পিওতর মান্তেইফেল
পশুর বৃদ্ধিমত্তা
রূপকথার ছেয়ে নেকড়ে, সেয়ানা শেয়াল- দিদি, কিংবা কাঁকড়া-লোম বেয়াড়া ভালুকের কাণ্ড-কারখানার কথা আমাদের কে না-জানে। এইসব গল্পের প্রভাবে অনেকেই জন্তু জানোয়ারের সামর্থ্য বড়ো করে দেখে, তাদের ওপর আরোপ করে মেধা বা বুদ্ধিমত্তার মতো মানবীয় গুণ। মাঝে মাঝে আমাদের জিজ্ঞাসা করা হয়, ‘পশুদের কি বুদ্ধি আছে?’ কী উত্তর দেব তার? অবশ্যই মানবোচিত বুদ্ধি ওদের নেই। তাদের সমস্ত ক্রিয়াকলাপই হল প্রকৃতির মধ্যে তাদের জটিল জীবনযাত্রা পরিস্থিতি এবং পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেবার প্রক্রিয়ায় গড়ে ওঠা রিফ্লেক্স, বা পরিবর্ত ক্রিয়ার ফল।
পশুদের বুদ্ধিমত্তা কতটা তা যাচাই করার জন্যে একবার মস্কো চিড়িয়াখানায় একটা পরীক্ষা চালাই আমরা। আফ্রিকা থেকে সদ্য আনা একদল বেইজ কৃষ্ণসার মুগকে আমরা লোহার জাল দিয়ে ঘেরা একটা জায়গায় রাখি। একই রকম জালি-বেড়ায় জায়গাটা দু’ভাগে ভাগ করা হয়, তার একটা ভাগে আমাদের চতুষ্পদ বন্দীরা থাকে অনেক দিন। প্রথমটা তারা গোঁ ধরে বেড়া ভেদ করে যাবার চেষ্টা করে, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয় না। লোহার জালি-বেড়াটা ছিল বেশ মজবুত। ক্রমশ বেড়া ছাড়িয়ে না যাওয়া অভ্যেস হয়ে গেল ওদের। তখন আমরা ভেতরকার পার্টিশনটা তুলে নিই। কেউ কেউ ভেবেছিল যে এবার সারা জায়গাটায় ছুটে বেড়াবে হরিণগুলো। কিন্তু মোটেই তা হল না: যে রেখা বরাবর বেড়াটা ছিল তা পেরুবার সাহস হল না কারো, এই ‘বুদ্ধিমত্তাটুকু’ তাদের ছিল না। তুলে নেওয়া বেড়ার রেখা পর্যন্ত ছুটে এল হরিণগুলো, তারপর আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। যেকোনো বেড়ার চেয়ে তাদের অনেক বেশি ভালো করে আটকে রেখেছিল বিগত সপ্তাহগুলোর গড়ে ওঠা প্রতিবর্ত: তখন লোহার জাল ভেদ করার কত চেষ্টাই তো করেছিল, কিন্তু,ই সে হয় নি।
ইউক্রেনের আঙ্কানিয়া-নোভা সংরক্ষিত জীবান্ডলে একই রকম পরীক্ষা চালানো হয় হরিণ, লামা আর উটপাখি নিয়ে। সেখানেও তুলে নেওয়া বেড়ার সীমানা পেরবার সাহস কারো হয় নি অনেকখন।
আমাদের পশু-পালন কেন্দ্রগুলোতেও পশুদের সামর্থ্য বাড়িয়ে ধরা হচ্ছে, এমন ঘটনা কম নেই। সেবল আর মার্টিনদের রাখার জায়গাটায় লোকে প্রায় গোটা মেঝে জুড়ে লোহার জাল পেতে রাখে। সেটা করা হয় যাতে জন্তুগুলো মাটির তলে গর্ত খুঁড়ে খাঁচা থেকে না পালায়। তবে এ সাবধানতা নিষ্প্রয়োজন। মস্কোর চিড়িয়াখানায় সেবল আর মার্টিনরা যেখানে থাকত, তার মেঝে মাটির, কিন্তু সুরঙ্গ খুঁড়ে পালাবার কথা কারো মাথায় আসে নি। বলাই বাহুল্য, ছাড়া পাবার চেষ্টা করে দেখেছে সবাই, কিন্তু সে প্রচেষ্টায় সাফল্যলাভের মতো ‘বুদ্ধিমত্তা’ তাদের ছিল না। খাঁচা থেকে পালাবার চেষ্টায় তারা সোজা আসে জালি-বেড়ার কাছে, সেখানে বাধা পেয়ে ওইখানেই তারা মাটি খুঁড়তে শুরু করে। আগেই সেটা আন্দাজ করে আমরা বেড়া বরাবর অল্প প্রস্থের তক্তা পেতে রেখেছিলাম, তার ওপরে দিয়েছিলাম সামান্য মাটি। সুরঙ্গ খুঁড়তে গিয়ে সেবল আর মার্টিনরা কেবল তক্তা আঁচড়েই ক্ষান্ত হয়, কোনো ফল মেলে না, অথচ বেড়া থেকে মাত্র বিশ সেন্টিমিটার দূরে খুঁড়লেই তক্তার তলা দিয়ে বাইরে যেতে কোনোই অসুবিধা হত না তাদের।
বাঘ-সিংহের ‘বুদ্ধিমত্তা’ও বেশি নয়। চিড়িয়াখানায় প্রায়ই তাদের আলাদা করে রাখা হয় আধা প্লাই-উডের পার্টিশন দিয়ে, প্রচণ্ড থাবার এক ঘায়েই যা ভেঙে পড়বে। কিন্তু শক্ত দেয়ালের মধ্যে বেড়ে ওঠা এই প্রকান্ড প্রকাণ্ড হিংস্র জন্তুগুলো ভাবতেই পারে না যে অমন পলকা পার্টিশন ভাঙা সম্ভব। খাঁচার মধ্যে থাকা রপ্ত করিয়ে আমরা ওদের একটা নতুন অভ্যাস গড়ে দিই তাতে নিজেদের কায়েমী জায়গা ছেড়ে যাবার কোনো চেষ্টাই করে না তারা। এইসব প্রতিবর্ত’ এমন পাকা হয়ে ওঠে যে দরজা দিয়ে আগে কখনো না বেরিয়ে থাকলে তাকে খোলা দরজা দিয়ে জোর করেও বার করা যায় না।
সবাই জানি যে ফুটকিদার হরিণ লাফাতে পারে খাসা। কিন্তু অপেক্ষাকৃত নিচু বেড়া ডিঙিয়ে আমাদের কোনো হরিণ মুক্তিলাভের চেস্টা করেছে, এমন ঘটনা ঘটে নি একটিও। কোপেং-দাগ ভেড়ার বেলাতেও সেই ব্যাপার। যে জায়গাটা তাকে দেওয়া হয়েছিল, সেখানেই সে চুপচাপ কাটায় কয়েক বছর। কিন্তু একদিন রাতে চিড়িয়াখানায় একটা কুকুর ঢুকে কোপেৎ-দাগ ভেড়ার ওপর হামলা করে। তখন সে অনায়াসে তার বেড়া লাফিয়ে যায়। এক্ষেত্রে অভ্যন্ত প্রতিবর্তে’র চেয়ে জন্মগত প্রতিবর্ত ছিল জোরালো।
বানরদের কথা না ধরলে, বাদামী ভালুক হল অন্য সমস্ত জন্তুর চেয়ে বেশি উদ্যোগী। খাঁচার লিফট্ দরজা দিয়ে বেরবার কথা বাঘ, সিংহ, চিতাবাঘ, কারো কখনো মাথায় ঢোকে নি, অথচ তোলা তা খুবই সহজ। কিন্তু চিড়িয়াখানার কর্মচারী দরজাটা কীভাবে তুলছে তা একবার দেখলেই হল, অমনি ‘ট্যারা-পেয়ে’ জন্তুটিও ঠিক তাই করবে! তবে সঙ্গী যাতে বেরিয়ে যেতে পারে, তার জন্যে তাকে পিঠে চাপতে দেওয়ার কথা তার মাথায় খেলবে না। যদিও তিন বছরে মনুষ্যশিশুও তা আন্দাজ করতে পারে অনায়াসে।
আমাদের প্রকাণ্ড ভালুকটির নাম ‘বরেৎস্’ (যোদ্ধা)। বসন্তে বরফ গলার সময় সে হঠাৎ বড়ো বড়ো থাবায় বরফ তাল পাকিয়ে নিয়ে আসতে লাগল পরিখায়। তারপর পেছনের পায়ে ভর দিয়ে, তার ওপর চেপে সে সামনের পা বাড়িয়ে দিলে বেড়ায়, যেন মেপে দেখছে, মুক্তিলাভের সময় হয় নি কি? ব্যাপারটা দাঁড়াল ভয়াবহ। কে একজন হুকুম দিলে:
‘বোমা!.’
চিড়িয়াখানার কর্মচারীরা গুদামে ছুটে গিয়ে মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরল বোমা নিয়ে। এ বোমা বিশেষ ধরনের। লোকজন বা জন্তু-জানোয়ারের প্রাণের কোনো ক্ষতি হয় না, কিন্তু ফাটে তা কর্ণভেদী গর্জনে।
বরেৎস্ যেখানে তার ঢিপি বানিয়েছিল, বোমা ফাটল সেখানেই। বিস্ফোরণে ভয় পেয়ে ঝাঁকড়া দানবটা পরিখা ছেড়ে পালাল। বহুদিন তারপর সে আর সেখানে আসে নি, চেষ্টা করে নি পালাবার। কিন্তু শিগগিরই ফের সে চিড়িয়াখানার লোকেদের অবাক করলে। কেন জানি, গাছের একটা সবুজ ডালে নজর গেল ভালুকটার। এইটে ছিল সবচেয়ে নিচের ডাল, বাতাসের ঝাপটায় দুলছিল। অনেকখন বরেৎস্ মাটি
থেকেই ডালটা ধরবার চেষ্টা করে, অল্পের জন্যে পারছিল না। তখন সে মস্তো একটা পাথর টেনে আনে গাছটার নিচে, তারপর তাতে উঠে সামনের থাবা দিয়ে অনায়াসে ভেঙে ফেলে মোটা ডালটা, যাতে ছিল হাতছানি দেওয়া ওই সবুজ পাতাগুলো। অন্য কোনো ভালুকের পক্ষে এ কাজ সম্ভব ছিল না।
বিলিসির চিড়িয়াখানাতে একটা মজার ব্যাপার হয়েছিল। পোষা ভালুকদের দেখা-শোনা করার ভার ছিল যার ওপর, সে একবার ঘেরটার চাবি আনতে ভুলে যায়। চাবি আনতে ফের দপ্তরে যাবার আলস্যে সে ভালুক থাকার জায়গাটার পেছনে আর পাশে যে পাথরের এবড়ো-খেবড়ো দেয়াল ছিল তা বেয়ে ভেতরে ঢোকে। ওদের দিকে ছুড়ে দেওয়া রুটি খাচ্ছিল আধ-পোষা ভালুকগুলো, লক্ষ্য করছিল তাদের খাদ্যদাতাকে। লোকটা তার কাজ শেষ করে দেয়াল বেয়ে বেরিয়ে আসার পর ভালুকগুলোও একই পথে বেরিয়ে পড়ে বাইরে। চারটি জাম্ববানকে তারপর ফের খোঁয়াড়ে ঢোকাতে হয়রানি কম হয় নি! এই ঘটনার পর দেয়ালটাকে সিমেন্ট দিয়ে ভালো করে সমান করে দিতে হয়েছিল। এসব থেকে বোঝা যায়, ভালুকদের অনুকরণ ক্ষমতা বেশি।
Leave a Reply