স্কেটস, বগলে ছেলেটা-৮
জানত না ছেলেটা, জখম যোদ্ধাকে সে বাঁচা দেখতে পাবে কিনা। তাই দরজা খোলার সময় ও টের পেলে হাত তার ঢিল হয়ে আসছে, অল্প অল্প কাঁপছে হাঁটু। এতক্ষণ পর্যন্ত তার তাড়া ছিল, আর হঠাৎ এখন পা তার আর চলতে চাইছে না। বাতিউকভ যদি না বেচে থাকে?..
কিন্তু দেরি করা চলে না। পেছনে রয়েছে ব্যাগ-হাতে ডাক্তার আর খালি স্ট্রেচার নিয়ে দু’জন লোক। নিচে দেউড়ির কাছে অ্যাম্বুলেন্স গাড়ি। ভেতরে ঢুকল ছেলেটা। তার পেছ-পেছ, তিনজন পুরুষ। শক্ত-সমর্থ লোক তারা, ওভারকোটের ওপর শাদা স্মক। সঙ্গে সঙ্গেই ফ্ল্যাটটা যেন সঙ্কীর্ণ হয়ে উঠল।
সোফায় লোকটা আগের মতোই ফ্যাকাশে, চোখ বন্ধ। বেঁচে আছে, নাকি নেই? উদ্বেগে ছেলেটার হাত মুঠো বাঁধে পকেটের ভেতর। বাতিউকভের হাত টেনে নেয় ডাক্তার। নাড়ি গোনে সে, ঘড়ি দেখে। গুনছে যখন, তখন নাড়ি আছে। বেচে আছে তাহলে বাতিউকভ। যদিও মোটেই জীবন্তের মতো দেখাচ্ছে না। রোগীর আস্তিন ডাক্তার কাঁধ পর্যন্ত গুটিয়ে তুলে অ্যাম্পিউল তুলে নেয়। দেখতে সেটা ছোট্ট এক টুকরো পড়ন্ত জল-জমা বরফের মতো। নিপুণ টোকা দিয়ে ডাক্তার তার কাঁচের ডগাটা ভেঙে ফেলে। তারপর সিরিঞ্জের ইস্পাৎ-হল ঢোকায় সেখানে। অজ্ঞান লোকটার হাত নিয়ে ডাক্তার ঠাহর করে কোথায় সুই ফোটাবে। জুতোর ডগায় বড়ো বড়ো আঙুলগুলোর ওপর ভর দেয় ছেলেটা।
মনে পড়ে তার, ইশকুলে তাকে টিকে দিয়েছে। সিরিঞ্জ দিয়ে সংই ফুটিয়েছে। ব্যথা করে বটে, তবে অসহ্য নয়। আসলে, তেমন কিছু না। কিন্তু ছেলেটার মনে হয় বাতিউকভের বোধ হয় শত গুণ ব্যথা করবে। ইনজেকশন ছাড়াই তো তার কষ্ট হচ্ছে! পাঁজরে কনুই চেপে ছেলেটা চোখ কোঁচকায়। সাই ঢুকে গেল হাতে।
স্ট্রেচারটা কোণে রেখে অন্য দুটো লোক বসল চেয়ারে। প্রকান্ড, দশাসই লোক তারা। চোখের দৃষ্টি নির্বিকার। ডাক্তার কী করছে সেদিকে ওদের নজর নেই। নিজের মনেই তারা আছে। সবই ওদের জানা। আর্ত ও পীড়িতদের ক্রমাগত দেখে দেখে বুক ওদের চট-পড়া। ওরা আছে ওদের নিজেদের ভাবনা নিয়ে।
‘সি’ড়িটা সরু,’ বলে একজন, ‘সৌচার গলবে বলে মনে হয় না।’ ‘খাবে, যাবে,’ বলে অন্য জন, ‘খানিকটা উচু করে তুললেই হবে।’
‘কিন্তু রোগী তো ভারি।’
পেছনে ওদের শান্ত কথাবার্তা কানে আসে ছেলেটার, ইচ্ছে হয় দু’কথা শুনিয়ে দেয়। কিন্তু মুখ ফেরায় না সে। তাকিয়ে থাঁকে বাখ্ তিউকভের দিকে। চোখ মেলে বাঞ্ছতিউকভ।
ছেলেটাকে দেখে সে। তার জ্ঞান হারাবার মূহূর্তে যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা, সেইভাবেই দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। কোথাও যায় নি নাকি ছেলেটা? অতন্দ্র প্রহরীর মতো ঠায় ওইভাবেই সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে তার শিয়রে? বাখতি- উকভের ইচ্ছে হয় এই ঢ্যাঙা বেঢপ ছেলেটার দিকে চেয়ে হাসে। কিন্তু হাসির বদলে দেখা দেয় একটা পীড়িত মুখবিকৃতি: ভয়ানক যন্ত্রণা করে ওঠে। ডাক্তার আর স্ট্রেচার বইবার লোকদের দেখতে পায় সে। এবার সবই বোঝে।
‘কী করবেন?’ জিজ্ঞেস করে ডাক্তারকে।
সিরিঞ্জ গুটিয়ে নিয়ে ডাক্তার জবাব দেয়:
‘হাসপাতালে যাবেন।’
চুপ করে থাকে বাতিউকভ, তারপর বাধ্যের মতো মাথা নাড়ে। দৃষ্টিতে ওর দুর্ভাবনা ফুটে ওঠে। সঙ্কুচিতের মতো হেসে সে ছেলেটাকে বলে:
‘খোকা রে, একটু কাজ করে দিবি, সাপোজকে আমার বৌ ছেলেকে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দে।’
‘ঠিক আছে, পাঠিয়ে দেন,’ চট করেই রাজী হয়ে যায় ছেলেটা। আর কেন জানি অভিমান হয় তার। লোকটা এখনো ভাবছে তার সেগেই বাখ ভিউকেন জানি আর সেগেই ওদিকে নিশ্চয় ছেলেপিলেদের সঙ্গে স্কী করে বেড়াচ্ছে…
‘একটু কাগজ পেনসিল এনে দে-না।’
পাশের ঘরে যায় ছেলেটা। ক্যালেন্ডারের পাতাটা এখনো বাখ্তিউকভকে ডাকছে চারটের সময় পার্টি কমিটিতে যেতে… টেবিলে রয়েছে ৬ষ্ঠ ‘ক’-এর সের্গেই বাখুর্তিউকভের দুটি খাতা। প্রথম খাতাটা নিয়ে হেলাফেলায় সেটা খোলে সে। রচনার খাতা। ঝরঝরে বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা শিরোনামা: ‘আমার গ্রীষ্মযাপন’। কোথাও কালির ছোপ পড়ে নি, কাটাকুটি নেই। ‘শুচিবাই তো খুব!’ তাচ্ছিল্য করে ভাবে ছেলেটা, প্রথম ছত্রগুলো পড়ে: ‘গ্রীষ্ম আমি কাটাই সাপোজক শহরে দিদিমার কাছে। শহরটা ছোটো। অনেক গাছপালা আছে…’
খাতাটা থেকে পাতা ছোঁড়ে ছেলেটা। ছোড়ে সমান করে নয়, এবড়োখেবড়ো করে –
ছেলেটা বুঝুক যে পাতাটা ছি’ড়ে নেওয়া।
লিখতে কষ্ট হচ্ছিল বাখতিউকভের। আঁকাবাঁকা হয়ে যায় অক্ষরগুলো, যেন তারাও অসুস্থ, দাঁড়াতে পারছে না। সাপোজকের জন্যে টেলিগ্রামটা লেখে সে, আর নিজের নোটবুকে ডায়েরি লেখে ডাক্তার। লেখা শেষ হতেই অন্য লোকদুটো যেন হুকুম পেয়েই উঠে দাঁড়ায়। স্ট্রেচারটা তারা ঠিকঠাক করতে থাকে। বাতিউকভের দিকে চেয়ে থাকে ছেলেটা। হঠাৎ তার মনে হয় এ টেলিগ্রামটা সের্গেইকে না লিখে বাতিউকভ যদি তাকে লিখত, তাহলে কী সুখীই নাসে হত। মন ভার করে তাকিয়ে থাকে সে। বোঝে, এইবার তাদের ছাড়াছাড়ি হবে চিরকালের মতো। অনেকখন ধরে লেখে বাউিকভ। ছেলেটার ইচ্ছে হয় যেন আরো সে লিখে যায়। কখনোই যেন শেষ না হয় তার টেলিগ্রাম লেখা।
‘এই নে,’ বলে বাতিউকভ কাগজটা আর টাকা এগিয়ে দেয় ছেলেটাকে, ‘কাজটা করে দিস রে খোকা। অনেক তোকে ধন্যবাদ।’
স্ট্রেচারে শোয়ানো হয় রোগীকে। সরে দাঁড়ায় ছেলেটা। ওর ক্ষমতা থাকলে ও নিজেই শুইয়ে দিত। শোয়াত অনেক ভালোভাবে। আর এ লোকগুলো বাখ্ তিউকভকে এমন ঝাঁকাচ্ছে…
নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে সে। তার মনে হয় এ সবকিছুই সত্যি নয়। এ সবই সিনেমা, সে শুধু দেখছে। সে আছে পর্দার ওপাশটায়। বগলে তার ‘বৃটিশ স্পোর্টস’ স্কেটস, আর এখানে, এই ঘরের মধ্যে, স্ট্রেচার, শাদা স্মক, ওষুধের গন্ধ, আর প্রকাণ্ড, ভালো, আপনার জন, বিপন্ন একটি মানুষ।
স্ট্রেচারের ডান্ডা ধরে লোকদুটো।
‘ধরেছিস?’ বলে সামনের লোকটা।
‘ধরেছি, ওঠা!’ বলে পেছনকারটা।
মেঝে থেকে উঠে যায় স্ট্রেচার।
ঘর দিয়ে, অন্ধকার করিডর দিয়ে ভেসে চলছে স্ট্রেচার। পেরিয়ে যায় হলুদ রোদ-রঙে ঢালা কামরাটা। তালার ফুটোতে এসে পড়েছে এক ঝলক রোদ। ঋজ জলজলে। ছোটো ছোটো জীবন্ত পোকার মতো তাতে ঘুরপাক খাচ্ছে ধূলিকণা। স্ট্রেচারটা যাওয়ার সময় রোদটা পড়ল জখম যোদ্ধার গালে। বিদায় জানাল তা গৃহস্বামীকে।
রাস্তায় বাতিউকভকে বললে ছেলেটা:
‘আসি।’
‘তুই এখনো এখানে?’ বললে জখম যোদ্ধা, তার গভীর বড়ো-বড়ো চোখের সঙ্গে চাওয়া-চাওয়ি হয় ছেলেটার সবুজ বিষন্ন চোখজোড়ার। গোঙিয়ে উঠল সাইরেন। গাড়িটা পিছলে কে’পে উঠে রওনা দিলে। আর হাতে টেলিগ্রামের খসড়া নিয়ে ছেলেটা চেয়ে রইল সেদিকে।
Leave a Reply