সারাক্ষণ ডেস্ক
ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, তার বিচার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের মামলার বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। এই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জামায়াত-বিএনপির বেশ কয়েকজন নেতার বিচার হয়। পরে তাঁদের সাজা কার্যকর করা হয়।
এখন ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আরও অনেকের জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তাঁদের বিচার করার উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
গতকাল বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল।
তদন্ত সহায়তায় দল পাঠাবে জাতিসংঘ
জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক গতকাল বিকেলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ফোন করেন। তাঁদের মধ্যে ফোনালাপের বিষয়টি দুজনই তাঁদের এক্স হ্যান্ডেলে প্রকাশ করেছেন।
ড. মুহাম্মদ ইউনূস মানবাধিকার সমুন্নত রাখার ব্যাপারে ফলকার টুর্কের সহায়তা চেয়েছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার তাঁকে জানান, ছাত্র অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের তদন্তে খুব শিগগির জাতিসংঘের একটি তদন্ত দল গঠন করে বাংলাদেশে পাঠানো হবে।
এদিকে পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক জাতিসংঘের একটি সূত্র গতকাল সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে জানিয়েছে, ছাত্র আন্দোলনকালে হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হওয়ার কথা তিনি জেনেছেন। এই বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন ১৯৭৩–এর অধীনে। এই আইন অনুযায়ী, ট্রাইব্যুনালের বিচারে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যেহেতু জাতিসংঘ মৃত্যুদণ্ডের বিষয়টি অনুমোদন করে না, তাই এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘের যুক্ততার সুযোগ নেই।
শেখ হাসিনার বিচারসহ চার দফা দাবিতে সপ্তাহব্যাপী ‘রেজিস্টান্স উইক’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার (১৫ আগস্ট) সারা দেশে ‘সর্বাত্মক অবস্থান’ কর্মসূচি পালন করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচি অনুযায়ী সকাল ১০টায় রাজধানীর শাহবাগে কেন্দ্রীয় জমায়েত হবেন শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (১৪ আগস্ট) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আবু বাকের মজুমদার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই কর্মসূচি ঘোষণা করেন।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ১৫ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে সপ্তাহব্যাপী ‘রেজিস্ট্যান্স উইক’র অংশ হিসেবে সারা দেশে সর্বাত্মক অবস্থান কর্মসূচি। সারা দেশের সব ছাত্রজনতাকে এ কর্মসূচি সফল করার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
গত মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) শেখ হাসিনার বিচারসহ চার দফা দাবি উত্থাপন করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
দাবিগুলো হলো:
১. ফ্যাসিবাদী কাঠামোকে ব্যবহার করে যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, সেগুলোর দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
২. সংখ্যালঘুদের ওপর আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলসহ যারা পরিকল্পিত ডাকাতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানকে বিতর্কিত করার প্রচেষ্টায় অংশগ্রহণ করেছে, তাদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. প্রশাসন ও বিচার বিভাগে যারা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হামলা, মামলা, এবং হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিয়েছে এবং ফ্যাসিবাদ বারংবার কায়েমের চেষ্টা করেছে, তাদের দ্রুততম সময়ে অপসারণ ও বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৪. প্রশাসন ও বিচার বিভাগে যারা এতদিন বৈষম্যের শিকার হয়েছে, তাদের জন্য সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
শেখ হাসিনার অধীনে ১৫ বছরের অর্থনৈতিক লুণ্ঠনের পর বাংলাদেশ পুনর্গঠনে সহায়তা করতে দেশের পোশাক প্রস্তুতকারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় ব্যবসাকে রাজনীতি থেকে আলাদা রাখতে ব্যবসায়ীদের প্রতি আহ্বান জানান অধ্যাপক ইউনূস। তিনি বলেন, আপনাদের স্পষ্ট বার্তা দেয়া উচিত যে রাজনীতির সঙ্গে ব্যবসা মেশাবেন না। এতে কোনো লাভ হবে না।
বুধবার (১৪ আগস্ট) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি এ আহ্বান জানান।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর ওপর জোর দিয়ে ড. ইউনূস বলেন, সব প্রতিষ্ঠান ভেঙে দেয়া হয়েছে। আমরা একটা জগাখিচুড়ির মধ্যে ছিলাম। তারা আমাদের অর্থনৈতিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। তবে সবার সহযোগিতায় আমরা জাতিকে পুনর্গঠন করতে পারব।
বৈঠকে বিজিএমইএর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশ ব্যর্থ হতে পারে না। অন্যথায় এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। জাতি অস্তিত্ব সঙ্কটের সম্মুখীন হতে পারে।
জাতির এ সংকটকালে ড. ইউনূসের নেতৃত্বের প্রতি বিজিএমইএ নেতারা পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। তারা বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে খাতভিত্তিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি টাস্কফোর্স গঠনের অনুরোধ জানান। তাদের দাবির মধ্যে ঋণ পরিশোধের শর্ত শিথিল করা এবং ইউটিলিটি বিল পরিশোধে সমন্বয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
বৈঠক শেষে বিজিএমইএ পরিচালক শোভন ইসলাম সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন এবং অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে বিবৃতি দিলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা যেনো দিল্লি বসে আর কোনো বিবৃতি না দেন- সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ভারতের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। বুধবার ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় কুমার ভার্মা সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে উপদেষ্টা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে উত্থাপন করেন। এদিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভারত ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, বৃটেন, চীন ও সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেন। দিনভর সিরিজ ওই বৈঠকগুলো শেষে সন্ধ্যায় সেগুনবাগিচায় উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে উপদেষ্টা বলেন, ভারতে বসে শেখ হাসিনা বিবৃতি দিলে সম্পর্কের ক্ষতি হবে বলে আমরা হাইকমিশনারকে জানিয়েছি। আমি বলেছি- এটা সম্পর্ক উন্নয়নে মোটেও সহায়ক হবে না। এ বিষয়ে ভারতীয় হাইকমিশনারের জবাব কী ছিল জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা আমাদের সরকারের অবস্থানটা স্পষ্ট করেছি। এটার জবাব তিনি (হাইকমিশনার) কীভাবে দেবেন? তিনি তো ডিসাইড করতে পারবেন না। তিনি এ নিয়ে কিছু বলতে পারেন না বলেই আমি মনে করি।
এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তিনি যেটা পারেন, তার সদর দপ্তরে জানানো। আমি নিশ্চিত তিনি এটা সদর দপ্তরে জানাবেন। কোন প্রেক্ষাপটে উপদেষ্টা বিষয়টি বললেন? জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, এই আলোচনার প্রেক্ষাপটটা হলো বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, যা বাংলাদেশ সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। আমরা চাই- তিনি ভারতে বসে যেন এটা না করেন। শেখ হাসিনার বিবৃতিকে আমরা কী হিসেবে দেখবো? এমন প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমরা সরাসরি হোস্টাইল অ্যাক্ট হিসেবে বলছি না। কিন্তু এটা তো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অন্তরায়, সেটাই হাইকমিশনারকে বলার চেষ্টা করেছি। এটা কি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলের বেলায়ও প্রয়োজ্য হবে? এমন প্রশ্নে উপদেষ্টা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলেকে নিয়ে আমি কোনো কথা বলিনি। শেখ হাসিনার নামে মামলা হয়েছে, তাকে ফেরানোর বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিছু ভাবছে কিনা? বা ভারতকে কিছু বলবে কিনা? এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে বলবে। তারা যদি বলে ফেরত আনতে হবে, আমরা আনবো। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এ নিয়ে নিজে থেকে কিছু করার নেই। উপদেষ্টা বলেন, এ নিয়ে দু’টি মন্ত্রণালয় কাজ করে। একটি হলো স্বরাষ্ট্র, অন্যটি আইন। তারা যেভাবে পরামর্শ দেবে সেভাবেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নেবে। ভারতের গণমাধ্যমের ভূমিকা নিয়ে হাইকমিশনারকে কিছু বলেছেন কিনা? জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, আমি বলেছি- এখানে কিছু ঘটনা ঘটেছে সেটি আমরা খবর নিয়েছি, প্রধান উপদেষ্টা হিন্দু সমপ্রদায়সহ অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন। আমরা চাই সবাই যেন সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে, কারও ওপর হামলা সরকার সহ্য করবে না। দোষীদেরও বিচারের আওতায় আনা হবে। তাকেও (হাইকমিশনার) বলেছি- ভারতের গণমাধ্যম এটাকে অতিরঞ্জন করে খারাপ পরিবেশ তৈরি করছে, এটা ঠিক না। সীমান্ত নিয়ে কিছু বলেছেন কিনা? জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা বলেছি, কিছু সমস্যা আছে। এই একটি ইস্যু সীমান্ত হত্যা আমরা দুই পক্ষ চাইলে সমাধান করতে পারি। আমি যখন মুক্ত মানুষ ছিলাম তখন প্রচুর লিখেছি, সেটা আমার বিশ্বাস। এখনো বলবো, আমরা চাইলে সীমান্ত হত্যা বন্ধ করতে পারি। ভারতীয় দূতের সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কী আলোচনা হয়েছে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, তিস্তা নদীতে যতটুকু পানি আছে, তার ন্যায্য হিস্যা চেয়েছি আমরা। আমি বলেছি, পানি যেটুকু আছে তা আমরা ভাগাভাগি করতে পারি। পানি কম আছে এটা ঠিক। যেটুকু আছে তার সুফল তো ভারত পাচ্ছে। আমরা একটুও কি পেতে পারি না?
Leave a Reply