারপর তুলা ধুননীরা যে ভাবে তুলা ধুনে, ঠিক সেভাবেই তুলাগুলি ধুনা হত।

একটা বাঁশের ঢালকে বেত, কলা গাছের আঁশ বা মসৃণ রশির সাহায্যে ধনুকের মত বাঁকিয়ে নেওয়া হত। রশি বা বেতকে আঙ্গুলের খোঁচা দিয়ে বা কাঠ দিয়ে নাড়া হত। এবং রশির নাড়াচাড়ার বা উঠা-নামার সঙ্গে সঙ্গে তুলার উপর জোরে বাতাস লাগিয়ে তুলা ধুনার কাজ করা হত। তুলা ধুনা শেষ হলে তাকে একটি মোটা কাঠের কঞ্চির চারদিকে জড়িয়ে নেওয়া হত। পরে কঞ্চিটাকে আস্তে আস্তে সরিয়ে নিয়ে তুলাগুলি কাঠের তক্তার মাঝখানে রেখে দুইদিক থেকে চেপে রাখা হত এবং সকলের শেষে তুলাগুলি কুচিয়া মাছের মসৃণ চামড়ার ভিতরে রেখে দেওয়া হত। এই ভাবে তুলাকে ধুলাবালির হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা হত।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-১)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-১)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (২য় কিস্তি)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (২য় কিস্তি)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024