সারাক্ষণ ডেস্ক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
আজ মঙ্গলবার ভোররাতে এক ভিডিও বার্তায় এই চাওয়ার কথা বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ড. ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের রূপরেখা দিচ্ছেন তাঁরা। এ বিষয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে তাঁদের কথা হয়েছে। তিনি ছাত্রজনতার আহ্বানে বাংলাদেশকে রক্ষায় এই গুরুদায়িত্ব নিতে রাজি হয়েছেন।
‘মাগো ভাবনা কেন/আমরা তোমার শান্তি প্রিয় শান্ত ছেলে/ তবু শত্রু এলে অস্ত্র হাতে ধরতে জানি/ তোমার ভয় নেই মা/ আমরা প্রতিবাদ করতে জানি। আমরা হারবো না/ তোমার মাটির একটি কণাও ছাড়ব না/ আমরা পাঁজর দিয়ে দুর্গ ঘাটি গড়তে জানি/ তোমার ভয় নেই মা/ আমরা প্রতিবাদ করতে জানি।’ গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গলায় ও সুরে গাওয়া দেশাত্মবোধক গানটি বাঙালিমাত্রেরই জানা। ১৯৬১ সালে প্রথম প্রচারিত হওয়া এই গানটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের দারুণ অনুপ্রেরণা জুগিয়েছিল।
এবার বাংলাদেশের সর্বস্তরের শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন জুড়েও লাখো কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিল শাশ্বত এই গানটি। কোটা সংস্কারের ন্যায্য দাবি নিয়ে এই আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল গত ৫ জুলাই।
নানা ঘটনা-অঘটন আর হত্যাযজ্ঞ ও রক্ত মাড়িয়ে সরকারের পদত্যাগের চূড়ান্ত এক দফার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের গড়া আন্দোলনটি হয়ে ওঠে গণঅভ্যুত্থান। আন্দোলনের অকুতোভয় সমন্বয়কদের দুর্বার সাহস আর দেশপ্রেমে ভর করে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন সমাজের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার মধ্য দিয়ে পূর্ণ সফলতা অর্জন করে অভূতপূর্ব এই আন্দোলন। হাজারো গুলি, হত্যা, হামলা- মামলা, গ্রেফতার, টিয়ারগ্যাস, রাবার বুলেট, ছররা গুলি আর সাউন্ড গ্রেনেডও পিছু হটাতে পারেনি অধিকার আদায়ের ন্যায্য দাবিতে অটল থাকা শিক্ষার্থীদের। জনতার কাছে তারা পেয়েছেন বীরের মর্যাদা।
সফল এই আন্দোলনে বড় ধরনের বাঁক বদল ঘটে ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনায়। দুই হাত দুই দিকে টান টান প্রসারিত করে বুক পেতে দিয়ে সাঈদ বলেছিল, ‘গুলি আন্দোলনকে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। শিক্ষার্থীদের বিজয়ের প্রতীক হয়ে উঠেছেন আবু সাঈদ।
২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট—টানা প্রায় ১৫ বছর প্রধানমন্ত্রী থাকার পর পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। গতকাল দুপুরে সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে করে দেশ ছাড়েন তিনি। দেশী-বিদেশী আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, শেখ হাসিনার সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানাও দেশ ছেড়েছেন।
বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে দেশী-বিদেশী সংবাদমাধ্যমে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছাড়ার জন্য ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এর পরই তিনি পদত্যাগ করেন। আর দেশ ছাড়ার আগে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ রেকর্ড করতে চেয়েছিলেন। অবশ্য সে সুযোগ তাকে দেয়া হয়নি। পরে তিনি বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে গণভবন ছাড়েন।
একটি সূত্র জানায়, দেশ ছাড়ার আগে শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। কিন্তু তাকে উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশে উড়োজাহাজ পাঠানো সম্ভব নয় বলে জানিয়ে দেয় নরেন্দ্র মোদি সরকার। কারণ হিসেবে বলা হয়, বাংলাদেশের আকাশসীমায় উড়োজাহাজ পাঠালে তাতে আইনের লঙ্ঘন হতে পারে। এরপর সামরিক বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
সরকার পতনের যে এক দফা দাবির মুখে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা ও দেশ ছাড়তে হলো, সেই এক দফার উৎপত্তি কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে। সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার দাবিতে ওই আন্দোলন দানা বাঁধা শুরু করে গত মাসের শুরুর দিকে। সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে কোটা সংস্কারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দাবি জানায় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এর মধ্যে ১৫ জুলাই আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা শুরু হয়। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলার অভিযোগ ওঠে পুলিশসহ ক্ষমতাসীন দল ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। হামলায় আহত হন তিন শতাধিক। পরের দিন (১৬ জুলাই) ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রংপুরে ছয়জনের মৃত্যু হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বন্ধ ঘোষণা করা হয় দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কিন্তু সহিংসতার তীব্রতা ও ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। ১৮ জুলাই সারা দেশে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’ কর্মসূচি দেন আন্দোলনকারীরা। এদিন মৃত্যু হয় ২১ জনের। সর্বোচ্চ প্রাণহানি ঘটে ১৯ জুলাই, এদিন মৃত্যু হয় ৫৮ জনের। এর মধ্যে রাজধানীতেই প্রাণ হারান ৪৯ জন।
উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ২০ জুলাই অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়। সারা দেশে মোতায়েন করা হয় ২৭ হাজার সেনা। অন্যদিকে আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতার অভিযোগে সরকারের পক্ষ থেকে দেশজুড়ে শত শত মামলা করা হয়। এসব মামলায় হাজার হাজার মানুষকে বিনা অপরাধে গ্রেফতারের অভিযোগ ওঠে সরকারের বিরুদ্ধে। একই সঙ্গে দাবি ওঠে আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সহিংসতায় নিহতদের মৃত্যুর বিচার অবিলম্বে করতে হবে।
কারফিউ জারি ও সেনা মোতায়েনের পর প্রাণহানি অল্প সময়ের মধ্যে শূন্যে নেমে আসে। কারফিউ আংশিক শিথিল করা হয়। আন্দোলনও চলতে থাকে। কিন্তু ২ আগস্ট আবার আন্দোলন ঘিরে প্রাণ ঝরে। এদিন খুলনায় এক পুলিশ সদস্য ও হবিগঞ্জে এক যুবকের মৃত্যু হয়। ৩ আগস্ট বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিন সরকার পতনের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারীরা। এ দাবি আদায়ে ৪ আগস্ট অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। একই দিন মাঠে নামে আওয়ামী লীগও। এদিন ভয়ংকর রূপ নেয় দেশের পরিস্থিতি, মৃত্যু হয় শতাধিক মানুষের। পরের দিন (৫ আগস্ট) ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচি দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিন কারফিউ অমান্য করে সরকার পতনের দাবিতে রাজপথে নেমে আসে লাখো জনতা। এর মধ্যে দুপুরের পর খবর আসে, পদত্যাগ করে সামরিক হেলিকপ্টারে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা।
সোমবারও দেশব্যাপী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়েছে। এ ছাড়া দুপুরের পর বিক্ষুব্ধ জনতার গণপিটুনিতে ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সারা দেশে গতকাল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুলিতে ও জনতার গণপিটুনিতে ১১২ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে রাজধানীতে ৪৯ জন ও বিভিন্ন জেলায় ৬৩ জন রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে হবিগঞ্জে ৬, রাজশাহীতে ৬, কুষ্টিয়ায় ৭, চুয়াডাঙ্গায় ৪, যশোরে ৮, মানিকগঞ্জে ২, শ্রীপুরে ৬, সাভারে ৯, বরিশালে ৩, কুমিল্লায় ২, লোহাগড়ায় ২, ঝিনাইদহে ৪, চাঁদপুরে ২, কয়রাতে ১ ও সুনামগঞ্জে ১ জন রয়েছেন।
এদিকে শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে গতকাল দুপুর পর্যন্ত রাজধানীর শনিরআখড়া, কাজলা, রায়েরবাগ, যাত্রাবাড়ী, শহীদ মিনার, চানখাঁরপুলসহ বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার সংঘর্ষ হয়েছে। এসব ঘটনায় অন্তত ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের ৪০ জনের লাশ ঢাকা মেডিকেলে ছিল। উত্তরার ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ৯ জনের লাশ ছিল।
একদফা দাবিকে ঘিরে গতকাল সকাল থেকেই রাজধানী জুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছিল।
ঢাকার প্রতিটি রাস্তা ছিল সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের দখলে। নিজেদের দাবি আদায় ও অসহযোগ আন্দোলন পালনে সেই কারফিউ’র মধ্যেই গতকাল সকাল দশটার পর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় জড়ো হতে শুরু করে কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফরম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র ও সাধারণ জনগণ। আন্দোলনকারীরা এসময় রাস্তায় একত্রিত হয়ে স্লোগান দিয়ে সামনে এগুতে শুরু করলে তাদেরকে লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেট ও টিয়ারশেল ছুড়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। আন্দোলনকারীরা এসময় দৌড়ে আশপাশের গলি ও রাস্তায় ঢুকে পড়ে। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। এসময় আন্দোলনকারীদের ঠেকাতে একের পর এক গুলি ছোড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। সকাল থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত চলা সংঘর্ষে এলাকাটিতে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৭ জন নিহতসহ অর্ধশত মানুষ আহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন- যাত্রাবাড়ী এলাকায় রাসেল (২৮), সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিব হোসেন (২৪), তুলারাম কলেজের শিক্ষার্থী আব্দুর রহমান (২২), সাইফুল ইসলাম তন্ময় (২২), প্রবাসী আবু ইসহাক (৫২) ও আজমত মিয়া (৪০)। বাকি ২৭ বছর বয়সী এক যুবকের পরিচয় জানা যায়নি।
এদিকে নিজেদের কর্মসূচি পালনে গতকাল সকাল দশটার দিকে শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান নেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কিছু সদস্য। এসময় পুলিশ তাদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। এ সময় শিক্ষার্থীরাও পুলিশ সদস্যদের লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছোড়ে। দু’পক্ষের সংঘর্ষের এক পর্যায়ে শিক্ষার্থীরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে দিয়ে চানখাঁরপুল এলাকায় অবস্থান নেয়। ঘণ্টা তিনেক চলা সংঘর্ষে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি চালানো হয়। এসময় ঢামেকের নতুন বিল্ডিংয়ের সামনের রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়ে যমুনা ব্যাংকের স্টাফ মানিক মিয়া (২৭) ও অজ্ঞাত এক যুবক (২৫)-এর মৃত্যু হয়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত আরও অনেকে।
Leave a Reply