মঙ্গলবার, ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৩৩ অপরাহ্ন

ফুটবল ও ক্রিকেটে ’নেক্সট কালচার’ আর পাপন-সালাউদ্দিন দ্বৈরথ!

  • Update Time : শনিবার, ১৩ জুলাই, ২০২৪, ১১.১৩ পিএম

মজিবুর রহমান

দেশের ফুটবল ও ক্রিকেটে নতুন আলোচিত বিষয় বর্তমানে ’নেক্সট কালচার’। যার প্রতিষ্ঠাতা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী মো: সালাউদ্দিন। পরবর্তিতে এ বিষয়টাকে প্রতিষ্ঠিত বা খবরের শিরোনামে পরিনত করেন বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। সালাউদ্দিন ফুটবল মাঠের মহানায়ক। সাবেক কিংবদন্তী ফুটবলার তিনি। জনপ্রিয়তায় তার ধারে-কাছে কেউ নেই। আর পাপন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তথা রাজনীতির মাঠের মোটামুটি আলোচিত ব্যাক্তি। বর্তমানে তিনি যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী। তবে ফুটবল বা ক্রিকেট বিশ্বকাপ সামনে এলেই সরস আলোচনার খোরাক হয়ে উঠেন দেশের দুই জনপ্রিয় খেলার বস সালাউদ্দিন ও পাপন। ব্যাতিক্রম ঘটেনি সদ্য সমাপ্ত টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপের আগে ও পরে। বাংলাদেশ জাতীয় দল দেশ ত্যাগের পাপনের প্রত্যাশা থাকে উর্ধ্বমূখি পারদের মতো। আর রেজাল্ট আশানুরুপ না হলেই আমূল বদলে যান তিনি। বেশী দুরে যাবার দরকার নেই। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপ শুরুর আগেও চিরাচরিত বড় পত্যাশার কথা বলেছিলেন পাপন। আর বিশ^কাপের মাঝপথে বাংলাদেশ দলের টানা পরাজয়ে বেমালুম ভুলে যান সেই কথা। বদলে যায় তার তথাকথিত অমর বানীতুল্য দল নিয়ে আগাম প্রত্যাশার কথা।

বিশ্বকাপ শুরুর আগে তিনি পেঁছে যান ফাইনালে। আর শেষ হওয়ার পর বলেন আমার লক্ষ্য নেক্সট ওয়াল্ড কাপ’। ফাঁক ফোঁকর রেখে প্রতিবার, প্রতি বিশ্বকাপে বলে যাচ্ছেন তিনি নেক্সট, নেক্সট নেক্সট…। আসলে এই নেক্সট কোন নেক্সট তিনি নিজেও জানেন কিনা সন্দেহ। গ্রাম-গঞ্জে একটা প্রবাদ আছে চাচায় কইছে দিবো। অথচ চাচায় বলে নাই কি দিবো। আর দিবোর পেছনেই মানুষ দৌড়ায়। পাপনের ডায়লগটাও প্রায় একই। ফলে এই নেক্সট-এর পেছনেই দৌড়ায় ক্রিকেটপ্রেমী ও মিডিয়া। অনেক পরে হয় বোধোদয়। এখন অনেকেই বুঝতে শুরু করেছেন বিসিবি সভাপতি তো বলেননি কোন নেক্সট ওয়াল্ডকাপ? উল্লেখ করেননি কোনো সাল বা তারিখ। ফলে এ নিয়েই প্রতিবারের মতো এবারও চলছে আলোচনা-সমালোচনা, মুখরোচক নানা ট্রল, যা হাস্যরসের খোরাক যুগিয়ে যাচ্ছে গোটা দেশে ।
এদিক থেকে সালাউদ্দিন অবশ্য কিছুটা ব্যাতিক্রম। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ^কাপ শুরুর আগে তিনি বলেছিলেন, বাংলাদেশের লক্ষ্য ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ। সাল, আসর উল্লেখ করে সালাউদ্দিন লক্ষ্য দিতেন মিডিয়ার মাধ্যমে। পরবর্তিতে লক্ষ্য পুরন না হলে তিনিও পাপনের মতো সরাসরি অস্বীকার করেন এমন মন্তব্য তিনি কখনই করেননি। অথচ তার কথার রেকর্ড আছে, ভিডিও ফুটেজ থেকেও প্রমান পাওয়া যায়। সালাউদিন যদিও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার কথা কোনো সময় বলতেন না। বাছাই শুরুর আগে সংবাদ সন্মেলন বা সাক্ষাতকারে তিনি বলতেন অমুক আসরে বিশ্বকাপ ফুটবলের মুলপর্বে খেলবে বাংলাদেশ। অন্যদিকে পাপনের মন্তব্যটা থাকে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন হওয়া প্রসঙ্গে।

সন্দেহ নেই দেশের ক্রিকেট বিশ্বের একটা বড় মঞ্চে স্থান করে নিয়েছে। বাংলাদেশ জাতীয় দল ক্রিকেট বিশ্বকাপের প্রায় সব আসরেই মুলপর্বে অংশ নিয়ে থাকে। ফলে ক্রিকেট নিয়ে মাতামাতি দেশে একটু বেশী। দর্শকের প্রত্যাশা থাকে আকাশছুয়া। আর দল এই প্রত্যাশা পুরন করতে না পারলে শুরু হয় সমালোচনার ঝড়। আর এই ঝড় টর্নেডোতে রুপ নেয় পাপনের বেরসিক ’নেক্সট ওয়াল্ডকাপ’ বয়ানে। যুক্তরাস্ট্র ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের যৌথ আয়োজনে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পর পাপনের মুখে শোনা গেছে ’নেক্সট’ শব্দটা। বাংলাদেশ দল দেশে ফেরার পর মিডিয়ার মুখোমুখি হয়ে তাকে বলতে শোনা গেছে, আমি কখনই বিলিনি এবারের আসরে আমরা চ্যাম্পিয়ন হবো। আমি সরসময় বলে আসছি আমার লক্ষ্য ’নেক্সট ওয়াল্ড কাপ’। প্রসঙ্গত, কোন নেক্সট তা কিন্তু পরিস্কার করেননি পাপন।

ইদানিং সালাউদ্দিন অবশ্য এ ধরনের বেফাঁস কথাবার্তা থেকে অনেকাংশেই সরে এসেছেন। ২০২৬ সালে যুক্তরাস্ট্র, কানাডা ও মেক্সিকোয় অনুষ্ঠিত হবে ফুটবল বিশ্বকাপে। তিন দেশের আয়োজনে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্বকাপে বাংলাদেশের লক্ষ্য নিয়ে তিনি কিছু বলেননি। আর বলার সুযোগও অবশ্য নেই। বাছাই পর্বের মাঝপথেই নিশ্চিত হয়ে গেছে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের ভাগ্য, এবারো দর্শক সারিতেই থাকছে তারা। বিশ্বফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা এবারের আসরে দল বাড়ালেরও ভাগ্য বড় করতে পারেনি বাংলাদেশ দল। সেটা অবশ্য তেমন কোনো বিষয় নয়। ফুটবল আসলে অনেকটা কাঠখড় পোড়ানো খেলা। টাকা থাকলেই সব নিখুঁত হয়ে যাবে এমনটা মনে করা ঠিক না। বিশে^র বহু ধনী দেশ অঢেল অর্থ খরচ করেও বিশ^কাপ ফুটবলের মুলপর্বে জায়গা করে নিতে পারে না। যেমন এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন ও ভারত। সোিদক থেকে চিন্তা করলে না অর্থ, না স্পন্সর-বাংলাদেশের ফুটবলে কিছুই নেই। এখানে অবশ্য ব্যাতিক্রম ক্রিকেট। কাঙ্খিত সাফল্য বাদে ক্রিকেটে সবই আছে। স্পন্সর, অর্থ ছাড়াও দেশে রয়েছে ক্রিকেটের মানসম্পন্ন নিজস্ব স্টেডিয়াম মিরপুর শেরেবাংলা। অন্যদিকে অনেক খেলার সঙ্গে শরিক হয়ে গরীবের বউ হিসেবে বেচে থাকা ফুটবলের একমাত্র ভেন্যু বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামই হাঁপিশ হয়ে গেছে সংস্কারের নামে। মুল বাজেটের তিনগুন অর্থ খরচ করেও খেলার উপযোগি করা সম্ভব হয়নি স্টেডিয়াম। প্রায় পঁচ বছর ধরে চলছে রহস্যজনক ঘষামাজা। ফলে মাঠের অভাবে দীর্ঘ এই সময়ে মুখ থুবড়ে পড়েছে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল। মানসম্পন্ন মাঠ না থাকায় সম্ভব হচ্ছে না দেশে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক ফুটবল প্রতিযোগিতা আয়োজন। বিষয়টা ওপেন সিক্রেট, অনেক সমালোচনা হচ্ছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। অবস্থাদৃস্টে মনে হচ্ছে দেখার কেউ নেই। সঙ্গত কারনে বলা যায় সালাউদ্দিন তো মাঠ নিয়েই মহাফাঁপড়ে। বিশ^কাপের টার্গেটি ছুড়ার সময় কোথায়?

তবে এ কথা অনস্বিকাার্য যে, ভালো-মন্দের মিশেলে মাঠের খেলায় ফুটবল-ক্রিকেটটের অবস্থান যাই থাকুক। দুই সভাপতির মারপ্যাচের কথাবার্তায় বাংলাদেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা বর্তমানে বেশ প্রানবন্ত। ক্রিকেটে অবশ্য পাপনের যোগ্য অনুসারি রয়েছে। তিনি আজকাল বেশ রসালো কথাবার্তা বলেন। ব্যাক্তিটি হলেন অধিনায়ক নামজুল হোসেন শান্ত। বড় উদাহারন টি-টুয়োন্টি বিশ^কাপ শুরুর আগে স্বাগতিক যুক্তরাস্ট্রের বিরুদ্ধে সিরিজ হারের পর শান্তকে বলতে শোনা যায় প্রতিপক্ষ দলটি অনেকে দেশের খেলোয়াড় নিয়ে গড়া। অনেক দেশের মানুষ ওদের জন্য দোয়া করেছে। আমরা কেবল নিজ দেশের মানুষের দোয়া পেয়েছি। পাঠক নিজেই বিচার করুন, এটা কোনো সিরিজ হারের ব্যাখা হতে পারে? তাও খোদ অধিনায়কের মুখে। সঙ্গত কারনে অনেকেই এখন বলছেন বেফাঁস কথার যোগ্য উত্তরসূরি পেয়ে গেছেন বিসিবি সভাপতি পাপন।

বিশ্বকাপ খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে ধনী বোর্ড হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ উঁচুতে, অস্ট্রেলিয়ারও উপরে। জানা গেছে ৯শ’ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত রয়েছে বিসিবির। বিপুল এই অর্থ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত ক্রিকেট শক্তি, এমনকি বিশ^কাপ জয়ী অনেক দেশের নেই। টাকার গরমে কিনা কে জানে, মিডিয়া কাভারেজ নেওয়ার ক্ষেত্রে পাপন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। বিশ্বের কোনো বোর্ড সভাপতিকে টিভির পর্দায় এতা কথা বলতে শোনা যায় না। নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড এমনকি পাশের দেশ ভারত-শ্রীলঙ্কার বোর্ড সভাপতির নাম অনেকে জানেন না । অথচ ব্যাতিক্রম একমাত্র পাপন। বিগত এক যুগে ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ অনেকে দেশের বোর্ড সভাপতি পরিবর্তন হয়েছে বশে কয়েকজন। সালাউদ্দিনের মতো তিনিও কায়েম করে নিয়েছেন অমরত্ব। কায়দা কৌশলটাও প্রায় একই। নির্বচনের আগে এমনভাবে কাউন্সিলর বা ভোটার তৈরি করা হয় যাতে হারার ভয়ে কেউ দাড়ানোর সাহস না পান। যদিও ফুটবল ও ক্রিকেটর সভাপতি পদের নির্বাচন একটু ভিন্ন। ফুটবলে সরাসরি কাউন্সিলররা ভোট দিয়ে অন্য পদের সঙ্গে সভাপতি নির্বাচন করে থাকেন। আর ক্রিকেটে কাউন্সিলররা ভোট দিয়ে নির্বাচন করেন পরিচালক। আর পরিচালকরা ঠিক করেন সভাপতি। এক্ষেত্রে সালাউদ্দিনের ম্যাকানিজমটা প্রভাব খাটিয়ে আসন ধরে রাখার ক্ষেত্রে পাপনের ওস্তাদ তুল্য। চার মেয়াদে ১৬ বছরের রাজত্ব চলছে সালাউদিনের। চলতি বছরের অক্টোবরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনেও থাকছেন তিনি, সম্ভবত এবারও ফাঁকা মাঠে গোল দিতে যাচ্ছেন তিনি। এ ধরনের সন্মানজনক পদে সাধারনত দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতিরা আগ্রহি থাকেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে যেই দাড়ানোর পরিকল্পনা করে তার ব্যবসা-বানিজ্যের লালাবাতি বাজিয়ে দেন সালাউদ্দিন, অদৃশ্য শক্তির মন্ত্রবলে। জলন্তু প্রমান গত নির্বাচনে অনেক ঘটা করে মাঠে নেমে শেষ পর্যন্ত নাকে খত দিয়ে সরে দাড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন দেশের এক বিশিস্ট ব্যবসায়ী। প্রোথিতযশা ক্রীড়া সংগঠক হিসেবে পরিচিতি থাকলেও উড়ে যান তিনি সালাউদ্দিনের তুড়িতে। সঙ্গত কারনে বলতে হয় মাঠের চেয়ে টেবিলের খেলাতেই বেশী জমজমাট বর্তমানে ফুটবল ও ক্রিকেট। সঙ্গত কারনে প্রত্যাশিক উন্নতি নেই কোনটিতে। ওয়াকিবহাল মহলের মতে কাঙ্খিত সাফল্য না পাওয়ার জন্য খেলোয়াড়দের চেয়ে বেশী দায়ী সংগঠকরা। ক্ষমতার মোহ থেকে সংগঠকরা বেরিয়ে আসতে না পারলে কোনদিন খেলাধূলার উন্নতি হবে না স্বাধীন বাংলাদেশে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024