পিওতর মান্তেইফেল
চিত্তাকর্ষক জীবন
মস্কো চিড়িয়াখানার তিনজন তরুণ জীববিদের সঙ্গে সাইবেরিয়া ভ্রমণকালে একবার পৌঁছই ইয়েনিসেই নদীর দক্ষিণ উপনদী কান- এর তীরে।
আমরা প্রথমে নৌকো করে যাই, তারপর দিগন্ত-জোড়া মাঠ দিয়ে হাঁটি, শেষে পৌঁছই পাহাড়ে খাদে, আগেকার শান্ত চওড়া কান তখন তার মাঝখানে দিয়ে ছুটছিল উদ্দাম বেগে। পাহাড়ে আমাদের আগ্রহ ছিল ছোটো ছোটো এক ধরনের তীক্ষা-দন্ত প্রাণী নিয়ে বলা হয় এদের ‘আলতাই পিচুখা’, কিংবা ‘সেনোন্তাঙ্কা’, বা বিচালি-বানিয়ে। আকারে তা ধেড়ে ই’দুরের চেয়ে বড়ো নয়, তবে জাতে বরং খরগোসের কাছাকাছি। এদেরও একইরকম রোমশ থাবা এবং ওপরকার সামনের কর্তনদন্ত দুই সারিতে। শুধু কানগুলো লম্বা নয়, আর লেজ নেই একেবারেই।
শরতে কান-নদীর কাছাকাছি পাহাড়ে আমরা সেনোন্তাঙ্কাদের পুরো একটা উপনিবেশ আবিষ্কার করলাম- শীতের জন্যে বিচালি তৈরি করছিল তারা। ঘাসের শাঁস বা ঝোপঝাড়ের ডাল দাঁত দিয়ে কেটে রোদে শুকাবার জন্যে সযত্নে তা বিছিয়ে রাখছিল পাথরগুলোর মাঝে তাদের বিবরের সামনে। তৈরি বিচালি তারা নিয়ে যাচ্ছিল একটা আধা-ঝুলন্ত পাথরের তলে এবং ঠেসে সেখানে বোঝাই করছিল।
শীতের জন্যে সেনোস্তাঙ্কারা যে খাদ্য জমাচ্ছিল সেটা আমরা দেখলাম। আশ্চর্য তা রকমারি, আর পুষ্টির দিক থেকে দামী। পাথরের নিচে বিচালি গাদাটায় ছিল প্রোটিন-সমৃদ্ধ বরবটিজাতীয় শস্য এবং আরো এমন নানা উদ্ভিদ যাতে ভিটামিন, স্নেহপদার্থ, কার্বো-হাইডেট ও ভেষজদ্রব্য কিছুরই অভাব হবে না এই উদ্যোগী প্রাণীগুলোর।
হঠাৎ শারদীয় মেঘ এসে বৃষ্টি পড়তে শুরু করতেই এদের মধ্যে কী রকম হলস্থূল পড়ে গেল, দেখতে বেশ মজা লাগছিল। তাড়াতাড়ি করে আধ-শুকনো ডাঁটিগুলো মুখে নিয়ে তারা তা লুকিয়ে রাখলে কোনো একটা আড়ালে। মনে হবে ছোট্ট এই মেহনতীরা বুঝি চিন্তা করতে পারে। তবে ব্যাপারটা মোটেই তা নয়। এ হল বাইরের উত্তেজনায় জন্মগত রিফ্লেক্স বা প্রতিবর্ত ক্রিয়া।
শীতের জন্যে খাদ্য নষ্ট হয় বৃষ্টিতে। অস্তিত্বের কঠোর সংগ্রামের বহু, হাজার বছর ধরে সে বৃষ্টি সেনোন্তাকাদের কাছে হয়ে দাঁড়িয়েছে সর্বনাশের একটা সংকেত। সেটা তাদের তরফ থেকে প্রাণধারণের পক্ষে হিতকর একটা কর্মপ্রেরণা জাগায়; যথা, মাটিতে বৃষ্টি পড়লে খাবার লুকিয়ে রাখতে হয়। যেসব প্রাণী তা করে নি, তারা শীতে খিদেয় ভুগেছে, মারা গেছে অনেকে। যারা সবচেয়ে বেশি খাপ খাইয়ে নিতে পেরেছে, টিকে থেকেছে কেবল তারাই।
তাইগায়, অর্থাৎ উত্তরের ঘন অরণ্য এলাকায় আমাদের সঙ্গে দেখা করে বুড়ো জেলে মাতৃভেই গ্রিগোরিয়েভিচ গলোভঙ্কভ চমৎকার শিকারী, চিন্তাশীল প্রকৃতিবিদ। আমাদের বললে যে শীতে যখন খুব গভীর হয়ে বরফ পড়ে, তখন সেনোন্তাকাদের বসতিতে এসে হামলা করে মারাল হরিণ আর পাহাড়ী আরখার ভেড়া। আধঝুলন্ত পাথরের তলে জমানো, তুষার পাত থেকে রক্ষিত বিচালিগুলো তারা খেয়ে ফেলে, বেচারি জীবগুলোকে উপোস দিতে হয়। সেবল বা এরমিনজাতীয় নেউলেরাও থাকে সেনোন্তাকাদের এলাকাতেই, কিন্তু ক্ষতি করে অনেক কম, শুধু শিকারের উত্তেজনায় শিকার করে না; পেট ভরা থাকলে শান্তভাবে চলে যায়, ছোঁয় না এই দস্তুরদের। তাছাড়া একই শিকার ক্ষেত্রে পরস্পরকে সইতে পারে না এরা। সেবলরা যদি এখানে ডেরা পাতে, তাহলে এরমিন বা কলিনস্কি কেউ আসবে না, কেননা সেবল তাড়া করে তাদের। কলিনস্কি যদি আসে, তাহলে ক্ষিপ্র আর ধূর্ত এরমিনদের তাড়িয়ে দেয় তারা। আর এই এরমিনরাই হল সেনোস্তাস্কাদের পক্ষে সবচেয়ে বিপজ্জনক; যেসব গর্তে সেনোস্তাস্কারা থাকতে পারে সেসব জায়গায় ঢোকে তারা। জেলেটি খুব নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করেছে, প্রকৃতিকে জানে ভালো। বললে, একবার একটা জুনিপার ঝোপে সে দেখেছিল বাদামী পে’চা, তার দিকে তাকিয়ে আছে। মাভেই গ্রিগোরিয়েভিচ সন্তর্পণে ঝোপটা ঘুরে যায়। পে’চাটাও তার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে মাথাটা ঘোরায় প্রায় পুরো এক চক্রেরও বেশি। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলে: ‘এসব পাখির গলায় হাড় আছে, নাকি মাথাটা ঘোরে কেবল চামড়ার ওপর? পে’চাটা যখন উড়তে উড়তে মাথা ঘোরাতে লাগল, তখন গাছের সঙ্গে ধাক্কা লাগল না কেন?’
আমি বললাম, এমনিতেই পাখিদের গলা খুব নমনীয়, পে’চাদের বিশেষ করে। আমার কৌতূহলী সহালাপীকে বোঝালাম যে মানুষের বা অন্য স্তন্যপায়ীদের মতো দুটি নয়, একটি কন্দ জয়েন্টে পাখিদের মাথা থাকে গলার সঙ্গে জোড়া। তাছাড়া পাখিদের গলার এক-একটা অস্থিগ্রন্থি খুবই মুচড়ে যেতে পারে।
বৃদ্ধ আমাদের একটা পাহাড় দেখালে, আমাদের আসার কিছু আগে এখানে লড়াই বেধেছিল দুই প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বাদামী ভালুকের মধ্যে। সে বললে, যাকে নিয়ে লড়াইটা সেই ভল্লুকী শান্তভাবে বসেছিল দূরে, ওদের দিকে ভ্রুক্ষেপও করছিল না। দুই দৈত্যের গর্জন, রোমশ দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর পারস্পরিক আঘাত কিছুই যেন নজরে পড়ছিল না তার। খুব একটা মোক্ষম চাপড় খেয়ে অপেক্ষাকৃত কমজোরীটা খাদের নিচে পড়ে যায়। পাহাড়ের খাড়াই গা বেয়ে অনেকখন ধরে গড়ায় সে, একগাদা পাথর খসে পড়ে তার সঙ্গে। পাহাড়ের কানা থেকে বিজয়ী লক্ষ্য করছিল তাকে। নিচে পরাজিত প্রতিদ্বন্দ্বী খাড়া হয়ে করুণভাবে তাকায় ওপরে। তারপর কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে টলতে টলতে পালায়।
জিজ্ঞেস করলাম, ‘গর্জ’ন করছিল খুব জোরে?’
পাছে উত্তরটা সঠিক না হয় এই আশঙ্কায় খানিকটা ভেবে শিকারী বললে: ‘তা বেশ জোরেই।’
কান-নদীর তাঁর থেকে অল্প দূরে ঢালুর চুড়োয় ছিল তার ছাউনি। এখানে একটা অপ্রত্যাশিত সাক্ষাৎকার ঘটে তার, শিগগির সেটা সে ভুলবে না। ছাউনিতে ঢোকায় মুখে ধুনি জ্বলছিল, সেটা ঠিক করার জন্যে বৃদ্ধ বেরিয়ে আসে রাত্রে। কাঠ ছিল কম, কাঠ কুড়োবার জন্যে বনে যায় সে। একগাদা কাঠ নিয়ে ফেরার সময় অন্ধকারে অনুচ্চ ফার বন থেকে বেরিয়ে আসে একটা কালচে মূর্তি’। ‘নিশ্চয় এক হরিণ,’ ভেবে মাভেই গ্রিগোরিয়েভিচ ভালো মনেই হুমকি দেয় অনাহৃত অতিথিকে। অমনি জন্তুটা তার সামনের দুই থাবা দিয়ে চেপে ধরে বুড়োকে। মস্তো একটা ভালুক সেটা। ভাগ্যি ভালো যে শিকারীর হাতে ছিল গাদাখানেক কাঠ, নইলে অমন আলিঙ্গন থেকে তাকে বাঁচতে হত না।
প্রথম ধাক্কাতেই ভারসাম্য হারিয়ে মানুষ আর জন্তু দুজনেই ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গিয়ে পড়ে নদীর খর স্রোতে। কেবল জলের তলে গিয়েই ভালুক তার শিকারকে ছেড়ে দেয় এবং মূহূর্তের মধ্যেই সে ভেসে যায় দূরে। শিকারী জলের তলের একটা খোঁটা অআঁকড়ে সাবধানে নাকটা বাড়িয়ে দেয় জলের ওপর। তিন-চার মিটার স্রোতে ভেসে গিয়ে ভালুকটাও একটা পাথর চেপে ধরে। জলের ওপর দেখা গেল তার মাথা আর ঘাড়। চারিদিকে তীক্ষ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলে ভালুক- মানুষটা ভেসে উঠছে নাকি? তারপর ধীরে ধীরে সে তীরে ওঠে; লোম থেকে অঝোরে জল গড়াচ্ছিল। পেছনের পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে সে চারিদিকে নাক ঘোরায়, শব্দ করে নিঃশ্বাস টানে, কিন্তু মানুষের গন্ধ টের পায় না। ওপরে উঠে ভালুক শিকারীর পুরনো পথচিহ্ন ধরে বনে ঢোকে।
ঝোপে সে অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত শিকারী মিনিট দুয়েক সবুর ক’রে সন্তর্পণে গিয়ে ওঠে তার ছাউনিতে। বন্দুকটা নিয়ে সে আলোকিত সুবিধামতো একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে লড়াইয়ে ডাকতে থাকে ভালুকটাকে, চুটিয়ে তাকে গালাগালি দেয়।
‘কিন্তু কী সেয়ানা, হতভাগা জানোয়ারটা!’ উপসংহারে বললে মাতৃভেই গ্রিগোরিয়েভিচ। ‘কিছুতেই এল না শালা। ওদিকে, অন্ধকারে ঝোপের আড়াল থেকে হামলা- ওটা কি একটা কথা হল?’
ঘটনাটায় আমার তরুণ সহযাত্রীরা আকৃষ্ট হল। বললাম, সব ভালুকই যে মানুষকে আক্রমণ করে, তা মোটেই নয়। বরং ও রকম ভালুক দেখা যায় খুবই কম। সাধারণত ভালুকেরা খুব সতর্ক’, মানুষ দেখলে অলক্ষ্যে লুকিয়ে পড়ার চেষ্টা করে। নদী বরাবর এগিয়ে যাবার সময় আমরা তাঁরে প্রায়ই দেখেছি স্টেরলেট মাছের মাথা। এগুলো হল ভোঁদড়ের খাদ্যের অবশেষ। এ জন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু অংশেই খুব কম দেখা যায়, শিকারীরা মেরে ফেলেছে।
আমাদের মৎস্যশিকারীটির কাছে ভোঁদড় খুবই আদরণীয়, প্রায় তার সহযোগী। ব্যাপারটা হল এই শীতে স্টেরলেটরা গভীর গর্তের মধ্যে ঢুকে ঝাঁক বেঁধে থাকে। ভোঁদড় চট করেই স্টেরলেটদের এই সব ডেরা বার করতে পারে। তাঁরে ঝোপঝাড়ের কাছে সাময়িক গর্ত খোঁড়ে সে। ভোঁদড়ের চিহ্ন ধরে মার্ভেই গ্রিগোরিয়েভিচ নির্ভুল-ভাবে টের পায় ঠিক কোন জায়গায় স্টেরলেট ধরতে হবে।
এক জায়গায় মাছ ফুরিয়ে গেলে ভোঁদড় চলে যায় অন্য আরেকটা জায়গায়। মাতৃতেই গ্রিগোরিয়েভিচও তার চিহ্ন অনুসরণ করে তার সন্ধান পায় কাছেই দ্বিতীয় আরেকটা স্টেরলেট ডেরার।
‘শীতকালে তাইগার নদীতে এই জন্তুগুলোর জন্যে মন ভালো থাকে,’ বললে মাতৃভেই গ্রিগোরিয়েভিচ। ‘মনে হয় যেন একলা নই, কাছেই আরেকজন জেলে আছে…’
এই সময় উইলো গাছের ডালে দেখা গেল মরকত-শ্যাম একটি পাখি মাছরাঙা। বুড়ো জেলে তাকে বলে স্রেফ নাঁল চড়ুই।
পাখিটার দিকে সোহাগ করে তাকিয়ে সে বললে, ‘এ পাখিটাকে ভারি ভালোবাসি। নীল চড়ই আমাদের এখানে উড়ে আসে বসন্তে, নদীর খাড়াই পাড়ে
ঠোঁট দিয়ে গর্ত খাঁড়ে ডিম পাড়ে। ছানাদের খাওয়ায় মাছ। তাই আমিও জেলে, নীল চড়ুইও জেলে; আমি সততার সঙ্গে খেটে মাছ ধরি, সেও তো চুরি করে না।’
মাছরাঙা কেমন পাশকে ভঙ্গিতে তাকিয়ে ছিল জলের দিকে, থেকে থেকেই গলা নাড়াচ্ছিল, যেন কোনো কড়া ইস্তিকরা উচু কলারে তার অসুবিধা হচ্ছে। এক মিনিট পরেই নদীতে ছলাৎ শব্দ উঠল, জলের মধ্যে তলিয়ে গেল পাখিটা। জলের বৃত্তগুলো সরে যাবার পর দেখলাম, পাখিটা তার সবুজ ডানা দিয়ে খাশা জল কাটছে। সেকেন্ড তিনেক বাদেই মাছরাঙা ঠোঁটে মাছ নিয়ে জল থেকে খলবলিয়ে উঠে ফিরে এল তার ডালটায়, বারকয়েক ডালে ঘা মারলে মাছটা দিয়ে। মাছটার ছটফটানি থেমে গেল। শক্ত করে ঠোঁটে মাছটা চেপে পাখিটা শনশনিয়ে উড়ে গেল জলের ওপর দিয়ে তার বাসার দিকে। নদীর আঁকাবাঁকা অনুসরণ করে উড়ছিল ডানাওয়ালা ‘জেলে’, শিগগিরই তা বাঁকের আড়ালে অদৃশ্য হল।
কিছুক্ষণ পরে মাছরাঙা ফের এসে বসল তার চৌকিদারী ডালে।
‘একা-একা যাতে না লাগে, তাই আমি আমার এই বন্ধুর জন্যে তাঁরে একটা কাঠি পুতে দিয়েছি,’ বললে মার্ভেই গ্রিগোরিয়েভিচ। ‘অবিশ্যি নদীতে ডাল অনেক, কিন্তু মাছ ধরার পক্ষে যুতসই হবে, তেমন কাঠি কম। না ভেবে-চিন্তে কাঠি পুতলে সেখানে যদি মাছ বেশিও থাকে, তাহলেও বন্ধু নীল পাখিটি উপোস দিতে পারে। সরু ডাল থেকে জলে ছোঁ মারায় অসুবিধা হয় পাখির সরু ডাল হলে তার ‘উল্টো ঘাই’টা হয় প্রচণ্ড, তাই জলে শিকার ফসকে যায়। কড়া ডালও কাজ দেয় না। সামান্য একটু উল্টো ঘাইয়ে নীল চড়ুই অভ্যস্ত। তাই সবকিছু হওয়া চাই যুতসই… ছোটো ছোটো মাছগুলোর জন্যে আমি জলে শুকনো পাঁউরুটির টুকরো ছড়িয়ে দিই।’
তখনই আমার বোধগম্য হল, কেন মাছরাঙাটা মাছের ওপর নজর রাখে কেবল একই ডাল থেকে, কেন এইসব ‘যুতসই’ আর ‘উল্টো ঘাই’ ইত্যাদির কথা বলছে বুড়ো। প্রকৃতিকে ভালোই লক্ষ্য করেছে সে। মাছরাঙা শুধু সেই ডালই ভালোবাসে যার স্থিতিস্থাপকতা খুব বেশিও নয়, কমও নয়, অর্থাৎ যা দিয়ে স্প্রিং-বোর্ডের কাজ হবে। এই রকম স্প্রিং-বোর্ড’ থেকে লাফ দিয়ে পাখি শিকার ধরতে পারে সুনিশ্চিত। ‘হ্যাঁ, নীল চড়ুইকে ভালোবাসি আমি,’ ফের বললে বুড়ো। ‘এই ডোরাকাটা চোর বুরুন্দুকটার মতো নয়- এটা তক্কে তক্কে থাকে কী করে কিছু খাবার জিনিস
চুরি করে লুকিয়ে রাখবে নিজের গর্তে’। ওইতো এখন ওরা চ্যাঁচাচ্ছে ‘এম-এম’।
কারণ কী জানেন? ‘কারণ শুখা পাঁউরুটির থলেটা আমি সরু সুতোয় টাঙিয়ে রেখেছি একটা ফে’কড়িতে। এর আগে একদিনের জন্যে ছাউনি ছেড়ে যাই। বুরুন্দুকরা ঠিক গন্ধ পেয়ে যায় কী আছে থলিতে, কামড়ে ফুটো করে তাতে। টুকরো টুকরো রুটি থাবা দিয়ে মুখে পুরে ফোলা গালে ছুটে যায় নিজেদের গর্তে। থলে ছিল টায়-টায় ভরা, ফিরে দেখি ঠন-ঠন করছে; ডোরাকাটা পরগাছাগুলো মেরে দিয়েছিল অনেক! আর এখন গোটা ত্রিশেক বুরুন্দুক জুটেছে থলের নিচে, তাকিয়ে দেখছে, কিন্তু নাগাল পাচ্ছে না।’
মাতৃভেই গ্রিগোরিয়েভিচ একটুখানি থামল, কান পেতে শুনে ফের শুরু করল।
‘কতকগুলো অনেক ঘোরাঘুরি করে, কোনো ফয়দা হল না দেখে পালিয়ে গিয়ে এখন চে’চাচ্ছে ‘ক্রম-ক্রম’। ওই ওদের এক স্বভাব বাজ ডাকল, কি কেউ বন্দুক ছাড়লে, কিংবা কোনো একটা দুর্বিপাক ঘটল, অমনি বুরুন্দুকেরা ভান করে যেন কত কণ্ঠ, গাছের গুড়ির ওপর বসে মাথা চেপে ধরে করুণ স্বরে ডাকে ‘এম-এম’… এখন ওদের বিপদ এই যে মুফতে পাওয়া খাবার গেছে ফুরিয়ে, ফের আবার তাইগা ছুঁড়ে নিজেদেরই জোটাতে হবে।’
একটু চুপ করে থেমে ছেলেদের সে জিজ্ঞেস করল:
‘আচ্ছা, তোমরা তো বিজ্ঞানী, দহে পড়ার আগে অল্প জলে নৌকোটা আটকে রাখার জন্যে দু’মনী পাথর চাপাতে পারবে নৌকোয়? কেননা স্টেরলেট মাছ থাকে কেবল সেইসব জায়গায়।’
ওদের জবাব শুনে সে কেবল হাসল, বলল:
‘তলিয়ে যাবে!’
‘আর, তুমি, আলেক্সান্দ্রভিচ,’ আমায় সে জিজ্ঞেস করলে। ‘তোমার তো সবই জানা।’
বললাম, ‘এখনো ও কাজ করার সুযোগ হয় নি, তবে দরকার পড়লে চাপাব। জলে পাথরের জোর নেই, হ্যাঁচকা টান মারলে আপনিই তা চট করে উঠে আসবে, থামতে না দিলে এমনিতেই তা জাড্যের তাড়নায় জলের ওপরে ভেসে উঠবে। শুধু নৌকার কানা পেরিয়ে চাপিয়ে দিলেই হল, সঙ্গে সঙ্গেই দাঁড় নিয়ে স্রোতের দিকে নৌকোর মুখ ফেরাতে হবে।’
ভাঁত মুখে মাতৃভেই গ্রিগোরিয়েভিচ চাইল আমার দিকে, সশঙ্কে জিজ্ঞেস করল:
‘কে তোমায় বলেছে বলো তো?’
বললাম, ‘আর্কিমিডিস।’
‘কোথায় থাকে সে?’
‘মারা গেছে।’
‘শুধু তোমায় বলেছে, নাকি সবাইকে? এটা যে আমাদের বংশের গুপ্ত কথা, ঠাকুর্দার বাবার কাছ থেকে তা চলে আসছে। তাই আমি ছাড়া কান-নদীতে স্টেরলেট মাছ ধরতে পারে না আর কেউ।’
বললাম যে আর্কিমিডিস সে কথা লিখে গেছেন পদার্থবিদ্যার পাঠ্যপুস্তকে (আপেক্ষিক গুরুত্ব), তবে তাদের গ্রামে নিশ্চয় খবরটা পৌঁছয় নি।
‘যখন কান ছেড়ে ইয়েনিসেই নদীতে যাবে, কাউকে আর্কিমিডিসের কথাটা বলো না কিন্তু, নইলে নদীতে আর স্টেরলেট মাছ মিলবে না! কিন্তু কে ওকে
শেখাল?’
বললাম, ‘নিজেই মাথা খাটিয়ে বার করেছে।’
ধুনির কাছে বুড়ো অনেকখন বসে রইল। মাথা নেড়ে বললে:
লোকটার মাথা আছে বটে, পরিষ্কার!.. কী যেন নাম?’
‘আর্কিমিডিস,’ বললে ছেলেরা।
বিদায় নেবার সময় মন ভার হয়ে গেল তার।
‘শহর থেকে ইচ্ছে করে তাইগায় আসছে, তোমাদের মতো তেমন লোক আমি দেখি নি। তোমাদের ছাড়া একা-একা আমার খারাপ লাগবে। অথচ আগে কখনো এমন হয় নি।’
আর সত্যিই, পরের দিন সে এসে আমাদের সঙ্গ ধরল।
Leave a Reply