প্রবীর বিকাশ সরকার
বাঙালি জাতির জনক, হাজার বছরের ইতিহাসে এক মহান ব্যক্তিত্ব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাতের অন্ধকারে সপরিবারে তাঁকে কাপুরুষের মতো হত্যা করে কতিপয় উশৃঙ্খল সীমার সৈনিক ডালিম, ফারুক, রশিদ ও তাদের সঙ্গীরা বাঙালি জাতির ইতিহাসে জাতীয় বেঈমান বলে পরিচিত কুখ্যাত মোশতাক আহমদের নির্দেশে। যে হত্যাকাণ্ডের খেসারত দিচ্ছে আজকের বাঙালি জাতির নতুন প্রজন্ম, কি দেশে কি বিদেশে। বঙ্গবন্ধুহীন জাতি আজ অসংগঠিত এবং চরম বেপরোয়া।
বঙ্গবন্ধু—হত্যাকাণ্ডের পরিণতিতে বিগত ৪৯টি বছর ধরে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে হিসেবে পরিচিত হয়ে আছে। উত্তরণ আমাদের এখনো দূরবতীর্। বিশেষ করে, আজকের প্রজন্ম তথা তরুণরা দিকনির্দেশহীন, কর্মহীন এবং নেতৃত্বহীন। অথচ আজকের তরুণ নাগরিকরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। কিন্তু হতাশাগ্রস্ত এসময়ে বিভ্রান্ত বর্তমান যুবসমাজকে পথ দেখাবে কে? আজ বড় প্রয়োজন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে। যেভাবে তিনি পরাধীন বাঙালি জাতিকে মুক্তি দিতে ক্রমশ স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, যেভাবে যুবসমাজকে উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত করেছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামে, ঠিক তেমনিভাবে আজকে প্রয়োজন তাঁকে বাংলাদেশে নতুন প্রজন্মকে সংগঠিত করতে, উদ্বুদ্ধ করে তুলতে, সুশিক্ষিত নাগরিক হয়ে গড়ে তুলতে, দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নিরলস পরিশ্রমে নিযুক্ত করতে, সর্বোপরি বিশ্বের বুকে উন্নত জাতির সুসংস্কৃত নাগরিক হিসেবে মাথা তুলে দাঁড়ানোর লড়াইয়ের ডাক দেবার জন্য।
খ্রিস্টের জন্মেরও বহু আগে বীর—বিক্রম গঙ্গারিডি জাতির অপর নামই যে আধুনিক বাঙালির পরিচয় দ্বিগ্বিজয়ী বীর মহামতি আলেকজান্ডার যে জাতির নাম শুনে ভয়ে ভারতবর্ষ অভিযানের পরিকল্পনা ত্যাগ করে ফিরে গিয়েছিলেন। শিক্ষা, দীক্ষায়, বিজ্ঞানে, ধর্মে, সৃষ্টিতে যে বাঙালি জাতি প্রাচীন, মধ্য ও ব্রিটিশ যুগে ছিল বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম জাতিগুলোর মধ্যে অন্যতম। বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমে সারা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়েছে শান্তি ও সাম্যের আলো। সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষাগুরু বিদ্যাসাগর, সমাজ সংস্কারক রাজা রামমোহন রায়, প্রথম জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী স্বামী বিবেকানন্দ, পবর্তশৃঙ্গ এভারেস্টের উচ্চতা জরিপে সুনাম অর্জনকারী রাধানাথ শিকদার, এশিয়ার প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিশ্বে ন্যায়দণ্ডের মূর্তপ্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বিচারপতি ডঃ রাধাবিনোদ পাল, বিশ্বের প্রথম সুউচ্চ ভবন শিয়ার্স টাওয়ারের স্থপতি ফজলুর রহমান খান, অর্থনীতিতে নোবেল বিজয়ী অর্মত্য সেনসহ জানা—অজানা আরও বহু জ্ঞানী, গুণী, বাঙালির উত্তরসূরি যে জাতিÑÑতার প্রজন্মের একি হাল্ আজকে দেশে—বিদেশে! কী হতশ্রী অবস্থা আজ তরুণ প্রজন্মের! বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার মানুষ তরুণ প্রজন্ম আজ সশস্ত্র জঙ্গি, ছিনতাইকারী, চাঁদাবাজ, মাদকাসক্ত!
কী ছিল না আমাদের? কী নেই আমাদের? সবই আছে শুধু পুনরাবিষ্কারের জন্য প্রতীক্ষমান। পুনর্গঠনের জন্য অপেক্ষমান। কিন্তু কে দেবে নেতৃত্ব এগিয়ে চলার? কোথায় সেই পথ প্রদর্শক?
আজ বাঙালির নতুন প্রজন্ম যারা ছুটছে বহির্বিশ্বে শুধু মানুষের মতো একটু বাঁচার তাগিদে দেশে সোনার খনি ফেলে। বিদেশিদের মুখে প্রায়শ শুনি বাংলাদেশের অমিত সম্ভাবনার কথা। বাংলার মাটিতে সবই আছে, শুধু চাই আহরণ করার শক্তি ও সমর্থন। আর সেটা নির্ভর করে সম্পূর্ণভাবে তরুণ প্রজন্ম তথা যুবশক্তির কর্মক্ষমতার ওপর। কিন্তু তাদের মেধা ও শক্তিকে ব্যবহারের জন্য নেই কোনো প্রকল্প, নেই কোনো অত্যাধুনিক শিক্ষানীতি, নেই কোনো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা না সরকারিভাবে, না বেসরকারিভাবে।
উপচে পড়ছে তরুণশক্তি স্বাধীন এই দেশটিতে। কিন্তু যথার্থ কাজে নিয়োগ করার মতো উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউ, অথচ উৎসাহিত করা হচ্ছে আদম ব্যবসাকে। ধিক্ ধিক্ এ বাংলাদেশকে!
তাই আজ বিশ্বের বুকে “রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার বাঙালি জাতির” নতুন প্রজন্ম প্রাণের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে থাই—সিঙ্গাপুরের ভয়াল বনে—জঙ্গলে, ফুল বিক্রি করছে সৌন্দর্য নগরী রোমে—প্যারিসে, পাথর ও মাটি কাটছে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তপ্ত মরুভূমিতে, ট্যাক্সি—ক্যাব্ চালাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, রেস্টুরেন্ট—কলেকারখানায় কাজ করছে প্রাচ্য—সুন্দরী টোকিওতে, রাবার ক্ষেতে সস্তায় শ্রম বিক্রি করছে উদীয়মান শক্তি মালয়েশিয়াতে, ভেন্ডারের জীবন কাটাচ্ছে একদা শাসকপ্রভুদেশ ব্রিটিশের রাজধানী লন্ডনে। না আছে তাদের জীবনের নিরাপত্তা, না পাচ্ছে সুনাগরিক হওয়ার সুযোগ, না আছে মানবাধিকার। জাতি হিসেবে বিশ্ববাসীর বাহবা পাবার পরিবর্তে অহরহ পাচ্ছি সমবেদনা না হয় পদাঘাত। গৌরবের যা ছিল দিগন্তে বিলীন হয়েছে ’৭৫ এর বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরপরই। বাঙালি জাতির গৌরব, দিক নিদের্শক, স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে মাত্র গুটিকয় দুষ্কৃতিকারী হত্যা করে বিশ্বে বিশ্বাসঘাতকের পরিচয়ে স্থাপন করেছে সমগ্র জাতিকে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সোনার দেশ গড়তে হলে সোনার মানুষ চাই। আর সেই সোনার মানুষই হচ্ছে আজকের তরুণ যুবসমাজ। তাদেরকে গড়ে তুলতে আজ যাঁর প্রয়োজন, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।
কিন্তু বঙ্গবন্ধু আর আসবেন না। কোনোদিনই তাঁর আর ফেরা হবে না। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি শেখ মুজিব সারাজীবন স্বপ্ন দেখেছিলেন ইতিহাসখ্যাত পরাক্রমশালী বাঙালি পুনর্জন্মের। তাঁর স্বপ্নের অর্ধেক বাস্তবায়ন ঘটেছে ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। যদিও রক্ত দিতে হয়েছে অঢেল, সংগ্রাম করতে হয়েছে নিরন্তর। বহু মা—ভগিনীকে দিতে হয়েছে আত্মাহুতি। মুক্তিযুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। দ্বিতীয় পর্বের মুক্তিযুদ্ধটি ছিল: সবুজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সোনার বাংলার বাস্তবায়ন। সেখানে অপরিহার্য ছিল বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্ব।
যে বাঙালি বীর বিজয় সিংহ একদা জয় করেছিলেন লংকা দ্বীপ, যে বাঙালি রাজা শৈলেন্দ্র সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল সূদর ইন্দোনেশিয়ার বালীদ্বীপে, যে সুনিপুণ জাদুকরী তাঁতী মসলিন কাপড় বুনে ভারতের মুঘল বংশ, আফ্রিকার মিশর—রাজ ফারাও, মধ্যপ্রাচ্যের ধনী শেখ—সুলতান, বিলেতের অভিজাত, জাপানি সামুরাইদের অকুণ্ঠ প্রশংসা অর্জন করেছিল সেই সুললিত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেই লক্ষ্যেই জাতিকে পাকিস্তানি শৃংখল থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে প্রতিষ্ঠিত করে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় যে, জাতিকে সুগঠিত করে গড়ে তোলার সময় সুযোগ তাঁকে দেয়নি পাকিস্তানি দালাল এদেশের স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। বঙ্গবন্ধুর প্রকল্প ও পরিকল্পনা ছিল প্রচুর। এর জন্যই সারাটি জীবন তিনি মোহ—বিলাস, লোভ—লালসা ত্যাগ করে সংগ্রাম করেছিলেন। লাগাতার আন্দোলনে—আন্দোলনে যাঁর জীবন গিয়েছে বসেননি চেয়ারে, চড়েননি গাড়িতে। আজ প্রবীণ ও নবীন অনেক আওয়ামী লীগ দলের নেতাই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত চেয়ারে বসে রাজনীতি করেন, দামি গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় বঙ্গবন্ধুর মতো কারিসমা, মেধা—বুদ্ধি, চিরক্ষণতা কারো মধ্যেই দেখা যায় না। এককথায় নেতৃত্বহীন দলটির ভবিষ্যৎ অন্ধকার তা আর না বললেও চলে।
জাপান প্রবাসী লেখক ও গবেষক
Leave a Reply