রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:৩৩ পূর্বাহ্ন

আম্বানি থেকে ঋণগ্রস্ত বাবা, ভারতীয়রা কেন বিয়েতে এত খরচ করে?

  • Update Time : মঙ্গলবার, ১৬ জুলাই, ২০২৪, ১২.২৯ এএম

নন্দিনী ভেলাইসামি

গত কয়েকদিন ধরে ভারত ও প্রতিবেশী দেশগুলোয় একটি বিয়ে ও তার চোখ ধাঁধানো আয়োজন নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।

এই বিয়ে ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যবসায়ী মুকেশ আম্বানির ছোট ছেলে আনান্ত আম্বানি এবং রাধিকা মার্চেন্টের মধ্যে হয়েছে।

বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলো এখন এই বিয়ে সংক্রান্ত ছোট-বড় নানা তথ্যে সয়লাব।

বিয়েতে আসা বিভিন্ন দেশের সেলেব্রিটি এবং তাদের ডিজাইনার পোশাক এবং স্টাইলিশ লুক নিয়েও আলোচনা হচ্ছে।

বলিউড তারকা, ভারতীয় ক্রিকেট দলের বড় তারকা, শীর্ষ শিল্পপতি, বহু দেশের বিশিষ্ট নেতা এবং পপ আইকন জাস্টিন বিবারের মতো সেলিব্রিটিরা বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন।

আম্বানি পরিবার।

কয়েক মাস ধরেই চলছে অনুষ্ঠান

আনান্ত আম্বানি এবং রাধিকা মার্চেন্ট গত ১২ই জুলাই বিয়ে করেছেন, তবে বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা গত কয়েক মাস ধরেই চলছে।

বিয়েতে কত খরচ হচ্ছে তা নিয়ে চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, এই অনুষ্ঠানে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।

আসলে, ভারতে বিয়ে হল ‘পারিবারিক উদযাপন’। বিয়েতে বিপুল অংকের ব্যয় করা ভারতের ঐতিহ্যের সাথে মিশে গিয়েছে। এটি প্রায় প্রতিটি পরিবারের সাধারণ গল্প।

ভারতীয় পরিবারগুলো তাদের বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে সমাজের কাছে তাদের সম্পদ, মর্যাদা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা দেখানোর চেষ্টা করে।

এমনকি লোক দেখানোর জন্য এমন অনুষ্ঠান করতে যে মোটা অঙ্কের টাকা প্রয়োজন, সেটা জোগাড় করতে অনেক সময় পরিবারগুলো ঋণ নিয়ে থাকে।

হিন্দু পারিবারিক বিয়েতে, সঙ্গীত এবং গায়ে হলুদের মতো বিবাহের আচারগুলো বেশ জাকজমকভাবে পালন করা হয়।

যেখানে মুসলিম পরিবারে বিয়ের মধ্যে ‘মেহেন্দি’, ‘নিকাহ’ এবং ‘ওয়ালিমা’-এর মতো আচার-অনুষ্ঠানগুলো হয়ে থাকে।

অন্যদিকে খ্রিস্টান বিয়ের মধ্যে বাগদান, বিয়ের অনুষ্ঠান এবং অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান অন্তর্ভুক্ত।

অর্থাৎ শুধু আম্বানির বাড়ির বিয়েই নয়, ভারতীয় সমাজে প্রতিটি বিয়েকেই গর্বের প্রতীক বলে মনে করা হয়।

প্রতিটি পরিবার তার সামর্থ্য অনুযায়ী বিয়ের অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেন, অনুষ্ঠানটিকে জমকালো এবং স্মরণীয় করে তোলার চেষ্টা করেন।

প্রতিটি পরিবার তাদের বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন এবং সামাজিক বৃত্তে নিজেদের অবস্থান জাহির করতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে।

ভারতীয়দের বিয়েতে এমন বিপুল অংকের টাকা খরচ ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বিলিয়ন ডলারের বিয়ের বাজার

ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকিং ও পুঁজিবাজার সংস্থা জেফরিজ, ভারতীয়দের বিয়েতে এমন বিপুল অংকের টাকা খরচের তথ্য দিয়েছে।

তাদের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বিয়ের অনুষ্ঠানের বাজার প্রায় ১০ দশমিক সাত লাখ কোটি টাকার।

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে যে, ভারতীয়রা সাধারণত শিক্ষার পেছনে যতোটা না ব্যয় করে তার চাইতে দ্বিগুণ ব্যয় করে বিয়েতে।

খাদ্য ও মুদি বাজারের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার।

তবে, শুধু ভারতীয়রাই যে বিয়েতে খরচ করেন তা নয়। অন্যান্য দেশেও একই প্রবণতা রয়েছে।

ভারতে বিয়ের বাজার আমেরিকার তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ (৫৮ লাখ কোটি)। যদিও এটি চীনের বাজারের চেয়ে ছোট (১৪ দশমিক এক লাখ কোটি)।

বিয়ের অনুষ্ঠানের সংখ্যার দিকে তাকালে, ভারতে প্রতি বছর ৮০ লাখ থেকে এক কোটি বিয়ের অনুষ্ঠান হয়।

যেখানে চীনে এই সংখ্যা প্রতি বছর ৭০ থেকে ৮০ লাখ এবং আমেরিকায় এটি ২০ থেকে ২৫ লাখ।

অর্থাৎ প্রতিটি বিয়ের খরচ আলাদাভাবে হিসেব করলে দেখা যায়, চীনা ও আমেরিকান পরিবার ভারতীয়দের চেয়ে বেশি খরচ করে।

কিন্তু পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যায়, ভারতীয় বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় পরিবারের ওপর আর্থিক বোঝা অনেক বেশি।

জেফরিজের রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতে বিয়েতে গড়ে সাড়ে ১২ লাখ রুপি খরচ হয়। আড়ম্বরপূর্ণ বিয়েতে গড়ে খরচ জয় ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা।

কিন্তু একটি বিয়েতে গড় খরচ, অর্থাৎ সাড়ে ১২ লাখ টাকা, ভারতের জিডিপির (দুই দশমিক চার লাখ টাকা) মাথাপিছু আয়ের প্রায় পাঁচগুণ।

এছাড়াও, এটি একটি ভারতীয় পরিবারের গড় বার্ষিক আয়ের (চার লাখ রুপি) তিন গুণেরও বেশি।

মজার বিষয় হল, এই খরচ প্রাক-প্রাথমিক স্তর থেকে স্নাতক স্তর পর্যন্ত ভারতে শিক্ষার গড় খরচের দ্বিগুণ।

এই পরিসংখ্যানগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, আমেরিকায় বিয়েতে যে খরচ হয় তা সেখানকার শিক্ষার খরচের অর্ধেক।

একটি বিষয় নিশ্চিত যে এই ধরনের জমকালো বিয়ে নিম্ন আয়ের পরিবারের উপর আর্থিক বোঝা তৈরি করে।

ঋণের কবলে পরিবার

বিয়ের প্রথম দশ বছর চেন্নাই থেকে আসা কৃত্তিকার (ছদ্মনাম) জীবনে সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল।

কিন্তু তিনি বলেন, এই বিয়ের কারণে তার বাবা-মায়ের ঋণের জাল থেকে বেরিয়ে আসতে প্রায় দশ বছর লেগেছে।

২০১৪ সালে যখন তাদের বিয়ে হয়, তখন শুধু মণ্ডপ এবং খাবারের জন্য প্রায় দশ লাখ টাকা খরচ হয়েছিল। অথচ সেটি কৃত্তিকার লাভ ম্যারেজ বা প্রেমের সম্পর্ক থেকে বিয়ে ছিল।

কৃত্তিকা তার বিয়ের খরচ থেকে শিক্ষা নিয়েছেন। এখন তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে তিনি তার দুই মেয়েকে সাদামাটাভাবে বিয়ে করাবেন।

তাই এই সচেতনতা নিয়ে মেয়েদের এগিয়ে নেওয়ার কথা ভেবেছেন তিনি।

ভারতীয় বিয়েতে সবচেয়ে বেশি খরচ হয় গহনা বাবদ।

বিলাসবহুল পার্টির প্রতি তরুণদের আকর্ষণ

একদিকে এমন একটি শ্রেণি আছে যারা বিয়ের জন্য ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে এবং অন্যদিকে এমন একটি শ্রেণী রয়েছে যারা তাদের সঞ্চয়ের বেশিরভাগ অংশ বিয়েতে ব্যয় করে।

চেন্নাইয়ের বাসিন্দা দীনেশ তার বিয়েতে চার-পাঁচ বছর ধরে সঞ্চয় করা অর্থের প্রায় ৭০ শতাংশ ব্যয় করেছেন।

চেন্নাইতে থেকেও, নিজ বিয়েতে এতো দিনের সঞ্চয় ব্যয় করাকে কোনো ভুলভাবে দেখেন না তিনি।

দীনেশ নিজে একজন ইভেন্ট প্ল্যানার অর্থাৎ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজনে কাজ করেন। তিনি প্রায় ৩০ লাখ টাকার গহনা, বিয়ের হল, মঞ্চ এবং বিয়ের সাজসজ্জার পেছনে ব্যয় করেছেন।

দীনেশ ব্যাখ্যা করেন, “আমাদের চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী বিয়ের আগে আমাদের কিছু আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে হয়।

আমরা সবকিছু বেশ বুদ্ধির সাথেই করেছি। বাগদান, বিয়ে, বিবাহোত্তর অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান সবকিছুই দারুণ জমকালো ও চোখ ধাঁধানোভাবে করা হয়েছে।”

শুধু ফটোশুটের জন্যই দীনেশ খরচ করেছেন দেড় লাখ রুপি। গহনার জন্য আরো বেশি টাকা খরচ করেছেন।

মূলত গহনার ব্যয় পুরো বিয়ের বাজেটকে প্রভাবিত করেছে। জেফরিজের প্রতিবেদন অনুসারে, বিয়ের অনুষ্ঠানের সময় দুই দশমিক নয় থেকে তিন দশমিক তিন লাখ কোটি টাকা খরচ হয় শুধুমাত্র গয়নার জন্য।

গরীব ও মধ্যবিত্ত পরিবারের বিয়েতে স্বর্ণকে যে গুরুত্ব দেওয়া হয়, বিলাসবহুল বিয়েতেও একই গুরুত্ব দেওয়া হয় হীরাকে।

সোনার গহনা দীর্ঘদিন ধরে ভারতীয় বিবাহের একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কনের পরিবার যৌতুক হিসেবে বরের পরিবারকে স্বর্ণালংকার দিয়ে আসছে এবং এতে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছে। এমনকি বাবা-মা ঋণ নিয়ে মেয়েদের জন্য গয়না কেনে।

মুকেশ আম্বানি।

গহনার পরে, খাবার হল বিয়ের অনুষ্ঠানে দ্বিতীয় বড় খরচের খাত। সাধারণত এক দশমিক নয় থেকে দুই দশমিক এক লাখ কোটি টাকা মানুষজনকে খাওয়ানোর পেছনে ব্যয় করা হয়।

এছাড়া পোশাক, মেকআপ, ফটোগ্রাফিসহ অন্যান্য বিষয়ে আলাদা খরচ রয়েছে।

ভারতে বিয়ের সাংস্কৃতিক গুরুত্ব থাকার কারণে ভারতের বাইরের দেশগুলো ভারতের বিয়ে সংক্রান্ত এই বিশাল বাজার ধরার চেষ্টা করছে।

তবে গত বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী শুধুমাত্র ভারতেই বিয়ের অনুষ্ঠান পালনের জন্য জোর দিয়েছিলেন।

তিনি ভারতীয় পরিবারগুলোকে বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য বিদেশে যাওয়ার পরিবর্তে ঘরোয়া স্থান বেছে নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।

ভারতের জয়পুর এবং উদয়পুরের প্রাসাদ ও হোটেলে সেইসাথে গোয়ার সমুদ্র সৈকতে দেশটির ধনী ব্যক্তি বিশেষত বলিউডের সেলেব্রিটিদের বিয়ের অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

ইভেন্ট আয়োজক ‘ম্যারেজ কালার’-এর ক্রিয়েটিভ ডিরেক্টর প্রদীপ চন্দর বলেন, তামিলনাড়ু ও কেরালার মতো দক্ষিণ ভারতের রাজ্যে সেলেব্রিটিদের বিয়ের অনুষ্ঠান করার প্রবণতা বেড়েছে।

তিনি ব্যাখ্যা করেন, “আম্বানি পরিবার খালি জায়গায় গ্র্যান্ড ডিভাইন সেট তৈরি করে প্রি-ওয়েডিং ফাংশন আয়োজন করে একটি নতুন ধারা তৈরি করেছে।”

একই সময়ে, বলিউড সেলিব্রিটিরা এখন বিভিন্ন হিট সিনেমায় দেখানো সুন্দর সুন্দর থিমে বিয়ে করতে আগ্রহী। অনেকেই সমুদ্র সৈকতে বিবাহের দিকে ঝুঁকছেন।

অনেকে আবার ‘পোনিয়ান সেলভান’ এবং ‘বাহুবলী’ ছবির মতো থিমে বিয়ের আয়োজনের ব্যাপারেও আগ্রহী।

যাইহোক, এরমধ্যেও ভারতে এমন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক তরুণ রয়েছেন যারা সাদাসিধে বিয়ে করে খরচ কমাতে চান। তামিলনাড়ুর মাদুরাই জেলার মনোজ তাদের একজন।

তিনি বলেন, ”আমি প্রেমের বিয়ে করেছি। কিছু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠানটি করলাম।”

”ঋণ নেয়া এবং বিয়ের জন্য লাখ লাখ টাকা খরচ করার পরিবর্তে, আমরা বাড়ির জন্য গুরুত্বপূর্ণ গৃহস্থালি সামগ্রী কেনার জন্য একই অর্থ ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।”

আজকাল অনেকেই স্বল্প খরচে বিয়ের দিকে ঝুঁকছেন।

সামাজিক চাপ এবং ভোক্তা সংস্কৃতি

দিল্লির নারী উন্নয়ন অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক এন. মণিমেকলাইয়ের মতে, মধ্যবিত্তরা ধনীদের আড়ম্বরপূর্ণ, অসংযত খরচের বিয়ের অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট হয়।

তিনি বলেন, “কিন্তু, এই ধরনের ব্যয়বহুল বিয়ে সমাজে চাপ সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি যাই হোক না কেন অনেকেই একটি জমকালো উদযাপনের আয়োজন করার জন্য চাপ অনুভব করেন।”

“এর জন্য যদি ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন হয় তবে তারা নেয়। ভোক্তা সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, তরুণ প্রজন্ম জীবনকে পূর্ণভাবে উপভোগ করতে চায়,” তিনি বলেন।

এটাও সত্য যে মানুষের আচার-আচরণে পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের জমকালো বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রবণতা বাড়ছে।

সাধারণ মানুষের মধ্যে অন্যের আচরণ পর্যবেক্ষণ করে তা গ্রহণ করার প্রবণতা বেড়েছে। একে কর্মক্ষমতার প্রভাব বলা হয়।

“বিয়ের অনুষ্ঠানের সময়, কনের পরিবার গয়না, বাসনপত্র, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং অন্যান্য গৃহস্থালি সামগ্রী কেনার খরচ বহন করে,” মণিমেকলাই বলেছেন।

এ জন্য তাদের ঋণ করতে হয়। কিন্তু চাকরিজীবী মেয়েদের বিয়ের পর বাবা-মা আর কোনো আর্থিক সহায়তা পান না, যার কারণে বৃদ্ধ বাবা-মা ঋণের বোঝায় পড়ে যান।

বিবিসি তামিল সংবাদদাতা

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024