সোমবার, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:১৬ পূর্বাহ্ন

 নিজেদেরকে বোঝাতে কেন মূল্যটা এত বেশি দিতে হলো? 

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০২৪, ৮.৫২ এএম

স্বদেশ রায়

রাষ্ট্র বা সমাজে যে কোন কিছু্ কোন একটা সময়ে পুরাতন হিসেবে প্রমানিত হয়। রাষ্ট্র ও সমাজের এটা স্বাভাবিক গতি। এ সত্য কে মেনে নিয়ে বরং ঘটনার কারণ খোঁজাই প্রয়োজনীয়।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক যে ছাত্র জাগরণ ঘটেছে এ যেমন চরম সত্য তেমনি এই ঘটনার ভেতর দিয়ে দেশের সার্বিক রাজনীতি যে পুরাতন সময়কে আকড়ে ধরে আছে সেটাই প্রকাশ পেয়েছে।

কেউ হয়তো “সার্বিক রাজনীতি” কথাটির আপত্তি করতে পারেন, তারা বলতে পারেন সরকারি দলের দেউলিয়াত্বই যেখানে প্রকাশ পেয়েছে সেখানে সার্বিক রাজনীতি কেন বলা? সরকারি দল দৃশ্যমান এবং তারা সরকার পরিচালনা করছে তাই তাদের দেউলিয়াত্ব বেশি দেখা গেছে,  প্রমান হয়ে গেছে রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা এখন সত্যই দেউলিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু বিরোধী রাজনীতিকরাও বর্তমান প্রজম্ম ও সময়ের সঙ্গে মিলিয়ে কোন রাজনীতি দেশের মানুষের সামনে হাজির করতে পারেনি। তারা যে ভবিষ্যতমূখী তার কোন প্রমান তারা দিতে পারেনি। বরং সামগ্রিক রাজনীতি মিলে ছাত্ররা যেখানে অহিংস ছিলো সেখানে গোটা রাজনীতি রাষ্ট্র ও সমাজে সংহিসতা নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ সকলেই সেই শক্তি নির্ভর জায়গায় বসে আছে।

তাই এখানে সরকার ও বিরোধী দলে ভাগ না করে বলা যায় দেশের রাজনীতি ব্যর্থ হয়েছে বা হতে চলেছে। একটা দেশের রাজনীতি নানান কারনে ব্যর্থ হয়। তাই যখনই কোন দেশের রাজনীতি ব্যর্থ হয় তখন রাষ্ট্র বা সমাজের উচিত সকলকে স্বাধীনভাবে এর কারণ খুঁজতে দেয়া। সমাজের নানান প্রান্ত থেকে যদি স্বাধীন মতামত আসতে থাকে তাহলে তার ভেতর দিয়ে একটা ভবিষ্যৎ রেখা খুঁজে পেতে সহজ হয়।

যেমন ছাত্রদের আন্দোলনের ফলে ২০১৮ থেকে এ নিয়ে দুবার চাকরিতে কোটা বা সংরক্ষণ পদ্ধতি বাতিল হলো। এই কোটা বা সংরক্ষণ পদ্ধতি বাতিলের পরে অনেক প্রশ্ন আসছে,  এর ফলে নারীরা পিছিয়ে পড়বে, নিম্মমানের জেলার ছেলে মেয়েরা পিছিয়ে পড়বে। সরকারি চাকরি আবার সেই ধনী পরিবারের সন্তানদের হাতে চলে যাবে। এ কথাগুলো মোটা দাগে সত্য। তবে সবটকু সত্য নয়। ধনী ঘরের ছাত্ররা যেহেতু ঢাকার ভালো স্কুলগুলোতে পড়ে তাই স্বাভাবিকই তারা সরকারি চাকরির পরীক্ষায় ভালো করবে এটা সত্য। কিন্তু পাশাপাশি এও সত্য বৃটিশ আমল বা পাকিস্তান আমলে সরকারি চাকরির প্রতি ধনী ঘরের ছেলেদের যে মোহ ছিলো এখন তা নেই। কারণ তারা যে জীবন যাপনে অভ্যস্ত- সততার সঙ্গে সরকারি চাকরি করে ওই জীবন যাপন মেইনটেইন করা যায় না। সরকারি চাকরির সকল সুবিধাকে বিশ্বমানের বেতন বা সুযোগ সুবিধার সঙ্গে তুলনা করে হিসেব করলে একজন সরকারি কর্মকর্তাও বাস্তবে ছদ্ম বেকার। অন্যদিকে সাধারণ ঘরের ছেলে মেয়েদের বড় অংশকে ভালো শিক্ষা দেবার কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। তাই কোটা বা সংরক্ষণ পদ্ধতি উঠে যাবার পরেও তারাও কতটা সরকারি চাকরি পাবে ও দেশের সার্বিক বেকারত্ব কতটা ঘুচবে সে প্রশ্ন থেকেই যায়।

জাপান টাইমস, বাংলাদেশের এই ছাত্র জাগরণকে আরব স্প্রীং এর সঙ্গে তুলনীয় কিনা এ প্রশ্ন রেখে শুরুতেই বলেছে, বেকারত্বই এর মূল কারণ।

অন্যদিকে চাকরির চাহিদা নিয়ে এই যে আন্দোলন ও রক্তপাত দেশে ঘটলো এর মূল কিন্তু বেকারত্ব। দেশের বয়স চুয়ান্ন হতে চলেছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাস্তবে বেকারত্ব কমানোর কোন সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা করা হয়নি। চিহ্নিত করা হয়নি দেশের তরুণশক্তিকে শ্রমশক্তিতে পরিনত করে দেশে কী কী শিল্প গড়ে তোলা যেতে পারে- যার ভেতর দিয়ে দেশ ধীরে ধীরে উৎপাদনকারী একটি দেশ হতে পারে। এর বদলে দেশকে অনেক বেশি অনিয়ন্ত্রিত আমদানী মুখী করা হয়েছে।  যার ফলে দেশকে মূলত কয়েকটি দেশের অনেকটা সরাসরি বাজারে পরিণত করা হয়েছে-  যা দেশের শিল্প বিকাশের পথ বন্ধ করে দিয়েছে।

এছাড়া তরুণ শ্রেনী যে চাকরি খোঁজার বদলে নতুন নতুন স্ট্রার্ট আপে যাবে সে পথও বন্ধ হয়ে গেছে। যার ফলে দেশের কয়েকজন ব্যক্তি ছাড়া বাদবাকিরা সারাদিন কাজ করে যা আয় করে তা বিশ্বমানে ফেলে হিসেব করলে সকলেই কম বেশি ছদ্ম বেকার।

আর ইন্টেলেকচ্যুয়াল প্রপার্টির তো কোন মূল্যই নেই। যেমন প্রতিবেশি দেশের একজন সাবেক সম্পাদক আমার পোর্টালে লিখতে আগ্রহী হয়ে লেখার সম্মানী জানতে চাইলেন। তাকে যখন বলি আমাদের দেশের সব থেকে বড় মিডিয়া হাউজ- শুধু মাত্র তার পত্রিকা ও অনলাইনে ওই জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপকের লেখা ছাপা হবে, অন্য কোথাও তিনি লিখতে পারবেন না- এই শর্তে তাকে মাসে এত টাকা দেয়। তার উত্তর শুনে তিনি বলেন,  আপনারা এত কিপটে কেন? উত্তরে বলি,  কিপটে নই এটাই সামর্থ্য। বা অনেকটা সামর্থ্যের বেশি। কারণ, এ ইন্ডাজট্রিতে আয় কমে গেছে।

ঠিক তেমনি এখান থেকে বছর চার কি তিন আগে সরকারের তিনটি বিভাগ থেকে চাকরি ছেড়ে দিয়ে তিনজন তরুণ আমার কাছে এসেছিলো  তাদের তৈরি ড্রোনের মডেলসহ তার বিস্তারিত লিটেরেচার দেখাতে ও জানাতে। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো আমি হয়তো তাদের বিষয়টি বুঝতে পারবো ও তা নিয়ে লিখবো। যাতে সরকার বা দেশের নীতি নির্ধারণীরা বিষয়টি জানতে পারে।

ওই সময়ে আমি চাকরি ছেড়ে দিয়ে সমসাময়িক কিছু বিষয় নিয়ে একটু পড়াশুনায় ব্যস্ত ছিলাম। যে কারণে নিজের সম্পাদনায় কোন মিডিয়া আউটলেট ছিলো না। তবে মাঝে মাঝে মনের তাগিদে একটা দুটো অনলাইন আউটলেটে ও দু একটা পত্রিকায় মাঝে মধ্যে লিখতাম। এ বিষয়টি যেহেতু গুরুত্বপূর্ণ তাই দেশের একটি প্রাচীন পত্রিকায় একটি লেখার ভেতর কয়েক প্যারায় বিষয়টি এনেছিলাম। সকাল বেলায় দেখি ওই অংশটুকু বাদ দিয়ে লেখাটা ছাপা হয়েছে। দীর্ঘ দিন এই পেশায়, তাই বুঝতে কষ্ট হয়নি কেন তারা বাদ দিয়েছে। বরং নিজের দূরদর্শিতার অভাবটা বুঝতে পারাতে-  অপমানিত হয়েও কোন কষ্ট পায়নি। কারণ ভুল তো আমারই। আমারই তো মনে রাখা উচিত ছিলো আমরা এখনও কোন শতাব্দীতে বসে আছি।

তবে ওই তরুণদের প্রচেষ্টার যাবতীয় পেপারস ও এর সঙ্গে আনুসাঙ্গিক কিছু বই ও কিছু আর্টিকেল জোগাড় করে পড়তে হয়েছিলো ওই বিষয়ে কয়েক লাইন লেখার জন্য। তার থেকে যা বুঝেছিলাম তাতে স্পষ্ট হই,  টার্কি যে ড্রোন সামরিক খাতে ব্যবহারের জন্যে বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে, বাংলাদেশের তরুণরা যদি ওই স্ট্রার্ট আপটি করতে পারতো তাহলে বেসামরিক কাজে ব্যবহারের জন্যে তাদের ড্রোনগুলোর যোগ্যতা ও আয় একদিন ঠিকই টার্কির ড্রোনের সঙ্গে পাল্লা দিতো। যেহেতু তাদের নিয়ে কিছু লিখতে পারেনি তাই তারা আর যোগাযোগ রাখেনি। তবে যে কজন তরুণ আমার কাছে এসেছিলো তাদের একজন এখন আমেরিকার একটি ইউনিভার্সিটিতে। এখান থেকে কয়েক মাস আগে তার একটি ফেসবুক পোস্ট ছিলো,  আমি দেশকে মায়ের মতোই ভালোবাসি, কিন্তু আমি দেশে ফিরে তো আমার ইচ্ছা অনুযায়ী কিছু করতে পারবো না। আমাকে কিছু করতে হলে তো আমেরিকায় বসেই করতে হবে। তার ফেসবুক পোস্টটির দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকি।

আসলে হয়তো ওর জায়গাতে ও সঠিক। ওর কাজ আমি শতভাগ বুঝবো না, তবে আমি তো এটা বুঝি রফিক জাকারিয়ার স্ত্রী যদি তার সন্তান ফরিদ জাকারিয়াকে আমেরিকায় না পাঠাতেন তাহলে ভারতে থেকে সে কোনদিন ফরিদ জাকারিয়া হতে পারতো না। যেখানে প্রনয় রায়েরই কণ্ঠ বন্ধ হয়ে যায় সেখানে তো একজন ফরিদ জাকারিয়া হতে পারে না। সে ফরিদ জাকারিয়া হতে পেরেছে কেবল আমেরিকার বড় মিডিয়ার জন্যে নয়,  আমেরিকা তাকে সেই স্বাধীন পরিবেশ দিয়েছে।

বাস্তবে রাষ্ট্র ও সমাজের সব সময়ই দ্বায়িত্ব তার তরুণ প্রজম্ম’র জন্য স্বাধীন ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমাদের এশিয়ান সমাজের বেশিভাগ সমাজই একটি পশ্চাদপদতায় আটকে আছে। বাস্তবে এ সমাজ ও   তার চিন্তাগুলো সব সময়ই একটি নির্দিষ্ট ফ্রেমে ফেলেই তরুণ সমাজকে তৈরি করতে চায়। তাদের ফ্রেমের মধ্যে না এলেই গেল গেল রব তোলে। কেউ-ই মনে রাখে না পৃথিবী প্রবাহমান। যেখানে নদীই জানে না তার পরবর্তী বাঁকে শহর না গ্রাম গড়ে উঠবে- না, একটি তৃনভূমি থাকবে- সেখানে মানুষ কীভাবে জানবে তার পরবর্তী প্রজম্ম কোন সমাজ বা পরিবেশ চায়?  এ কারণে রাষ্ট্র ও সমাজের কাজ শুধু মাত্র স্বাধীন ও সহায়ক পরিবেশ তৈরি করা। এবং স্বাধীন ও সহায়ক পরিবেশের পথে বাধা না হওয়া।

বাধা দিলে বা বাধা পেলে কী হয়  তাও নদীর দিকে তাকালে দেখা যায়। অনেক বাধায় নদী নিজেই বাঁক নিয়ে নিজেকে প্রবাহিত করতে থাকে। কিন্তু নদীকে যদি বেশি বাঁক নিতে বাধ্য করা হয় তাহলে সে এক সময় অনেক কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। যার ফলে প্রকৃতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়। আর তখনই বোঝা যায় কোমল জলের কত ভয়াবহ শক্তি। আর এই কোমল জলের শক্তি দেখেই মানুষের মনের শক্তিকে বুঝতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে হয় মনের শক্তিটি সব থেকে বেশি থাকে তারুন্যে।

বাংলাদেশের এ জুলা্ইয়ে এক সপ্তাহ ধরে রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতিতে অনেক পরিবর্তন ঘটে গেছে। এবং এখানে সব থেকে থেকে বেশি আকারে প্রকাশ পেয়েছে, সমাজ ও বর্তমান প্রজম্ম বদলে গেছে- কিন্তু তাদের প্রজম্মের রাজনৈতিক নেতৃত্ব নেই। সরকারি দল ও বিরোধী দল সবাই তাদের প্রজম্ম থেকে বহু দূরে। আবার তাদের প্রজম্মেও কোন রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হয়নি।

সরকারি দল ও দেশের প্রধান বিরোধী দল এক্ষেত্রে একই সমতলে। তারা কেউই নতুন প্রজম্মে নিজ প্রতিভার বলে কোন রাজনৈতিক নেতা হতে দেয়নি। তারা নিজ নিজ সংগঠনে তরুণ নেতৃত্ব তৈরি করেছে পছন্দ ভিত্তিক। পছন্দ ভিত্তিক নেতৃত্ব যে আসলে বালির বাধ বা তাসের ঘর তা ইতোমধ্যে প্রমানিত হয়ে গেছে। বর্তমানের তরুণ প্রজম্ম বর্তমান সময়েরই প্রজম্ম; কিন্তু তাদের ভেতর থেকে বর্তমান সময়ের তরুণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব তৈরি হয়নি। যা দেশের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আরেক শূন্যতা। অথচ বর্তমান প্রজম্মের মধ্য দিয়ে সত্যি অর্থে বর্তমান সময়ের উপযোগী মেধা নির্ভর এক ঝাঁক নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেশের জন্যে তৈরি হতে পারতো।

আর এই নতুন রাজনৈতিক নেতৃত্ব যদি দেশের সব দলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকতো তাহলে তারা বুঝতে পারতো সময়ের স্রোতে সমাজ ও মনোজগত সবই বদলে গেছে। আর এ সত্য বুঝলে নিশ্চয়ই নতুন প্রজম্মের মনোজগত যে বদলে গেছে এটা দেশ ও দেশের মানুষকে বোঝানোর জন্য তাদের এত মূল্য দিতে হতো না। সন্তানদের মনকে জানাতে অভিভাবকের কাছে কি তাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হলো না?

লেখক: রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সাংবাদিক, সম্পাদক সারাক্ষণ ও The Present World.

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024