বাংলা সাংবাদিকতার অন্যতম পথিকৃত, নিজস্ব ধারার সাহিত্যিক, রাজনীতি ও চিন্তাবিদ আবুল মনসুর আহমদের আজ জন্মদিন।
তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে নতুন প্রজন্মের জন্যে এবং যারা আগে পড়েছেন তাঁরাও যাতে আরেকবার পড়ে নতুন করে একটা ছবি দেখতে পান সেজন্য তাঁর বিখ্যাত রম্য রচনা “ফুড কনফারেন্স” প্রকাশ করা হলো। সারাক্ষণ মনে করে এটাই তাঁর প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা নিবেদন।
– সম্পাদক
এক
দেশে হাহাকার পড়েছে; কারণ নাকি খোরাকির অভাব। সে হাহাকার অবশ্যি ভদ্রলোকেরা শুনতে পাননি। ভাগ্যিস অভুক্ত হতভাগাদের গলায় চিৎকার করে কাঁদবার শক্তি নেই।
কিন্তু অভুক্ত কঙ্কালসার আধ-ল্যাংটা হাজার হাজার নর-নারী প্রাসাধশোভিত রাজধানীর রাস্তাঘাটে ক্যতার করছে। তাতে রাস্তায় সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এইসব রাস্তায় আগে আগে গাউন শাড়ি পরা পরীর ভিড় হতো। আর আজ কিনা সেখানে অসুন্দর অসভ্য কুৎসিত অধোলঙ্গ শত্রীলোকেরা ভিড় করছে। কি অন্যায়।
ভদ্রলোকেরা এটাও বরদাশত করতেন। কিন্তু যুদ্ধের জন্য পেট্রলের অভাব হওয়ায় অনেক ভদ্রলোককে ট্রামে চড়তে হচ্ছে। ট্রামে অসম্ভব ভিড় হওয়ায় অনেক ভদ্রলোককে ফুটপাথেও চলতে হচ্ছে। এইসব অনুক্ত কুৎসিত দুর্গন্ধময় অসভ্য লোক ভদ্র লোকদের চলাফেরার ব্যাঘাত জন্মাচ্ছে। রাস্তায় চলতে গেলে এইসব ময়লা কুৎসিত লোকের গা ঘেঁষে চলতে হয়। আর চলবারই কি জো আছে? কি দুর্গন্ধ। হতভাগারা ডাস্টবিনে খোরাকির তালাশ করতে গিয়ে হাতাহাতি মারামারি করে মরছে মরুক। কিন্তু ডাস্টবিনের ময়লা ছড়িয়ে রাস্তাঘাট বিচ্ছিরি ও নোংরা করবার অধিকার তাদের কে দিয়েছে?
শুধু কি তাই? হতভাগারা কি মরবার আর জায়গা পায় নি? মরবে কি ভদ্রলোকদের প্রাসাদের দরজায়? কি মুসকিল? মড়া লাশের জ্বালায় ঘর থেকে কি বেরুবার উপায় আছে? বাজার থেকে একটু চিনি-কলা মিঠাই কিনে রওয়ানা হয়েছে ত আর রক্ষে নেই। হতভাগারা ছোঁ মেরে কেড়ে নেয় না বটে, কিন্তু যেভাবে দলে-দলে “বাবু ভিক্ষে দাও” বলে চারিদিকে ভিড় করে তাতে ভয় হবার কথা নয়? যদিই বা বেটারা কখন গায়ে হাত দিয়ে বসে।
কোথাও মোটর বা ট্রাম থামলে চারদিকে হতভাগা ও হতভাগিনীরা যেভাবে গা’র উপর পড়ে “ভিক্ষে দাও” বলে জ্বালাতন করে, তাতে একেবারে ঘেন্না ধরে যায়। কি উৎপাত।
অতএব ভদ্রলোকেরা পড়েছেন বিষম বিপদে। অফিসে-আদালতে থিয়েটারে-
বায়োস্কোপে স্বাধীনভাবে চলাফেরা একরূপ অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
কাজেই এর প্রতিকারের জন্য একটা কিছু করতেই হবে। সেটা কি?
ভদ্রলোকেরা বরাবর যা করে থাকেন, তাই। করাও হল তা। অর্থাৎ সভা ডাকা হল। এ দেশে দেশদ্রোহীরাও দেশোদ্ধারের জন্য স্বাধীনতা-সম্মিলনী ডাকেন; দজ্জাল স্বামীরাও নারীরক্ষার জন্য নারীসম্মিলনীতে সমবেত হন; চামড়ার বেপারিরাই গো-হত্যা বন্ধের জন্য কাউ-কনফারেন্সের প্রধান উদ্যোক্তা। এতসব দেশের বড়লোকেরা অন্নহীনদের বাঁচাবার জন্য ফুড কনফারেন্সের আয়োজন করলেন।
দুই
কনফারেন্স বসল টাউনহলে। ঘোড়দৌড়ের মাঠ থেকে মেট্রোলাইটহাউস গ্র্যান্ডহোটেল ফার্পো এবং গ্রেট ইস্টার্নের সামনে থেকে অনেক মোটর এসে টাউনহলের সামনে দাঁড়াল। টাউনহল লোকে ভরে গেল।
সভাপতি হলেন শেরে-বাংলা। শেরে-বাংলার উভয় পাশ ঘেঁষে মঞ্চের উপর বসলেন সিংগিয়ে বাংলা মহিষে-বাংলা গরুয়ে বাংলা টাট্রুয়ে-বাংলা গাধায়ে বাংলা খচ্চরে-বাংলা কুত্তায়ে-বাংলা পাঠায়ে বাংলা বিল্লিয়ে-বাংলা বান্দরে বাংলা শিয়ালে-বাংলা খাটাসে-বাংলা নেউলে-বাংলা বেজিয়ে বাংলা এবং আরও অনেক নেতা। এছাড়া ইন্দুরে বাংলা চুঁহায়ে-বাংলা ফড়িং-এ বাংলা পোকায়ে-বাংলা মাকড়ে-বাংলা এবং চিউটিয়ে-বাংলারাও বাদ যাননি। তাঁরাও মঞ্চের দুপাশে ও সামনে চেয়ার পেতে সভা উজালা করে বসেছেন। হাতিয়ে-বাংলা অতিরিক্ত মাত্রায় কলার রস খেয়ে বিভোর হয়ে পড়েছিলেন। তাই তিনি স্বয়ং আসতে না পেরে বাণী পাঠিয়েছেন।
সবার আগে সভাপতির ভাষণ হল। সম্প্রতি তিনি ওজারতির গদি হারিয়েছেন। তাঁর দুশমনরা ওজারত দখল করেছেন। কাজেই তিনি কনফারেন্সের উদ্দেশ্য বুঝাতে গিয়ে প্রথমেই বললেন: হবে না দেশে খাদ্যের অভাব। মরবে না বাঙালি অনাহারে? এমন নিমকহারাম জাত দুনিয়ায় আর একটি আছে? আমি এই হাতভাগাদের এত উপকার করলাম : নিজের কামাই করা পঞ্চাশ লাখ টাকা হতভাগাদের সেবায় খরচ করে ফেললাম; অথচ তাদেরই চোখের সুমুখ দিয়ে আমার দুশমনরা আমার ওজারতি কেড়ে নিয়ে গেল; বাঙালি জাত কিনা সেটা বরদাশত করল। তারা কিনা আমার দুশমনদের ওজারতি মেনে নিল। এমন বেইমান জাতকে খোদা শুধু অনাহারে মারবে না, তুষের আগুনে তিলে তিলে পুড়িয়ে মারবে।
এইভাবে কনফারেন্সের উদ্বোধন শেষ করে সভাপতি আসন গ্রহণ করলেন।
সভায় উত্তেজনার সৃষ্টি হল।
সভাপতির দুশমনদের পক্ষ থেকে শিয়ালে-বাংলা প্রতিবাদের আওয়াজ তুললেন। তিনি সম্পর্কে সভাপতির ভাগনে হন। কাজেই সাহসে ভর করে বললেন: সভাপতি মামুজি যে বক্তৃতা করলেন এই সভার উদ্দেশ্যের দিক থেকে তা নিতান্তই অবান্তর, আমরা রাজনৈতিক দলাদলি করতে এ সভায় আসিনি। দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতেই এখানে সমবেত হয়েছি।
বলেই তিনি এক প্রকাণ্ড ঢেকুর তুললেন; কারণ এইমাত্র তিনি ফাপো থেকে আসছেন। সেখানে আবার ছুরি-কাঁটার কাজটা একটু বেশি মাত্রায় হয়েছিল।
শিয়ালে-বাংলার বক্তৃতার সমর্থনে ইন্দুরে-বাংলা ও চুঁহায়ে বাংলারা টিটি করতে এবং প্রতিবাদে বিল্লিয়ে-বাংলা ম্যাও ম্যাও করতে লাগল।
সভায় হট্টগোল বেধে গেল। হাতাহাতি দাঁতাদাঁতি ও ঠোঁটাঠুটির উপক্রম। সভা পণ্ড হয় আর কি।
এইবার দাঁড়ালেন সিংগীয়ে-বাংলা। সভাপতির দিকে পলকে দৃষ্টি-বিনিময় করে তিনি মেঘ গর্জনের সুরে বললেন: আপনারা নাহক চেঁচামেচি করে সভা পণ্ড করবেন না।
আপনারা মাননীয় সভাপতির কথা বুঝতে পারেন নি। তিনি আর-আর সব দল বাদ দিয়ে শুধু নিজের দলের লোক দিয়েই ওজারত গড়তে চান, এমন কথা তিনি বলেন নি। তাঁর বক্তৃতার সারকথা এই যে, কোনো একদল ওজারতের গদি দখল করে থাকলে তাতে খাদ্য- সমস্যার সমাধান হবে না। খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে হলে সকল দলের মিলিত ওজারত গড়তে হবে অর্থাৎ কিনা ন্যাশনাল কোয়ালিশন গভর্ণমেন্ট বানাতে হবে। এতে কারুর আপত্তি হবার কোন কারণ নেই।
সভা একটু ঠাণ্ডা হল। সিংগীয়ে বাংলা আসন গ্রহণ করলেন।
ঠাণ্ডা হল মানে একেবারেই ঠাণ্ডা। সভায় আর তেমন উৎসাহের বিদ্যুৎ চমকাল না। এই না দেখে সভ্যমণ্ডলীর মনে উৎসাহের বিজলী চমকাবার উদ্দেশ্যে বন্ধুরা বিখ্যাত বক্তা কুত্তায়ে-বাংলাকে দাঁড় করিয়ে দিলেন।
কুত্তায়ে বাংলা পিছনের পায়ে ভর করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন এবং গলা সাফ করার কায়দায় দুটো বড় রকমের ঘেউ ঘেউ মেরে সভা কাঁপিয়ে তুললেন। তারপর বলতে শুরু করলেন, সিংগীয়ে-বাংলা যা বলেছেন, ঠিকই বলেছেন। আমি জানি, শেরে বাংলারও তাই মত। আর হবেই বা না কেন? এটা ত অতি সহজ কথা। যার মাথায় এক ছটাক বুদ্ধি আছে, তিনিই এ সোজা কথাটা বুঝতে পারবেন। একটি মাত্র দল-তা তাঁরা যতই শক্তিশালী, আর যতই বড় হোক না কেন দেশের সব লোক হতে পারেন না। ফলে একটি মাত্র দল যদি ওজারতি করে, তবে তাতে ঐ দলের সকলের খাদ্য সমস্যার সমাধান হল, এটা ঠিক। কিন্তু যে-সব দল ওজারতি থেকে বাদ পড়ল, তাদের খাদ্য-সমস্যার কি হবে? অথচ যদি সকল দল মিলেমিশে ওযারতি করে, তবে সবারই খাদ্য সমস্যা মিটতে পারে। একেই বলে কোয়ালিশন। এই সহজ সত্যটা যিনি বুঝতে পারেন না, তাঁর বুদ্ধিতে শত ধিক।
কুত্তায়ে-বাংলার বক্তৃতায় সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল। চারদিকে গর্বিত দৃষ্টি ফিরিয়ে কুত্তায়ে-বাংলা আসন গ্রহণ করলেন।
সভার বেশির ভাগ লোক শেরে-বাংলার পক্ষে চলে যাচ্ছে দেখে ওজিরদের পক্ষ থেকে গাধায়ে-বাংলা বিকট গলায় চিৎকার করে দাঁড়িয়ে উঠলেন। তিনি বললেন: শেরে-বাংলার দল আজ যে বড় সর্বদলীয় কোয়ালিশন গভর্ণমেন্টের পক্ষপাতী হয়ে উঠেছেন, দুদিন আগে তাঁর এ মত ছিল কোথায়? তিনি যখন আমাদের বাদ দিয়ে ওযারত গঠন করেছিলেন, তখন আমাদের খাদ্য সমস্যার কথাটা বিবেচনা করেছিলেন কি? সে ওযারত টিকিয়ে রাখবার প্রাণপণ চেষ্টা কি তিনি করেন নি? তিনি তাঁর ওজারত বাঁচিয়ে রাখবার জন্য অত চেষ্টা যদি করে থাকতে পারেন, তবে আমরাই বা তা করতে পারব না কেন? আর কুত্তায়ে-বাংলা যে বললেন, আমাদের ওজারত হওয়ায় শুধু আমাদের দলেরই খাদ্য সমস্যা মিটেছে, এটা সত্য নয়। আমরা শেরে-বাংলার ওজারতের চেয়ে বেশি লোককে ওজারতে নিয়েছি। আর যাঁদের উজির বানাতে পারিনি, তাঁদের পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি করেছি। তাছাড়া কন্ট্রাক্ট ও নমিনেশনাদি দিয়ে অনেক লোককে ওজারতের খুঁটি বানিয়েছি। এতে আমাদের সকলের ভাগেই খাদ্য কম পড়ে গিয়েছে। তাতে করে আমরা কায়ক্লেশে কোন প্রকারে ওজারতির গাড়ি ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি। তার উপর অন্য দলের লোককেও যদি ওজারতে ঢুকতে দি, তবে রাস্তার লোক মরবার আগেই আমরা ওজির-নাজিররা না খেয়ে মরব।
গাধায়ে-বাংলার চোখে আঁসু দেখা দিল। কিন্তু তাতে বিন্দুমাত্র না দমে তাঁর বক্তৃতায় বাধা দিয়ে পাঁঠায়ে-বাংলা বললেন: ওজিরি করে যদি আপনাদের খাদ্য-সমস্যা মিটছে না, তবে ওজারতি ছেড়ে দিন না; নাহক ওখানে বসে-বসে আর কষ্ট করছেন কেন?
গাধায়ে-বাংলা গর্জন করে উঠলেন: কষ্ট করছি কি আর সাধে? আমরা ওজারতি গদি ছেড়েছি কি, আর অমনি আপনারা তাতে লাফিয়ে চড়ে বসবেন। সেই চিন্তাতেই ত এ আপদ ছাড়তে পারছিনে, এত কষ্ট করেও তাই এ মড়া আগলে বসে আছি। আপনাদের সামনে আজ তিন সত্যি করে বলছি, থাকবও বসে সেখানে আপনাদের পথরোধ করে। যদি গদিতে বসে অনাহারেও থাকতে হয়, তবু গদি ছাড়বো না, গদি কামড়েই পড়ে থাকবো; দরকার হয় গদিতেই জান দেবো। অনাহারেই যদি মরতে হয়, তবে রাস্তায় পড়ে মরার চেয়ে ওজারতির গদিতে পড়ে মরা অনেক ভাল।
সভা স্তম্ভিত হল। শেরে-বাংলার তালু জিভ লেগে গেল। ওই যদি দুশমনদের অ্যাটিচুড হয়, তবে আর আপোসের সম্ভাবনা কোথায়? তবে আর তাঁর দলের লোকদের খাদ্য-সমস্যার সমাধান হবে কি করে? এ সব ফুড কনফারেন্স করে তবে লাভ কি? দলের লোকদেরে স্তোক দিয়ে রাখাই বা যায় আর কতকাল?
তিনি রেগে যাচ্ছেন দেখে সিংগীয়ে-বাংলা চোখ ইশারায় তাঁকে থামতে বলে ইন্দুর-বাংলার কানে-কানে কি বললেন। ইন্দুরে-বাংলা চেয়ারের উপর চড়ে বলতে লাগলেন: বাঘে- মোষে লড়াই হয়, নলখাগড়ার পরান যায়। আমাদের হয়েছে তাই। যা দেখেছি তাতে বাঘে- মোষে আপোস হবে না। তবে আর আমরা গরিব লোকেরা কেন এখানে সময় নষ্ট করছি? রাত নটা বাজে। বড় লোকদের না হয় কাম-কাজ নেই। কিন্তু আমাদের ত কাম-কাজ রয়েছে। রাত অনেক হয়েছে। রাতের বেলা আমাদের অনেক লোকের কাঁথা-বালিশ কাটতে হবে। নইলে ত আর আমাদের খোরাকি জুটবে না। কাজেই আসুন ভাই সাহেবান, আমরা সভা ছেড়ে চলে যাই।
সভার অনেকেই উঠবার আয়োজন করল।
মহিষে-বাংলা এতক্ষণ কথা বলেননি। সভাপতির একটু দূরে একটা বড় রকমের • সোফায় কাৎ হয়ে পড়ে তিনি এতক্ষণ জাবর কাটছিলেন।
সভা পণ্ড হয় দেখে তিনি এইবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন: আমি একটা আপোস- প্রস্তাব করছি। আশা করি শেরে-বাংলার দল তা গ্রহণ করবেন। অনেক সাধ্যি-সাধনা করে আমরা ওজারতি দখল করেছি; ওটা আমরা ছাড়তেও পারব না, অন্য কাউকে শরিকও করতে পারব না। কিন্তু তাই বলে অপর দলের খাদ্য সমস্যার সমাধান না হোক, এটাও আমরা চাইনে। আসুন, আমরা সব দল মিলে একটা ফুড কমিটি গঠন করি। এই কমিটির সভ্যরা মন্ত্রিত্বের ক্ষমতা পাবেন না বটে, কিন্তু তাঁদের সবাইকে মন্ত্রিগণের সমান মাইনে দেওয়া হবে। শেরে-বাংলার দলের যত-ইচ্ছে লোক এই কমিটির সভ্য হতে পারবেন।
সভায় ধন্য ধন্য পড়ে গেল।
শেরে-বাংলা দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন: আমার দলের লোকদেরে কমিটিতে মনোনয়ন করবার ভার আমার উপরই থাকবে ত? আমার আত্মীয়-স্বজন বলে কাউকে বাদ দেওয়া হবে না ত?
মহিষে-বাংলা বললেন: তা সম্পূর্ণ শেরে-বাংলার এখতিয়ার। ও-ব্যাপারে আমরা কেউ কোন কথা বলব না।
শেরে-বাংলা সভাপতির আসন ছেড়ে উঠে সিংগীয়ে-বাংলার ও পাঠায়ে-বাংলার কাঁধে হাত দিয়ে তাঁদের এক কোণে নিয়ে গেলেন। সেখানে একটা ছোটখাট সভা হল। অনেক কানাকানি হল।
তারপর চেয়ারে ফিরে এসে শেরে-বাংলা বললেন: তথাস্তু। আমি আপোস-প্রস্তাব গ্রহণ করলাম।
সভায় আনন্দের হুল্লোড় পড়ে গল।
শেরে-বাংলার প্রস্তাবে ও মহিষে-বাংলার সমর্থনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলার খাদ্য সমস্যা সমাধানের মহান উদ্দেশ্যে সর্বদলীয় ফুড কমিটি গঠিত হল।
সভাপতিকে ধন্যবাদ দিয়ে সভ্যর কাজ শেষ হল।
সভাশেষে গাধায়ে-বাংলা ঘোষণা করলেন: জাতির এই দুদিনে বাংলার জাতীয় নেতাদের মধ্যে ঐক্য স্থাপনের পুণ্য দিনের স্মৃতি স্বরূপ তিনি আগামীকাল গ্র্যান্ডহোটেলে একটি প্রীতিভোজের আয়োজন করবেন। সমবেত ভদ্রমণ্ডলীকে সে ভোজ-সভায় দাওয়াত করা হচ্ছে।
সভায় ধ্বনি উঠল: গাধায়ে-বাংলা কি-জয়।
তিন
গ্র্যান্ডহোটেলে ফুড কমিটির বৈঠক। শেরে-বাংলা মহিষে-বাংলা সিংগীয়ে-বাংলা টাটুয়ে-বাংলা গাধায়ে-বাংলা কুত্তায়ে-বাংলা পাঠায়ে-বাংলা বিল্লিয়ে-বাংলা শিয়ালে-বাংলা প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় সমস্ত বাঙালিই ফুড কমিটির সদস্য মনোনীত হয়েছেন। মন্ত্রীরা এক্স অফিসিও মেম্বার। তাঁরা অবশ্য কমিটির মেম্বর হিসেবে আর মাইনে পাবেন না; তবে মিটিং-এ হাজির হওয়ার জন্য ফিস্ পাবেন। সদস্যের মধ্যে শেরে-বাংলার ভাগনের সংখ্যাই বেশি। কিন্তু তাতে কারুর আপত্তি করার উপায় নেই; শেরে-বাংলার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে সেই শর্তেই। আর খোদ শেরে-বাংলা বলেন, শেরে বাংলার ভাগনে হলে ব্রিলিয়েন্ট হতেই হবে, যথা, শিয়ালে-বাংলা।
সর্বদলীয় নেতারা সবাই বৈঠকে হাজির। ইদুরে-বাংলা চুঁহায়ে বাংলা ও চিউটিয়ে-বাংলা প্রভৃতি ক্ষুদে নেতারা ফুড কমিটির সদস্য না হলেও তারা বৈঠকে হাজির। কারণ কমিটিতে খাদ্য-সমস্যার থিওরেটিক্যাল আলোচনার শেষে গাধায়ে-বাংলার খরচে প্র্যাকটিক্যাল ডিমনস্ট্রেশনের ব্যবস্থা হয়েছে। সেই জন্যেই গ্র্যান্ড হোটেলের মতো যন্ত্র-সজ্জিত ল্যাবরেটরিতেই ফুড কমিটির বৈঠক দেওয়া হয়েছে।
সভার কাজ শুরু হল। শেরে-বাংলা সভাপতির আসন গ্রহণ করলেন। প্রথমেই পাঠায়ে-বাংলা পয়েন্ট অব অর্ডার রেইজ করলেন। তিনি বললেন: কিণ্ডারগার্টেন প্রণালীতে যেমন থিওরেটিক্যাল শিক্ষাদানের আগে প্র্যাকটিক্যাল শিক্ষাদান শুরু হয়, খাদ্য-সমস্যার আলোচনাতেও তেমনি প্র্যাকটিক্যাল কাজটিই আগে হতে পারে না কি?
অনেকেই হযফানি করে পাঠায়ে-বাংলার প্রস্তাব সমর্থন করলেন। গরুয়ে বাংলা ত দস্তুর মতো একটা বক্তৃতাই করে বসলেন।
কিন্তু সমস্ত উৎসাহ উদ্যম দমিয়ে দিলেন খোদ সভাপতি শেরে-বাংলা। তিনি তাঁর স্বভাব-সুলভ ক্ষুরধার ভাষায় বললেন: আমার বন্ধুদ্বয় পাঁঠা ও গরু নাম সার্থক করেছেন। নইলে এমন আহমকী প্রস্তাবও কেউ করতে পারে? এখনই খাদ্য-সমস্যার প্র্যাকটিক্যাল ডিমনস্ট্রেশনে হাত দিলে আমাদের লোকসান হবে, হোটেলওয়ালারই হবে লাভ। কারণ থিওরেটিক্যাল আলোচনায় ঘন্টা-দুখন্টা বক্তৃতা করে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ডিমনস্ট্রেশনে হাত দিলে তাতে আমরা যত হাতসাফাই ও দাঁতসাফাই দেখাতে পারব, এখন নিশ্চয়ই তা পারব না।
সকলে সভাপতির দূরদর্শিতার তারিফ করতে লাগলেন।
সভার কাজ শুরু হল।
সভাপতি বললেন: আমাদের সুজলা-সুফলা শস্য-শ্যামলা বাংলাদেশের খাদ্য-সমস্য। দেখা দিল কেন, সেই কারণটাই আমাদের আগে খুঁজে বের করতে হবে। অতএব আমি এ বিষয়ে সদস্যদের অভিমত জানতে চাই।
সভাপতির আদেশে প্রথমে দাঁড়ালেন সিংগীয়ে-বাংলা। তিনি বললেন: বাংলায় খাদ্য- সমস্যার একমাত্র কারণ মুসলমানদের পাকিস্তান দাবি ও বাংলায় সাম্প্রদায়িক ওভারত। মুসলমানেরা যতদিন পাকিস্তান দাবি ত্যাগ না করছে এবং যতদিন জাতীয়তার ভিত্তিতে বাংলায় কোয়ালিশন গভর্ণমেন্ট গঠিত না হচ্ছে, ততদিন বাংলার বাহির থেকে সাহায্যও আসবে না, খাদ্য-সমস্যার সমাধানও হবে না।
গাধায়ে-বাংলা আপত্তি উত্থাপন করলেন। বললেন: সিংগীয়ে-বাংলা ফুড-কমিটিতে কৌশলে রাজনৈতিক বিতর্কের আমদানি করছেন। এ দিকে আমি মাননীয় সভাপতির দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
সভাপতি: অবজেকশন ওভাররুল্ড। কারণ খাদ্য-সমস্যার হেতু সম্বন্ধে যাঁর তাঁর ধারণা প্রকাশ করবার স্বাধীনতা সব সদস্যেরই রয়েছে।
মহিষে-বাংলা খাদ্য সমস্যার কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে বললেন: সরকারি যুদ্ধ- প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে কংগ্রেসী সাবোটাশ আন্দোলনেই বাংলার খাদ্য-সমস্যার একমাত্র কারণ। এই আন্দোলনের গোড়াতে রয়েছে অখণ্ড হিন্দুস্থানী মনোভাব। অতএব অখণ্ড হিন্দুস্থানই বাংলার খাদ্যসমস্যার একমাত্র হেতু।
কুত্তায়ে-বাংলা তাঁর সুচিন্তিত অভিমত দিতে গিয়ে বললেন: আসল কথা কি জানেন? আপনারা যাকে খাদ্য-সমস্যা বলছেন, ওটাকে আমি সমস্যা হিসাবে দেখছি না-ওটা আসলে একটা মূল্যবৃদ্ধি মাত্র। জিনিসের দাম বাড়ে দেশবাসীর ক্রয়শক্তি বৃদ্ধি পেলে। আমাদের দেশে যে চালের দাম বেড়ে চার টাকার জায়গায় চল্লিশ টাকা মন হয়েছে, তাতে বুঝতে হবে বাঙালির ক্রয়-শক্তি দশ গুণ বেড়ে গেছে। এটা বাংলার অর্থ-সাচ্ছল্যেরই লক্ষণ। এই ধরুণ, আমরা এই যে, হোটেলে খানিক পরেই খেতে বসবো, তার দাম ছিল আগে ‘মিল’-প্রতি পাঁচ টাকা। কিন্তু আজ আপনারা যে খানা খাবেন, তার দাম ‘মিল’ প্রতি দশ টাকা। তবে কি বুঝতে হবে গ্রান্ডহোটেলে খাদ্য-সমস্যা দেখা দিয়েছে। তা নয় বরঞ্চ বুঝতে হবে যে, আমরা যারা এই হোটেলে খানা খেয়ে থাকি, তাদের অবস্থা সচ্ছল হয়েছে। কাজেই বাংলায় চল্লিশ টাকা চালের মন দেখেই যারা এটাকে খাদ্য সমস্যা বলছেন তাঁরা অর্থ-শাশুত্র পড়েন নি। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, যুদ্ধের দরুন দেশের লোকের আর্থিক অবস্থা হঠাৎ ভাল হয়ে গিয়েছে বলেই জিনিস-পত্রের দামও হঠাৎ এত বেড়ে গিয়েছে।
বাধা দিয়ে বিল্লিয়ে-বাংলা বললেন: বন্ধুবর কুত্তায়ে-বাংলা চালের কন্ট্রাক্টরি করে কিছু টাকা মেরেছেন বলে টাকার গরমে দেশের খাদ্যসমস্যাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কোলকাতার রাস্তায়-রাস্তায় যে রোজ শত-শত লাশ পরে থাকে, এটাও কি বাংলার আর্থিক সচ্ছলতার প্রমাণ।
কিছুমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে একটু বিদ্রুপের সাথে হে-হে করে কুত্তায়ে-বাংলা বললেন: ‘স্টেটসম্যান’ ও ‘অমৃতবাজারে’ কয়েকটা ছবি দেখেই বন্ধুরা ধরে নিয়েছেন, কোলকাতার ফুটপাত মরা লাশে ভরে গিয়েছে। আসলে কিন্তু ওসব খবরের কাগজেওয়ালাদের নাটকীয় বাড়াবাড়ি, ওভারড্রামাটিয়েশন। হাসপাতালে কিছু লোক মারা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তারা অনাহারে মারা যাচ্ছে, কি বেশি খেয়ে পেটের পীড়ায় মারা যাচ্ছে, তার কি কেউ খবর নিয়েছেন?
কুত্তায়ে-বাংলা আরো কি বলতে যাচ্ছিলেন। সভাপতি ঘড়ির দিকে চেয়ে বললেন: আরো অনেক বক্তা রয়েছেন। এদিকে প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসেরও সময় হয়ে এল। কাজেই প্র্যাকটিক্যালের পরেও আমাদের এই থিওরিটিক্যাল আলোচনা কনটিনিউ করতে হবে। তখন অন্যান্য বক্তারা নিজ-নিজ মত বলতে পারবেন। সভাপতি হিসাবে আমিও নিজের মত তখনই দেব। এখন এইটুকু মাত্র আমি বলে রাখতে চাই যে, যত কথাই আপনারা বলুন, সমস্যার মূল কারণটার ধারে কাছেও এখনও আপনারা যাননি। আমার স্নেহভাজন সিংগীয়ে- বাংলা এ বিষয়ে সত্যের কাছাকাছি গিয়েছিলেন বটে, কিন্তু তিনিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছেন। ন্যাশনাল গভর্নমেন্ট বা কমিউনাল গভর্ণমেন্ট আসল কথা নয়। আসল কথা এই যে, আমার ওজারতি কেড়ে নিয়ে গভর্নর আমার উপর যে অবিচার করলেন, সে অবিচারের প্রতিকার না হওয়া পর্যন্ত বাংলার ভালাই হতে পারে না। বাঙালি যতদিন সেই বেইমানির প্রতিকার না করবে, ততদিন তাকে একটার পর-আর একটা বালা-মুসিবত পোহাতেই হবে………
ততক্ষণ ডাইনিং হলে ছুরি-কাঁটার ঝনঝনানি পড়ে গিয়েছে। কাজেই সভাপতির বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখেই সদস্যরা একে একে উঠে পড়লেন। অগত্যা সভাপতি সাহেবও লম্বা লম্বা পা ফেলে অনেককেই পিছনে ফেলে ডাইনিং হলে প্রবেশ করলেন।
অতঃপর সেখানে যে মারের ব্যাপারটা শুরু হল এবং সে ব্যাপারটা অব্যাহত গতিতে প্রায় ঘণ্টাখানেক যেভাবে চলল, তাতে এটা বোঝা গেল যে সমবেত ভদ্রলোকদের শুধু মধ্যাহ্নের নয়, ঐ রাতের বেলায় খাদ্য সমস্যারও সমাধান হয়ে যাচ্ছে।
চার
ডাইনিং হল থেকে ফিরে এসে যে সভা বসল, তার আবহাওয়া হল অনেক শান্ত এবং সদস্যদের মেজাজও হল অনেকটা খোশখোশাল। বক্তাদের বক্তৃতার মধ্যে উগ্রতা রইল না;
একের প্রতি অন্যের আক্রমণের তীব্রতা থাকল না। সব ব্যাপারে ইউন্যানিমাস হবার একটা আগ্রহ যেন সকল দিক থেকেই পরিস্ফুট হয়ে উঠল।
সময় বুঝে টাটুয়ে-বাংলা দাঁড়ালেন এবং একটা হাদয়গ্রাহী চি-হি-হি দিয়ে বললেন: আসল কথা কি জানেন? সিংগীয়ে বাংলা যা বললেন, তাও সত্য, আবার কুত্তায়ে-বাংলা যা বললেন, তাও সত্য। অর্থাৎ কিনা বাংলায় খাদ্য-সমস্যা আছেও আবার নাইও। আছে বললেই আছে, আর নাই বললেই নাই। এখানে যখন আমরা সকল দলের নেতারা একতাবদ্ধ হয়েছি, তখন আমাদের সব দলের মতই মেনে চলতে হবে। কাজেই আমরা সমস্যা আছেও বলব, আবার নাইও বলব।
এই নিতান্ত ‘আফটার-ডিনার’-গোছের বক্তৃতার সভার চারদিকে করতালি ও মারহাব। পড়ে গেল। করতালি থামলে খচ্চরে-বাংলা ইনফরমেশনের নুক্তা হিসাবে জিজ্ঞেস করলেন: সমস্যাটা যখন সর্ব-দলীয় নজর থেকে দেখা হচ্ছে, তখন সমাধানটাও সর্বদলীয় বুনিয়াদে হবে ত?
জবাব দিলেন খোদ মহিষে বাংলা। তিনি খুব জোরসে বললেন নিশ্চয় নিশ্চয়। দেখতেই ত পাচ্ছেন, আমরা যেখানে ওজারতির মেহনত করে মাইনে নিচ্ছি, সেখানে আপনাদের ফুড কমিটির মেম্বর করে বিনা-মেহনতে বসিয়ে বসিয়ে মাইনে দিচ্ছি। খাদ্য- সমস্যার দিক থেকে দলাদলি আমরা রাখতে চাইনে, সেটা আপনারা বুঝতেই পাচ্ছেন।
কমিটির সদ্যদের সবাই এতে খুশি হলেন বটে, কিন্তু দর্শকদের ভেতর থেকে চূহায়ে- বাংলা আপত্তি তুললেন। তিনি বললেন: ফুড কমিটিতে বিভিন্ন দলের শুধু রুই-কাতলারাই সদস্য হয়েছেন। তাতে তাঁদের খাদ্য-সমস্যা মিটল বটে এবং আমরা যারা নেতাদের মুসাহেরের কাজ করছি, তাদেরও একটা হিল্লা হল বটে, কিন্তু চুনায়ে- বাংলা পুঁটিয়ে-বাংলা প্রভৃতি ক্ষুদে নেতাদের কি হল? তাদের ভুললে ত চলবে না। তাদের জোরেই ত আমরা ওজির-নাজির ও আইনসভার মেম্বর হয়েছি।
আবার দাঁড়ালেন কুত্তায়ে-বাংলা। দলাদলির যখন অবসান হল, তখন সর্বসম্মতিক্রমে তাঁরই উপর পড়ল কনস্ট্রাকটিভ স্কিম দাখিলের ভার। তিনি দাঁড়িয়ে বললেন: আপনারা চিন্তা করবেন না। আমার স্কিমে সকলের জন্যই ব্যবস্থা থাকবে। আমার স্কিমটা আপনাদের খেদমতে পেশ করবার আগে তার মূলনীতিটা আপনাদের বুঝিয়ে বলছি:
প্রথমত, চালের দাম বেড়েছে বলে চাষীদের হাতে প্রচুর টাকা হয়েছে। কাজেই মফস্বলে খাদ্য-সমস্যা নেই। অতএব মফস্বল সম্পর্কে আমাদের কিছু করবার নেই।
দ্বিতীয়ত, চাষীরা হাতে টাকা পেয়ে বাবুগিরি করবার মতলবে শহরে ভিড় করছে, কোলকাতার লোক-সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ এই। কাজেই জাতির মেরুদণ্ড ও মস্তিষ্ক কোলকাতার ভদ্রলোকদের বাঁচাতে হলে পাড়াগাঁয়ে এইসব আগন্তুককে আবার পাড়াগাঁয়ে তাড়িয়ে দিতে হবে। কোলকাতার ভিড় কমে গেলেই শহরের খাদ্য-সমস্যাও মিটে যাবে।
তৃতীয়ত, এ, আর, পি. ও হোমগার্ড-সিভিকগার্ডের চাকরি নিয়েও যে সব চুনায়ে বাংলার ও পুঁটিয়ে-বাংলার হিল্লা হয় নি, তাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করবার জন্য আরো নতুন চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে আমরা ফুড-সেন্সাসের আয়োজন করব।
চতুর্থত, দেশে যদি সত্যসত্যই চালের অভাব হয়েই থাকে, তবে সে দোষ ভদ্রলোকদের নয়-সে দোষ চাষীদের। দেশের খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহের দায়িত্ব তাদের উপর; আবাদি জমি-জিরাতও তাদের দখলে। তারা যদি আলসেমি করে কম ফসল উৎপন্ন করে থাকে, তবে দোষী চাষীরাই। সেজন্য কাউকে যদি শাস্তি পেতে হয়, তবে ও শাস্তি পাবে চাষীরাই। তা সাড়া দেশের মস্তক যে ভদ্রলোকেরা তাদেরে আমরা মরতে দিতে পারি না। চাষী-মজুর, গরিব-দুঃখী, কাঙাল মিসকিন মরলে দেশের কোন লোকসান হয় না। লোকসান হয় ভদ্রলোক মারা পড়লে।
পঞ্চমত, আমাদের সর্বশেষ ও সর্বোত্তম মূলনীতি এই যে, অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করতে হবে। কোটের মাপেও কাপড় কাটা যায় আবার কাপড়ের মাপেও কোট কাটা যায়। ঠিক তেমনি, খানেওয়ালার সংখ্যা দিয়েও খোরাকির পরিমাণ ঠিক করা যায়, আবার খোরাকির পরিমাণ দিয়েও খানেওয়ালার সংখ্যা ঠিক করা যায়। আমাদের দেশে এখন খোরাকির টানাটানি পড়েছে, এটা সবাই স্বীকার করেছেন। খানেওয়ালার সংখ্যানুসারে খোরাকির পরিমাণ বাড়াবার সব চেষ্টাই আমাদের ব্যর্থ হয়েছে। কাজেই খোরাকির পরিমাণ অনুসারে আমাদের খানেওয়ালার সংখ্যাই অগত্যা কমাতে হবে।
এই পাঁচটি মূল সূত্র ধরেই আমার স্কিম রচনা করা হয়েছে। এইবার আপনারা আমার স্কিমের বিস্তারিত বিবরণ শুনুন….
দলাদলির অবসান হয়েছে শুনেই সভাপতি ঝিমোতে শুরু করেছিলেন। এইবার কুত্তায়ে বাংলার কনস্ট্রাকটিভ স্কিম পড়া শুরু হতেই সভাপতির নাকডাকা শোনা গেল। খানিক আগেই যে ধরনের মধ্যাহ্ন ভোজনটা হয়েছিল, তাতে নাকডাকার জন্যে সভাপতিকে কেন কাউকেই দোষ দেওয়া যায় না।
সজাগ থাকলেন কুত্তায়ে-বাংলা একা। নিদ্রিত সভাপতি ও ঝিমায়িত সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবার জন্যই হোক আর নিজের স্কিমের নিশ্চিত সাফল্যের আনন্দেই হোক, তিনি বিরাট চিৎকার এবং টেবিলে মুষ্টাঘাত করে বললেন: আমার এই স্কিমে দেশের খাদ্য সমস্যার সমাধান হবেই হবে।
সে চিৎকারে হলের ছাদ ফাটবার মতো হল। মুষ্টাঘাতে টেবিলের উপরের গ্লাস ও অ্যাশট্রেগুলো লাফিয়ে ঝনঝনাৎ করে উঠল। কিন্তু সভাপতির নিদ্রার তাতে কিছুমাত্র ব্যাঘাত হল না। বরঞ্চ সভাপতির দেখাদেখি আর-সদস্যরাও একে একে চোখের পাতা বন্ধ করলেন। ঘুমায়িত এইসব সদস্যের কানের কাছে কোন সুদূর নিঃসৃত কণ্ঠস্বর ভেসে আসতে লাগল: হবেই হবে-সমাধান হবেই হবে।
পাঁচ
তারপর? তারপর আর কি। যেমন বেশি খাওয়া তেমনি লম্বা ঘুম। সে ঘুমে ঘুমন্তরা কত রঙিন স্বপ্ন দেখলেন। সে স্বপ্নে তাঁরা কত পরীর রাজ্যে ঘুরে বেড়ালেন। কত পরীর সঙ্গে প্রেম করলেন।
অতিভোজনের দরুন বদহজমিও হল দু-চার জনের। কাজেই কেউ কেউ দুঃস্বপ্নও দেখলেন। সে দুঃস্বপ্ন থেকে ছটফটিয়ে তারা যেই জেগে উঠলেন, তখন আর-আর সকলরেও ঘুম ভেঙ্গে গেল-বিশেষত হোটেলের ম্যানেজারের তাড়ায়।
সবাই চোখ কচলাতে কচলাতে গ্র্যান্ড হোটেলের বাইরে এলেন। দেখলেন তাজ্জব ব্যাপার। কোলকাতার রাস্তায় আবার পরীর মেলা জমেছে। রাস্তাঘাটের নোংরামি চোখের পলকে দূর হয়ে গিয়েছে। রাস্তাঘাট ও ট্রামের কদর্য ভিড়ও কমে গিয়েছে।
সবাই অবাক। জিজ্ঞেস করে জানলেন, এ সবই কুত্তায়ে-বাংলার স্ফীমের দৌলতে হয়েছে। দেশের জনসাধারণ চাষী-মজুর গরিব-দুঃখী ফকির-মিসকিন সবাই খাদ্যাভাবে মরে গিয়েছে। আইন-সভা ও ফুড কমিটির মেম্বর ভদ্রলোকেরা ছাড়া দেশে আর কেউ বেঁচে নেই। শহর ছাড়া পাড়াগাঁয়ে আর লোক নেই। চাল-ডাল তরি-তরকারির আর কোন অভাব নেই। এক ভদ্রলোকেরা কিনবেন কত?
সকলের মুখে হাসি ফুটে উঠল। কুত্তায়ে-বাংলা সগর্বে বললেন: কেমন আমি বলি নি যে আমার স্কীমে খাদ্য সমস্যার সমাধান হবেই হবে? এইবার হল ত?
সিংগীয়ে-বাংলা সোৎসাহে বললেন: শুধু কি তাই ছোট লোকগুলোর উৎপাত থেকেও বাঁচা গেল। এবার আমরা শেরে-বাংলা সিংগীয়ে-বাংলা হাতিয়ে-বাংলা ও মহিষে-বাংলা খুব আরামসে হে হে হেঁ-
সবাই সে হাসিতে যোগ দিলেন। শুধু ছাগলে বাংলাটা দাড়ি নেড়ে বললেন: তা হল বটে, কিন্তু শেরে-বাংলা হাতিয়ে বাংলা প্রভৃতি শুধু জানোয়ারে বাংলারাই আমরা বেঁচে
রইলাম। মানুষে বাংলারা যে সবাই মরে গেল।
সে কথায় কেউ কান দিলেন না। বরঞ্চ সকলে সমস্বরে আসমান ফাটিয়ে জয়ধ্বনি করলেন: জানোয়ারে-বাংলা জিন্দাবাদ।
গড়ের মাঠের ওপর পাশের ফোর্টের দিক থেকে প্রতিধ্বনি হল: মানুষে-বাংলা মুর্দাবাদ।
১৫ আশ্বিন ১৩৫০
Leave a Reply