স্বদেশ রায়
ছয়টি প্রাণ পৃথিবী থেকে ঝরে গেছে। এই ছয় পরিবারের যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে তা পৃথিবীতে ওই পরিবারের সদস্যরা ছাড়া খুব কম মানুষই বুঝবে । এমনকি যারা তাদের জন্যে বিবৃতি দিচ্ছেন বা তাদের নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে কথা বলছেন তাদের কতজন বুঝবেন এ নিয়েও প্রশ্ন আছে।
কারণ, আজ যে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এত কথা বলা হয়, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকের অবস্থা দেখেছি। যারা নাগরিক মুক্তিযোদ্ধা তাদের অনেকে শিক্ষার জোরে, অনেকে ভারত থেকে আসা নাগরিকদের পরিত্যক্ত সম্পদ দখল করে হয়তো ভালো আছে। কেউ কেউ নিজ যোগ্যতা বলে ভাগ্য বদল করেছে। কিন্তু নিজ চোখে দেখেছি, একজন নৌ কমান্ডোকে রাস্তার মাটি কাটার দিন মুজুরির কাজ করতে । কারণ, যুদ্ধ থেকে ফিরে সে আর মানসিকভাবে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেনি। আরেকজন নৌ কমান্ডোকে মিথ্যে মামলার কারনে দেশত্যাগ করতে দেখেছি। আর কমপক্ষে দুই লাখ মানুষের জীবন রক্ষাকারী একজন মুক্তিযোদ্ধাকে তাঁর সনদটি ঠিক করে দেবার জন্য নিজেও একবার অনুরোধ করেছিলাম কিন্তু অনুরোধের পরে আরেকজন মন্ত্রী যার ৭১ এর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন আছে- তিনি যখন তাকে মঞ্চ থেকে ধাক্কা দিয়ে নামিয়ে দিলেন- তখন আর অনুরোধ করিনি। ওই মুক্তিযোদ্ধা অভাবের তাড়নায় বেশ কয়েকবার আমাকে ফোন করেছিলেন। লজ্জায় ফোন ধরিনি। তার মৃত্যু সংবাদ আমাকে এক প্রকার স্বস্তি দিয়েছিলো। কারণ, আমার ভেতরও স্বার্থপরতার মতো গোপন হিংস্রতা বা নীচুতা তো আছেই।
আবার ৯১ এর সংসদে প্রথম দিনে গণতন্ত্রের জন্যে শহীদ নূর হোসেন, মনোয়ার, জাহিদ এর নাম স্মরণ করা হয়নি। বিবিসিতে নিজউ করার পরে সেটা যুক্ত করা হয়।
তেমনি ২০০৮ এর পরে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী হিসেবে যারা বড় পদে বসার সুযোগ পায় তাদের কাছে গিয়ে পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্টের হত্যার প্রতিবাদকারী অকালে মারা যাবার পরে তার সন্তানের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও চাকরি দিতে রাজী করানো যায়নি। পরে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা নিতে হয়। জঙ্গীর হাতে পিতা হারানো সন্তানকে চাকরি যিনি দেননি তিনি ভালো আছেন। যিনি দিয়েছিলেন, তিনি তত ভালো নেই।
তাই এখন যখন দেখি কোন তরুণ প্রাণ ঝরে যাচ্ছে তখন শুধু মনে হয় বড় একটা ভুল হয়ে গেলো পৃ্থিবীতে। কারণ, ধ্বংস হয়ে গেলো একটি পরিবার। কেউ ওদের খোঁজ নেবে না। এ কারণে, গত কয়েক ঘন্টা ধরে শুধু মনে হচ্ছে, আসলে এটা কি এড়ানো যেতো না। এ মৃত্যু কি একান্ত অনিবার্য ছিলো? এড়ানোর কোন পথ কেন খোঁজা হলো না?
অন্যদিকে তরুণরা যে তরুণদের গায়ে হাত দিলো, বোনের গায়ে হাত দিলো- এটা কি এড়ানো যেতো না? এ নিয়ে অনেক শক্ত ভাষায় লেখা যায়। যেমন সম্প্রতি আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলেছে, “তুমি যদি আগের মতো শক্ত ভাষায় লিখতে পারো তাহলে তোমার লেখা পড়বো, না হলে আর পড়বো না” । বন্ধুর কথায় নীরব ছিলাম। উত্তর দেইনি। কারণ, বন্ধু হলেও সে আমার বয়সে ছোট। মনে করেছি হয়তো আরো কয়েক বছর গেলে সে আমার ওপর আর অমন রাগ করবে না। সে তখন বুঝবে, শক্ত আর নরম ভাষা কোন বিষয় নয়। কারণ, শক্ত ভাষা ব্যবহার করে হয়তো অনেক সময় কুকুরের শুঁকনো হাঁড় চিবানোর মতো নিজের দাঁতের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসা নিজের রক্তের স্বাদে পুলকিত হওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে তো সবই শুকনো হাঁড়।
যেমন প্রধানমন্ত্রীও যে কথাটি বললেন তারও আংশিক নিয়ে উত্তেজনার সৃষ্টি হলো। আবার যারা ওই আংশিক নিয়ে উত্তেজনার পথে গেলো তাদেরও কথাটা আংশিক শুনে দোষারোপ করা হলো। এবং এমনকি অনেকে সম্পূর্ণ না শুনে এমন মন্তব্য করে ফেললেন, তাতে মনে হলো আমরা মনে হয় ১৯৭১ এর রণক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে আছি।
আবার এই মৃত্যু ও উত্তেজনার মধ্যে অনেকে রাজনীতির পথ খুঁজছেন। অনেকে রাজনীতির উপাদান যোগ করছেন। কিন্তু কেউই ভাবছি না আন্দোলনটি শুধুমাত্র সরকারি চাকুরি পাবার জন্যে একটি আন্দোলন।
শুধুমাত্র সরকারি চাকুরি পাবার জন্যে এমন আন্দোলন দেখেছিলাম পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে মন্ডল কমিশন করে যখন নিম্মবর্ণদের জন্যে অধিকহারে সরকারি চাকুরিতে কোটা রাখা হলো তখন। বাংলাদেশে গুলিতে মারা গেছে। আর সেখানে তখন ব্রাহ্মন সন্তানরা নিজের গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা গিয়ে প্রতিবাদ করেছিলো।
সেই ভারতে বছরখানেক আগে যে কাস্টের সন্তানরা একদিন সরকারি চাকুরির জন্যে গায়ে আগুন লাগিয়ে মারা গিয়েছিলো, তাদেরই একজন আড্ডায় বলেন, এখন আর আমাদের দেশে আগের মতো ব্রাইট ছেলে মেয়েরা সরকারি সার্ভিসে যায় না। কারণ, সরকার ওদের যোগ্য বেতন দেবে কীভাবে? টাটা ইনস্টিটিউটের ছাত্র ছাত্রীদের টাটাই রাখতে পারে না। আমেরিকা, জাপান এরা শুরুতেই দশ লাখের বেশি রূপী বেতন দিয়ে নিয়ে যায়। তাছাড়া পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খন্দ এমন দরিদ্র রাজ্যের ছেলে মেয়েরা সরকারি চাকুরি খোঁজে। যার সঙ্গে কথা বলছিলাম, তাঁর এক মেয়ে ও এক ছেলে- দুজনই ভালো চাকুরি নিয়ে চলে গেছে বিদেশে। আমাদের বাংলাদেশেও উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের ছেলে মেয়েদের মধ্যে এখন এই ধারা চলছে। সরকারি চাকুরির আশায় আছে গ্রামের ছেলে মেয়েরা। অতি সাধারণ ঘরের ছেলে মেয়েরা। তারও একটি বড় অংশ শুধু বেতনের আশায় নয়। সঙ্গে সঙ্গে তারা ক্ষমতা ও অন্য কিছু চায়। কারণ, ছাত্রদের মৌখিক পরীক্ষা নিতে বসে কথা বলে দেখেছি, শিক্ষা ক্যাডার, পররাষ্ট্র ক্যাডারের মতো সম্মানজনক ক্যাডারের থেকে তাদের প্রশাসন ক্যাডারের দিকে বেশি ঝোঁক। কেন সেখানে যেতে চায় তাও তারা অনেকখানি খোলামেলা বলে, সবটুকু বলে না। তারা বলে, প্রশাসন ক্যাডারের ক্ষমতা অনেক বেশি। বাকিটুকু তো আর কাউকে জিজ্ঞেস করা যায় না।
কিন্তু এই সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে কথা বলে মনে হয়, তারা যদি বেসরকারি খাতে শুরুতে ৭০, ৮০ হাজার বা এক লাখ টাকার চাকুরি পেতো আর যদি সেখানে নিয়ম ও নিশ্চয়তা থাকতো তাহলে তারাও সরকারি চাকুরির প্রতি এত ঝুঁকতো না। অন্যদিকে বিদেশে ভালো চাকুরির সুযোগ পেলেও তারা দেশের সরকারি চাকুরির জন্য চাতক পাখি হতো না। কিন্তু তাদের খুব কমই বিদেশে ভালো চাকরি পাবে না। কারণ, এদের বেশিভাগ ইংরেজি ভালো জানে না। তাছাড়া একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজেুয়েটের যে শিক্ষা থাকতে হয় তা তারা অর্জন করার সুযোগ পায়নি।
অন্যদিকে সরকারের আজ কোটা সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি চিন্তা করতে হবে, ১৫ বছরের বেশি টানা ক্ষমতায় থাকার পরে, এত উন্নয়নের কথা বলার পরেও কেন সরকারি চাকুরির কোটার জন্যে ছেলে মেয়েরা আন্দোলন করছে? তাহলে কি উন্নয়নে কোন ফাঁক ফোকর থেকে যাচ্ছে? যে কারণে সরকারি চাকুরি ছাড়া অন্য কোন চাকরির প্রতি তারা আকর্ষন বোধ করছে না। উন্নয়নের ক্ষেত্রে কি তাহলে অবকাঠামো ও উৎপাদন সমন্বয় হচ্ছে না? এখানে কি কোনটা আগে হয়ে যাচ্ছে?
যেমন বঙ্গবন্ধু তার প্রথম পাঁচশালা পরিকল্পনার দীর্ঘ মেয়াদি অংশে যে বিষয়গুলোর রেখেছিলেন, তার একটি বিষয়, ঢাকা শহরে পাইপলাইনে বাসায় বাসায় দুধ সরবরাহ। তিনি কিন্তু সেজন্য আগে পাইপ লাইন বসাননি। আগে সাভার ডেইরি ফার্মকে বড় করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানকে সমানতালে প্রবাহিত করতে হলে সব সময়ই খেয়াল রাখতে হয় কতটা দুধ উৎপাদন অবধি গাড়িতে দুধের প্যাকেট সরবরাহ করা হবে- আর কতটা উৎপাদনের পরে পাইপ লাইনের কাজে হাত দেয়া হবে।
দেশ পণ্য উৎপাদনমুখী হলে তখন শুধু অপরের কোম্পানিতে চাকরি নয়, তরুণরা নিজেও কর্মসংস্থান গড়ার সুযোগ পায়- যা আরো বেশি সম্মানের ও বেশি সম্ভাবনাময়।
তাই যারা কোটা বিরোধী আন্দোলন করছে তারা সকলে যে কারো উস্কানিতে বা সরকার বিরোধীতার কারণে করছে এমন ভাবার আগে সত্যি অর্থে খোঁজ নেয়া দরকার, চাকরি বা কর্মসংস্থান ওদের কতটা দরকার। বাস্তবে ওরা কতটা হতাশায় আছে বা আশার আলোর নিচে দাঁড়িয়ে। ওরা বর্তমানের তরুণ। তাই ওদের সঙ্গে কোন অতীতকে না জড়িয়ে বর্তমানের ওপর দাঁড়িয়ে ওদের সমস্যার সমাধান করাই যুক্তিসঙ্গত। আর এ পথেই অনাকাঙ্খিত অনেক ঘটনাকে এড়ানো যায়।
লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.
Leave a Reply