সোমবার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৩:২৪ পূর্বাহ্ন

প্রকৃতিবিদের কাহিনী (কাহিনী-০৪)

  • Update Time : বৃহস্পতিবার, ১৫ আগস্ট, ২০২৪, ৮.০০ পিএম

পিওতর মান্তেইফেল

ডানাওয়ালা রক্তচোষার হাত থেকে উদ্ধার

জনের তপ্ত দিনের শেষে ঘরে ফিরছিল গরুর পাল। বন থেকেই তাদের পেছ, নিয়েছিল ডাঁশ আর মশার ঝাঁক, মাথা নেড়ে নেড়ে তাদের তাড়াচ্ছিল তারা। সামনের পশুগুলো তাড়াতাড়ি এই কষ্টের হাত থেকে রেহাই পেতে চাইছিল, তাদের আটকে রাখা মুশকিল হচ্ছিল রাখালের পক্ষে। তা দেখে প্রকৃতির পরিবেশে দেখা বুনো জন্তুদের কথা মনে পড়ল। মনে হবে বুঝি রক্তচোষা, জজ্বালিয়ে-মারা, তদুপরি সংক্রামক ব্যাধি-আনা এই পরজীবীদের হাতে এদের অবস্থা দুঃসহ। তবে সেটা শুধুই মনে হওয়া। একটা ঘটনা বলি।

একবার আমু-দরিয়ার বদ্বীপে ঘন সর-হোগলার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত একটা মস্তো ঘেসো মাঠের ধারে পৌঁছলাম। দেখি, আমার কাছ থেকে কয়েক ডজন মিটার দূরে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা কে’দো বন-শুয়োর। শক্তিশালী দূরবীনে দেখলাম, শুয়োরটা চোখ বুজে ঢুলছে, আর তার পিঠের ওপর লাফালাফি করছে থ্রাশ-জাতীয় কীট-খাদক সব পাখি। উড়ন্ত ডাঁশ আর বড়ো বড়ো মশাগুলো শুয়োরের চামড়ায় কামড় বসাবার আগেই তারা তাদের ধরে ফেলছে। ঠোঁট ভরা শিকার নিয়ে উড়ে যাচ্ছে তাদের পেটুক ছানাদের কাছে এবং তক্ষুনি ফিরে আসছে। শুয়োরও দিব্যি পাখিদের দৌলতে ডাঁশ-মশার হাত থেকে রেহাই পেয়ে উপভোগ করছে বৈকালিক সূর্যের তপ্ত আমেজ। স্পষ্টই বোঝা যায় এতে উভয় পক্ষেরই লাভ।

মস্কোর ফার ইনস্টিটিউটের লোসিনোওস্প্রভ বন ঘাঁটিতে চলছিল তৃতীয় বার্ষিকীর ছাত্রদের গ্রীষ্মকালীন ব্যবহারিক তালিম। খাবারের সময় ছাত্রদের চারিদিক খোলা ক্যান্টিনটার কাছে খাবারের আশায় সর্বদাই জটলা করত দু’ঝাঁক হাঁসের ছানা। বনে চরছিল এখানকার দশটা ভেড়া। তপ্ত দুপুরে ডাঁশ, মশা আর মাছির জালায় উত্ত্যক্ত হয়ে তারা ছুটে এসে ক্যান্টিনের সামনে ধপ করে বসে পড়ল যেন একেবারে প্রস্তর মূতি। রোঁয়া-ঢাকা ডানা মেলে তাদের দিকে এগিয়ে তক্ষুনি উৎপীড়িত প্রাণীগুলোর গায়ে আর মাথায় উঠে পড়ল হাঁসের ছানারা। ভেড়াদের পেছ, পেছ উড়ে এসেছিল রক্তচোষারা, কিন্তু ভেড়ার গায়ে বসার সুযোগ পাচ্ছিল কম: লম্বা ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে হাঁসের ছানারা একেবারে নির্ভুলভাবে বড়ো বড়ো ডাঁশ আর মশাগুলোকে ধরে ফেলছিল গায়ে বসার আগেই। শিগগিরই শেষ হয়ে গেল সব রক্তচোষা, হাঁসের ছানারা ফের মন দিল ভোজনরতদের দিকে। সবচেয়ে আশ্চর্য, ভেড়া আর হাঁসের ছানাদের এই নতুন সাপেক্ষ প্রতিবর্ত রপ্ত হয়ে গেছে কত তাড়াতাড়ি। যেন একটা অনুক্ত চুক্তি হয়ে গেছে তাদের মধ্যে, যাতে উভয় পক্ষই আগ্রহী। অথচ হাঁসেরা সাধারণত ক্ষুরওয়ালা জীবের পিঠে ওঠে না, যেমন ওঠে স্টারলিং, কাক, দাঁড়কাক।

যুগের পর যুগ ধরে রক্তচোষাদের হাত থেকে অব্যাহতি লাভের একটা নিজস্ব পদ্ধতি গড়ে উঠেছে এলুক হরিণদের ক্ষেত্রে। শীতকালে ওদের ঘাম নিঃসরণের সমস্ত গ্ল্যান্ড মিলিয়ে যায়। এতে শরীরের তাপ জমিয়ে রাখা সহজ হয়, কেননা শত্রুর আক্রমণ থেকে দ্রুত ছুটে পালাবার সময়েও তাদের ঘন লোম ঘামে ভিজে ওঠে না, আর শুকনো লোম তাপ পরিবহণ করে কম। উত্তরী হরিণেরাও শীতে বা গ্রীষ্মে ঘামে না। ভেতরটা যাতে খুব বেশি গরম না হয়ে ওঠে, তার জন্যে অন্যান্য জন্তুদের মতো এরাও ছোটার সময় জিব বার করে দেয়, মুখ হাঁ করে, বরফ তুলে নেয়, ছোটো ছোটো শ্বাস ফেলে ঠান্ডা করে নিজেদের। গ্রীষ্মকালে উত্তরী হরিণেরা চলে যায় খোলা-মেলা উচু জায়গায়, বাতাস সেখান থেকে উড়িয়ে নিয়ে যায় রক্তচোষাদের, এক্ হরিণেরা কিন্তু বনেই থাকে, ‘নিজেদের বাঁচায় অন্য পদ্ধতিতে। বসন্তে লোম ঝরতে শুরু করার সময় থেকে তাদের ঘাম ঝরার গ্ল্যান্ড দেখা দেয়, ফলে গ্রীষ্মে এক্ হরিণদের লোম ভিজে ওঠে বাদামী চর্বি-ঘামে। ছোটো ছোটো মশা তো দূরের কথা, বড়ো বড়ো মশা, এমনকি ডাঁশও সেটা এড়াতে চায়। চাঁর্ব- ঘামের ছোঁয়া লাগলে রক্তচোষা পতঙ্গরা মারা পড়ে, কেননা এতে তাদের বন্ধ হয়ে যায় পেটের নিঃশ্বাস পথ। এক্ হরিণের গায়ে কামড়াবার মতো জায়গা তাই হল সামনের পায়ের গোড়ালির জয়েন্ট, পেছনের পায়ের হাঁটু আর কান। রক্তচোষারা পায়ের এইসব জায়গা কামড়ে প্রায়ই রক্তাক্ত ঘা করে তোলে। কামড় এড়াবার জন্যে এক, হরিণরা হাঁটুর ওপর পর্যন্ত জলে ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকখন, বড়ো বড়ো কান লটপট করে মাথা ডোবায় জলে।

মাঝে মাঝে প্রাকৃতিক দুর্যোগই ঘটিয়ে দেয় রক্তচোষারা। একবার তপ্ত বায়ুস্রোত বা সাইক্লোনের টানে আঙ্কানিয়া-নোভা’য় ভেসে আসে এমন এক ধরনের মশার ঝাঁক যার কামড়ে জালা করে প্রচন্ড, প্রায়ই ঘা হয়ে যায়। দু’-তিন দিন ধরে লোকে বাইরে বেরয় নি, দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরেই বসেছিল। বিপজ্জনক এই কীটগুলোর কামড়ে বক এবং অন্যান্য অনেক পাখির ছানা মারা যায় তাদের বাসায়। ঢোকে তারা সর্বত, এমনকি মশারির জালেও আটকানো যায় না। দিনকয়েক পরে উধাও হয় মশারা, কিন্তু বহু, স্তন্যপায়ী জীব, এমনকি ধেড়ে ধেড়ে পাখিকেও খুব জালিয়ে গেছে।

তাশখন্দ শহর এলাকার মশাগুলো খুবই বিরক্তিকর, এদের কামড়ে মানুষের গায়ে বিপজ্জনক ঘা হয়ে যায়। আকাদমিশিয়ান ইয়ে. ন. পাভলভস্কির পরিচালনা- ধীন পরজীবীবিদ্যার ইনস্টিটিউট থেকে আবিষ্কৃত হয় যে এই মশাগুলো শীত কাটায় ই’দুরজাতীয় প্রাণীর বিবরে। ইনস্টিটিউটের কর্মীরা খুবই বুদ্ধিমন্ত পরীক্ষা মারফত দেখান যে বসন্তে শীতের ডেরা ছেড়ে মশারা বহুদূর উড়ে যায়, বড়ো বড়ো শহরে পর্যন্ত পৌঁছয়। এর পরে খাটতে হয়েছিল অনেক: শহরকে ঘিরে মস্তো একটা বৃত্ত করে বিষ দিয়ে মারা হয় সমস্ত বেলে ই’দুর, খাঁড়ে ফেলা হয় তাদের গর্ত। শত শত বছর ধরে যা মানুষকে জালিয়েছে এইভাবেই উদ্ধার মেলে তার হাত থেকে।

Please Share This Post in Your Social Media

More News Of This Category

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

kjhdf73kjhykjhuhf
© All rights reserved © 2024