শ্রী নিখিলনাথ রায়
খোশবাগ
শ্মশান মুর্শিদাবাদের পরিচয় দিবার জন্য কেবল দুই একটি সমাধি- ক্ষেত্র নগরের কোলাহল হইতে দূরে বিক্ষিপ্ত হইয়া বৃক্ষরাজির স্নিগ্ধচ্ছায়ায় অম্লাপি বিরাজ করিতেছে। সমাধিব্যতীত আর কিছুতেই মুর্শিদাবাদের পরিচয় পাওয়ার সম্ভাবনা নাই। মুর্শিদকুলী বল, আলিবর্দ্দদী বল, সিরাজ বল, কাহারও কোন সুস্পষ্ট চিহ্ন মুর্শিদাবাদে দেখিতে পাইবে না; কেবল তাঁহারাই সেই শ্মশানক্ষেত্রের এক এক স্থানে শায়িত হইয়া, আপনাদিগের পরিচয় আপনারাই প্রদান করিতেছেন। কিন্তু নীরব, নির্জন সমাধি-উদ্যানের নিবিড় বৃক্ষচ্ছায়া তাঁহাদিগকে এরূপ ভাবে আবৃত করিয়া রাখিয়াছে যে, সহসা তাঁহাদিগকে দৃষ্টিপথের পথিক হইতে দেখা যায় না।
তাঁহাদিগের নাম ও গৌরব যেমন দিন দিন কাহিনীতে পর্যবসিত হইতেছে, তাঁহারাও সেইরূপ ক্রমে ক্রমে বৃক্ষচ্ছায়ার অন্ধকারে মিশিয়া যাইতেছেন। প্রভাতে ও সায়াহ্নে কেবল পক্ষিগণ বৃক্ষশাখায় বসিয়া কলধ্বনিতে সমাহিত ব্যক্তিদিগকে সাদর- সম্ভাষণ করিয়া থাকে এবং যদি কখনও কোন সহৃদয় দর্শন-কৌতূহল- পরবশ হইয়া তাঁহাদের অন্ধকারময় প্রকোষ্ঠে উপস্থিত হন, তিনি উজানস্থিত কুহমেরক্ষের নিকট হইতে চই চারিটি কুসুম প্রার্থনা করিল, সমাধির উপর নিক্ষেপ করিয়া চলিয়া যান। আমরা মুর্শিদাবাদের অধীশ্বর। গণের ইতা অপেক্ষা অধিকতর অপর কোন সম্মানের বিষয় অবগত নহি।
যাঁহাদের নামই একরূপ বিলুপ্ত হইতে বসিয়াছে, তাঁহাদের প্রতি অধিক সম্মান প্রদর্শনের প্রয়োজন কি? মৃত ব্যক্তির আত্মা শান্তিপিপাসু। ঘেঁষে স্বানে তাঁহাদের দেহ সমাহিত আছে, প্রকৃতি সেই সেই স্থানকে বেশোন্তিময় করিয়া রাখিয়াছেন। প্রকৃতিই তাঁহাদিগকে পবিত্র ও হিগ্ধ শাস্তি প্রদান করুন, তাঁহারা কৃত্রিম সম্মানের প্রার্থী নহেন। সুখের বিষয়, মুর্শিদাবাদে যে কয়েকটি সমাধিভবন আছে, প্রায় সকলগুলিই নির্জন ও শান্তিময়।
মুর্শিদাবাদ হইতে দক্ষিণ দিকে ভাগীরথী বাহিয়া গমন করিতে হইলে, লালবাগ নামক স্থানের কিছু দক্ষিণে, ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে একটি প্রাচীরবেষ্টিত উদ্যানবাটিকা নয়নপথে পতিত হইয়া থাকে। এই উত্থানবাটিকা একটি সমাধিভবন। যেস্থানে সমাধিভবনটি অবস্থিত, তাহাকে সাধারণতঃ লোকে খোহাগ কহে। এই খোশ বাগের সমাধি- ভবনে নবাব আলিবন্দী খাঁ ও হতভাগ্য সিরাজ চিরনিদ্রায় অভিভূত। রহিয়াছেন।
Leave a Reply