শনিবার, ১৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৪ অপরাহ্ন

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৭)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৮ জুলাই, ২০২৪, ৪.২০ পিএম

শিবলী আহম্মেদ সুজন

নারদ বাঁধা

তারপর তাঁতের পিছন নারদের সাথে টানা সুতা বাঁধার পালা। সাধারণতঃ খোলা জায়গায়, বিশেষ করে টানা হোতানের স্থলে তাঁতের পিছলাধারগদের [endroll] সাথে টানা সুতা বাঁধার কাজ করা হয়। একজন লোক টানা সুতা সানার উপর ভাঁজ করা অবস্থায় ধরে রাখে এবং আর একজন লাকি টানা সুতা প্রান্তের ভাঁজ খুলে নিয়ে এর ভিতরে একটি বাঁশের কাঠি পুরে দেয়া তার এক কাঠিটি তাঁতের পিছন নারদের সঙ্গে শক্ত করে বেঁধে দেয়। এর পর টানা সুতাগুলি ঠিকভাবে সাজিয়ে দেওয়া হয়। এর জন্য তাঁতিরা একটি বেতের তুলি এবং একটি ধনুকের মত বাঁকা বেত ব্যবহার করে। তুলি এবং বাঁকা বেত দ্বারা এমন মোলায়েম ভাবে টানা সুতাগুলিকে সাজান হয় যাতে টানা সুতার কোনরূপ ক্ষতি না হয়। এই ভাবে সাজানের পর তাঁতের টানা সুতার সাথে তাঁতের পিছন নারদ আস্তে আস্তে ভাঁজ করা হয়।

বুবাঁধা

এর পর বু-বাঁধার পালা। বু হল এক প্রকার লাল রঙের পাতলা দড়ি (বা সুতা) যার সাহায্যে টানা সুতা বাঁধা হয়। নারদে ভাঁজ করা সানা বাঁধা টানা সুতার ভাঁজ অল্প খুলে তাকে আনুভূমিক ভাবে (horizontally) বিছিয়ে দেওয়া হয়, ঠিক যেমনটি তাঁতে বিস্তৃত থাকে। যত্নসহকারে এক টুকরা বাঁশের ফলা টানা সুতা, ও সানার মাঝখানে পুরে দেওয়া হয়, যাতে তাঁতি বাঁশের ফলা মাঝখানে রেখে বু বাঁধতে সক্ষম হয়। বু সুতা একটি-নাটাই এর মত চাকায় পাশে রাখা হয় এবং তাঁতির হাতের ইঙ্গিতে ডিম্বাকৃতি একটি ছোট কাঠের টুকরার ভিতর দিয়ে আসে। টানা সুতার উপরে বেত রাখা হয়। অতঃপর তাঁতি হাতের আঙ্গুলের ডগায় দুইটা টানা সুতা তুলে নেয় এবং বু দ্বারা বাঁধে। এ ভাবে বু বাঁধা চলতে থাকে যতক্ষণ না কাজ শেষ হয়। টানার একদিকে বু বাঁধা হলে টানা পাল্টে নেওয়া হয় এবং অপর দিকে অনুরূপ ভাবে বু বাঁধা হয়।

কাপড় বুনন

চারটি খুঁটি শক্ত ভাবে তাঁতের চার কোনায় পোতা হয়। উপরে অপর চারটি বাঁশ সমান্তরাল ভাবে রেখে খুঁটিগুলির সঙ্গে বেঁধে পরস্পর সংযুক্ত রাখা হয়। তারপর সানা ও বু  সাথে টানা সুতা এনে তাঁতের সামনের নারদের (breast roll) সাথে বাঁধা হয়। সামনের এবং পিছনের নারদ (breast and end roll দুটা হয় খুঁটির খাঁজে ভার দিয়ে রাখা হয় বা খুঁটির সঙ্গে রশি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। ঐ রশিকে যতদড়ি বলা হয়। নারদগুলিকে একটি কিল্লী দ্বারা ঘোরান হাত কিন্তু উল্টাদিকে না ঘুরার জন্য একটি কঞ্চির সাহায্য নেওয়া হত। কঞ্চিটির একদিক নারদের খাঁজে বা ছিদ্রের সঙ্গে আটকান থাকত এবং অপরদিক মাটিতে পোতা থাকত।

এগুলি কাঠের সমতল তক্তার সঙ্গে খাঁজ কেটে লাগিয়ে দেওয়া হত এবং মাটিতে পোতা লোহার বা কাঠের পেরেকের সাথে আটকে দেওয়া হত। পদচালিত যন্ত্রদুটি বাঁশের তৈরী এবং এগুলি তিন ফুট প্রস্থ ও দেড় ফুট গভীর মাটির গর্তে রাখা হত। সুপারী গাছের তক্তা দ্বারা মাকু তৈরী হত। মাকু দৈর্ঘ্যে দশ থেকে চৌদ্দ ইঞ্চি এবং প্রস্থে ৩/৪ ইঞ্চি ছিল। মাকুর দুই দিকে বর্শার মত সুরু ছিল এবং ঠিক মাঝখানে সামান্য খালি জায়গা ছিল যার ভিতরে একটি লোহার তার লাগান ছিল। এই তারের ভিতর দিয়ে বানা

সুতা চলাচল করত। এ ভাবে সকল যন্ত্রপাতি যোগাড় হলে তাঁতি কাপড় বুননের জন্য বসত। তাঁতি ডান পা একটু হেলান দিয়ে একখানি তক্তা বা মাদুরের উপর গর্তের ঠিক কিনারে বসত। বাম পায়ের ডগা দিয়ে একটা পদচালিত যন্ত্র (treadle) চাপ দিয়ে তাঁতি খুব জোরে মাকু টান দিয়ে একহাত থেকে অন্য হাতে বদল করে নিত। এভাবে বানা সুতা এসে টানা সুতার সঙ্গে পেঁচ লেগে যেত এবং কাপড় বোনা শুরু হত। এরূপে তাঁতি নিজের কাজ করে যেত যতক্ষণ না কাপড় বোনা শেষ হয়।

জামদানী বা ফুল তোলা কাপড় বোনা একই রকম ছিল। পার্থক্য শুধু এই ছিল যে, এধরনের কাপড় কিছু বুনা হলে দুই জন তাঁতি তাঁতের উপরের কাপড়ের উপর ঈপ্সিত ফুল তুলে নিত। উপরোক্ত বিবরণ থেকে বুঝা যায় যে, ঢাকার তাঁতিরা কি দক্ষতার সাথে মসলিন তৈরীর কাজ করত। এ বিবরণ থেকে আরও স্পষ্ট বুঝা যায়, কেন এক এক টুকরা মসলিন তৈরী করতে একজন তাঁতি ও তার দুইজন সহকারীর ছয় মাস সময়ের দরকার হত।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক আবদুল করিম-এর বইয়ের সহায়তায় এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে।

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৬)

কিভাবে ঢাকাই মসলিন বোনা হতো ( পর্ব-৬)

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024