রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৬:০৫ পূর্বাহ্ন

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৩)

  • Update Time : রবিবার, ১৪ জুলাই, ২০২৪, ২.৩৪ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

সুতা তৈরীর পালা। সাধারণতঃ মেয়েলোকেরাই সুতা কাটত। সুতা কাটার জন্য চারটি জিনিসের দরকার ছিল-

১। একটি টাকু- এটি লম্বায় প্রায় এক হাত বা তারও কিছু কম বা বেশী এবং আকারে একটি বড় পেরেকের মত। টাকুর নীচের দিকে একটু শুকনা মাটি জড়িয়ে থাকত, যাতে টাকু ( সুতা কাটার যন্ত্র) ঘুরানোর সময় মাটির ভারে টাকুর সেই অংশটা সব সময় নীচের দিকে থাকে।

২। একটি বাঁশের ঝুড়ি, এতে তুলা রাখা হত।

৩। মাটি  জড়িয়ে এক টাকুর ( সুতা কাটার যন্ত্র) শঙ্খ সুতা কাটার সময় টাকুর নিম্নভাগ শঙ্খোর উপর রাখা হত, যাতে টাকুর নীচের অংশ মাটির ভিতর আটকে না পড়ে এবং অনায়াসে ঘুরতে থাকে।

৪। একটি ছোট পাথরের বাটি, এর মধ্যে কিছু খড়িমাটির গুঁড়া রাখা হত, মাঝে মাঝে সুতা কাটুনী (Spinner) খড়িমাটির ভিতরে আঙ্গুল গুঁজে দিত যাতে আঙ্গুল সব সময় শুকনা থাকে এবং টাকুতে পাক দিতে ও সুতা কাটতে অসুবিধা না হয়। এসব নিয়ে সুতা কাটুনী সুতা কাটতে বসত। এক হাতে ঝুড়ির ভিতরের তুলার আঁশ টাকুর উপরে রেখে অন্য হাতে টাকুতে পাক দিতে থাকে। এভাবে পাক হয়ে যাওয়ার পর তুলাগুলি সুতায় পরিণত হয়।তারপর সুতাগুলি একটি কঞ্চিতে জড়িয়ে রাখা হত।

যখন শুকনা বাতাস বইতে থাকে, অর্থাৎ বেশী গরমের সময় অতি সূক্ষ্ম সুতা কাটা সম্ভব নয় কারণ ঐ সময়ে সুতা দীর্ঘায়িত হয় না। সূক্ষ্ম সুতা কাটার জন্য কিছুটা আর্দ্রতা দরকার। ঢাকার সূক্ষ্ম মসলিনের সুতা কাটুনীরা সেই জন্য এমন সময় সুতা কাটত যখন তাপমাত্রা ৮২ ডিগ্রি ফার্ণহিটের বেশী থাকতনা। সূক্ষ্মতম সুতা কাটার জন্য উপযুক্ত সময় ছিল খুব ভোর থেকে আরম্ভ করে সূর্যতাপে সকাল বেলার শিশির শুকান পর্যন্ত। ঢাকার সুতা কাটুনীরা সাধারণতঃ অতি ভোরে আরম্ভ করে পূর্বাহ্ন প্রায় ৯।১০ টা পর্যন্ত এবং অপরাহ্ন ৩।৪ টা থেকে আরম্ভ করে সূর্যাস্তের একটু আগে পর্যন্ত সুতা কাটত। এরূপ তাপমাত্রার অভাব হলে কোন কোন সময় পানির উপরে ভাসমান নৌকায়ও সুতা কাটার কাজ চালান হত।

ঢাকার তাঁতিরা শুধু চোখে দেখেই সুতার সূক্ষ্মতা বিচার করত। পরিমাণ বা ওজন নিয়ে সুতার সূক্ষ্মতা বিচার করার কোন বৈজ্ঞানিক মাপকাঠি তাদের জানা ছিলনা। এই জন্য তারা প্রথম ওজন নিত এবং পরে মাটিতে দীর্ঘায়িত করে তার দৈর্ঘ্য ঠিক করা হত। যে সুতা দৈর্ঘ্যে বেশী অথচ ওজনে কম, সেগুলোই সূক্ষ্মতর বিবেচিত হত। হাত হিসাবে সুতার দৈর্ঘ্য মাপার নিয়ম ছিল এবং রতি হিসাবে ওজন করার নিয়ম ছিল।’ বলা বাহুল্য হাতের কোন আদর্শ মাপ ছিলনা, বরং তাঁতিদের সর্দারদের হাতই মাপের জন্য আদর্শ রূপে গণ্য ছিল। সাধারণতঃ সূক্ষ্মতম মসলিনে ব্যবহৃত সুতার প্রত্যেক নালের দৈর্ঘ্য ছিল ১৫০ হাত এবং ওজন ১ রতি।

তবে মধ্যে মধ্যে যে এর ব্যতিক্রম ছিলনা, তা নয়। যেমন, ১ রতি ওজনের সুতার নালের দৈর্ঘ্য ১৫০ হাত থেকে ১৬০ হাত পর্যন্ত উঠা-নামা করত। এইসব সুতার মধ্যে যেগুলি অপেক্ষাকৃত কম সূক্ষ্ম, সেগুলি টানায় এবং অপেক্ষাকৃত বেশী সূক্ষ্ম সূতা বানায় ব্যবহার করা হত। ঢাকার কাটুনীরা যে এর চেয়েও সূক্ষ্ম সুতা কাটতে পারত তার প্রমাণও আছে। সোনারগাঁও-এর সুতা কোন কোন সময় ১৭৫ হাত লম্বা ছিল; জেমস টেলর এক পাউন্ড ওজনের  একই সুতা দেখেছিলেন যার দৈর্ঘ্য ছিল ২৫০ মাইল। ৫ শেষে উল্লেখিত সুতা ১৮৫১ সালের বিদেশের প্রদর্শনীতে প্রদর্শন করা হয়েছিল।

সাধারণতঃ পরিবারের মেয়েরাই সুতা কাটায় নিয়োজিত হত। আধাবয়সী মেয়েরা সূক্ষ্মতম সুতা কাটায় বিশেষ পারদর্শী ছিল। কারণ সূক্ষ্মতম সুতা কাটার জন্য দুইটি গুণের বিশেষ প্রয়োজন ছিল- ১ম, প্রখর দৃষ্টিশক্তি ও ২য়, হাতের আঙ্গুলের প্রখর চেতনা শক্তি। এই কারণেই কম বা বেশী বয়সী মেয়েদের পক্ষে সূক্ষ্মতম সুতা কাটা সম্ভব ছিলনা। একজন মেয়ে সারা সকাল টাকুতে ( সুতা কাটার যন্ত্র) কাজ করে এক মাসে মসলিনের ব্যবহারোপযোগী মাত্র আধা তোলা সুতা কাটতে পারত। এতেই বুঝা যায়, মসলিনের সুতা কত সূক্ষ্ম ছিল এবং সুতা কাটার জন্য কতখানি পরিশ্রমের প্রয়োজন ছিল।

১৮০০ সালে জন টেলর বলেছেন যে, ঐ রকম দক্ষ কাটুনীর সংখ্যা খুব বেশী ছিলনা; ঢাকায় মাত্র তিনজন, সোনারগাঁও-এ ৬।৭ জন এবং জঙ্গলবাড়ী ও বাজিতপুরে প্রায় ২০ জন সূক্ষ্মতম মসলিনের সুতা কাটার উপযুক্ত দক্ষ সুতা কাটুনী ছিল। কিন্তু যেহেতু পরিবারের মেয়েরা পারিবারিক অন্যান্য কাজেও ব্যস্ত থাক্ত, সে কারণে সাধারণতঃ ঐ পরিমাণ সুতা কাটাও খুব কম মেয়েলোকের পক্ষে সম্ভব ছিল।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

 

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-২)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-২)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (৩য় কিস্তি)

ঢাকায় কত প্রকারের মসলিন ছিলো (৩য় কিস্তি)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024