শ্রী নিখিলনাথ রায়
সিরাজ-জননী ওয়াট্স সাহেবের পত্নী ও পুত্রকন্তাদিগকে নিজ মহলে ৩৭ দিবস পর্যান্ত সযত্নে রক্ষা করেন। তাহার পর লুৎফ উন্নেসার সহিত পরামর্শ করিয়া তাঁহাদিগকে জলপথে চন্দন নগরের ফরাসী শাসন- কর্তার নিকট পাঠাইয়া দেন। বলা বাহুল্য, সিরাজ তাহা জানিতে পারিলে তাঁহাদিগের লাঞ্ছনার একশেষ হইত। কিন্তু রমণী ও বালক বালিকার দুঃখ তাঁহাদের হৃদয়কে এরূপ অভিভূত করিয়া ফেলিয়াছিল যে, তাঁহারা সিরাজের ক্রোধের পাত্রী হইতেও কুণ্ঠিতা হন নাই। কেবল তাহাই নহে, লুৎফ উন্নেসা সিরাজের নিকট ওয়াট্ট্স সাহেবেরও মুক্তির জন্য ভিক্ষা চাহিয়াছিলেন।
তিনি সিরাজকে সানুনয়ে বলিয়াছিলেন,-“কুঠীয়াল সাহেব আপনারই প্রজা ও আপনারই সন্তান। আপনি সন্তানকে ব্যথা প্রদান করিতেছেন কেন? সামান্য একজন ইংরেজ প্রজাকে বন্দী করিয়া রাখা, বঙ্গরাজ্যের অধীশ্বরের কদাচ উচিত নহে।” ওয়াসের মুক্তির জন্য লুৎফ উন্নেসা নবাব সিরাজ উদ্দৌলার পদতলে নিপতিতা হইলেন। নবাব তাঁহাকে বুঝাইয়া বলিলেন যে, ওয়াট্ট্সকে বন্দী করিলে, কলিকাতার ইংরেজ বণিকেরা সংবতভাবে কার্য্য করিবে। কিন্তু সেই উদার-হৃদয়ার অশ্রুপাতের সহিত কাতর প্রার্থনোক্তি শুনিয়া সিরাজ অবশেষে ওয়াটসকে মুক্তি প্রদান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন।
এ সকল সিরাজের সৌভাগ্য-সময়ের কথা।। আমরা তাঁহার দুর্ভাগ্য সময়ে লুৎফ উন্নেসা কিরূপ দেব-হৃদয়ের পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন এক্ষণে তাহারই উল্লেখ করিতেছি। নবাব আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর সিরাজ বাঙ্গলা বিহার উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন। কিন্তু দৈবদুর্ব্বিপাকে তাঁহার রাজ্য- প্রাপ্তির পূর্ব্ব হইতেই তাঁহার বিরুদ্ধে একটি ভীষণ ষড়যন্ত্রের অভিনয় হইতেছিল।
আমরা পূর্ব্বে বলিয়াছি যে, সিরাজের বুদ্ধির তাদৃশ স্থিরতা ছিল না এবং যদিও তিনি মাতামহের অনুরোধে মদ্যপান পরি- ত্যাগ করিয়াছিলেন, তথাপি পূর্ব্বের অভ্যাস-দোষ ‘তাঁহার চঞ্চল চিত্তকে অধিকতর চঞ্চল করিতেছিল। তিনি সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, চারি দিকে হিংসা, বিদ্বেষ, ও ষড়যন্ত্রের বিভীষিকাময় চিত্র দেখিতে লাগিলেন। কাহারও উপর তিনি সহজে বিশ্বাস স্থাপন করিতে পারিতেন না, যাহাকে তিনি বিশ্বাস করিতেন, সেই তাঁহার সর্ব্বনাশ-সাধনে প্রবৃত্ত হইত। দুই এক জন ব্যতীত তাঁহার প্রধান প্রধান সেনাপতি ও কর্মচারী সকলেই তাঁহার সর্ব্বনাশসাধনে উদ্যত।
Leave a Reply